লেখা: হাবিবা আক্তার সুরভী
ছেলেবেলায় আমরা এক বাসায় ভাড়া থাকতাম।
সেই বাড়িওয়ালার পাঁচ সন্তানের ভেতর শুধুমাত্র বড় ছেলের ছিল এক মেয়ে-তাসনিম।
তিন চাচা, এক ফুপুর একমাত্র ভাতিজি-তাসনিম (ছদ্মনাম)।
নিজের মায়ের কোল থেকে বের হলেই দাদা-দাদী, দৌড়ায় বামে গেলে চাচার ঘর, ডানে গেলে ফুপুর ঘর। ভয়াবহ আদরের শৈশব।
সে খেলতে আসত প্রায়ই আমাদের সাথে। তবে তার জীবনে একটাই আফসোস—তার হাতে কোনোদিন কোনো টাকা দেয়া হত না। বাসার মেইন গেটের বাইরে ও যেতে দেয়া হত না। সকল কিছু চাইলেই কিনে এনে দেয়া হত ওকে।
আমরা যে এক-দুই টাকা নিয়ে দোকানে এটা সেটা কিনতে যেতাম, সেটা তার জন্য 'স্বপ্ন'সম। একদিন তাসনিম খেলতে এল ৫ টাকার নোট নিয়ে। বিশাল অবস্থা, তাসনিমের হাতে টাকা! ও মাই গড!
: এই টাকা দিয়ে কী কিনবা তাসনিম?
: আমি চাই-এক প্যাকেট চিপস আর একটা কোক কিনব আমার জন্য। আর তোমাদের জন্য এক প্যাকেট বিস্কুট।
তাসনিমের স্বপ্ন শুনে তো আমরা থ! জীবনেও মুদি দোকানে না যাওয়া মেয়ে ৫ টাকা দিয়ে দেখছে ৫০ টাকার স্বপ্ন!
তো মাঝেমধ্যে ঢাকা শহরে, গুলশান-বনানী কিংবা ইউরোপে- পশ্চিমা দেশে বসবাসরত প্রিভিলেজপ্রাপ্ত নারীরা যখন গপ্পো দেয়, নারীর সমান অধিকারের পক্ষে তিনি নেই। নারীর সমতার এসবই প্রোপাগাণ্ডা।
তখন আমার সেই তাসনিমের কথা মনে পরে। ইনোসেন্ট তাসনিম, তাসনিমের দোষ নাই।
এই প্রিভিলেজপ্রাপ্ত তাসনিমরা তাদের সেফটি বাবলে বসে জানে না, শুধুমাত্র ‘নারী হওয়ার কারণে গার্মেন্টসে যেই নারী অপারেটর তার পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে পনেরশো টাকা কম পাচ্ছে।
কিংবা মাঠে মাটি কাটা কামলা নারী সারাদিন কাজ করে ও পুরুষ কামলার চেয়ে দুইশো টাকা কম পাচ্ছে। অথবা গ্রামের সেই কিশোরী পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নারী হওয়ায় তার চেয়ে বয়সে দ্বিগুণ লোকের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার গল্প।
এসি কারে ভার্সিটিতে যাওয়া তাসনিম জানে না হলে থাকা কিংবা পাবলিক বাসে প্রতিদিন লোকের ধাক্কা খেয়ে টিউশন করে তিনহাজার টাকা কামানো মেয়ের গল্প।
তাসনিম জানে না—নারী ও শিশু নিপীড়ন আইনের কারণে এখন বাসর রাতে যোনী ছিঁড়ে ফেলা মেয়েটাও এখন আইনের আশ্রয় নিতে পারে।
তাসনিমদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
তবে একটা প্রত্যাশা আছে, জেনারেশনাল ওয়েলথ কিংবা প্রিভিলেজপ্রাপ্ত তাসনিমরা যেন ফ্রি সময়ে একটু টিনের চশমা খুলে বসে। একটু যেন পত্র-পত্রিকা পড়ে। একটু যেন 'History of female rights' সম্পর্কে জানে।
প্রিভিলেজড তাসনিমরা যদি এক কদম এগিয়ে আসে, তাহলে ওই গ্রামের জরিনা, গার্মেন্টসের সখিনা, মাঠের আমেনারা এগিয়ে যাবে দশকদম।
এও যদি না পারে তাতেও সমস্যা নেই। তাসনিমরা যেন পাঁচ টাকা নিয়ে ৫০ টাকার সদাই করতে মুদিদোকানে রওনা না দেয়।
তারা চুপচাপ থাকুক, মুখ না খুলুক। তাদের দোকান থেকে চিপস, কোক, বিস্কুট এনে পানিতে গুলিয়ে খাইয়ে দেয়ার লোক আছে এবং আমাদের তাতে কোনো সমস্যাই নেই।
পাঠকের মন্তব্য