ভাস্কর মানব, শহীদ রুদ্র ও জননী সাহসিকা

১০১ পঠিত ... ১৬:৩২, এপ্রিল ১৭, ২০২৫

25 (9)

ভাস্কর মানবেন্দ্রর বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করায় কয়েকজন লীগ কর্মী গ্রেফতার হয়েছে। ভাস্কর মানবেন্দ্র বাংলা বর্ষবরণের শোভাযাত্রার জন্য মোটিফ নির্মাণ টিমে অংশ নেবার পর থেকেই; সোশ্যাল মিডিয়ায় পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা মানবেন্দ্রের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে তার বাড়িতে হামলা চালনার আহবান করে। মানবের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলে, সে হাসিনাতসির দানবীয় এফিজি নির্মাণ করেছে। অথচ সে নির্মাণ করেছে বাঘের মোটিফ।

জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই হাসিনার দোসরেরা ধারাবাহিকভাবে তরুণ বিপ্লবীদের অনেকের ওপর চড়াও হয়েছে; বাড়িতে আগুন দেবার ঘটনাও ঘটিয়েছে। এটি তারই ধারাবাহিকতা।

জুলাই বিপ্লবে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রুদ্র শহীদ হয়। আমরা দেখেছি ২০২৪-এর একজন শাখা সিঁদুর পরা মা তার তরুণ সন্তানের পাশে জননী সাহসিকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিরোধ মিছিলে।

এটাই বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের জাদুবাস্তবতা। এইখানে কর্মই মানুষের ধর্ম; দেশই মানুষের ধর্ম। সহজাত সম্প্রীতির এই দেশে বৃটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি, পাকিস্তানের পাঞ্জাবের কোলাবরেটর জমিদারদের মুসলিম বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ রেসিজম, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলাবরেটর জমিদারদের বাঙালি বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ রেসিজম; ইত্যাদি মাংসের কারবারকে দ্রোহের ঝড়ে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের নানা ধর্ম গোত্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ।

স্বাধীন বাংলাদেশে সুশাসন দিতে ব্যর্থ দুর্নীতিপ্রবণ ক্ষমতাসীন দলগুলো ঘৃণার দোকান খুলে মানুষকে বিভাজিত করে শাসন ত্রাসন সংহার করেছে। একটু ধার্মিক হিন্দুকে ‘ভারতের দালাল’ তকমা দিয়ে ও একটু ধার্মিক মুসলমানকে ‘পাকিস্তানের দালাল’ তকমা দিয়ে শিকারের চেষ্টা করেছে নরভোজি রাজনৈতিক বলয়গুলো। এইভাবে নিজভূমে পরবাসী করে ফেলা হয়েছে ছোট খাট মানুষের ঈশ্বরদের। অথচ এই ছোটখাট মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকা দ্রোহের আগুন দপ করে জ্বলে ওঠায় এই জনপদ থেকে উতপাটিত হয়েছে বৃটিশ, পাকিস্তানি, ভারতীয় উপনিবেশ।

এই যে আমি যখন বৃটিশ, পাকিস্তানি, ভারতীয় উপনিবেশের প্রতি অপছন্দ প্রকাশ করি; তখন সে অপছন্দের লক্ষ্য দেশগুলোর ক্ষমতা-কাঠামো, রক্তপিপাসু চিন্তা-কাঠামো। দেশগুলোর সাধারণ মানুষ; বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মতোই ভাগ্যহত, বৈষম্যে ধূসর জনপদে কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকা মানুষ। তাদের জন্য সমানুভূতি রাখা মানবিক দায়িত্ব।

কিন্তু বাংলাদেশে রক্তপিপাসু চিন্তাকাঠামো রয়েছে; যারা দেশকে ভালোবাসতে শেখায় ভারত ও পাকিস্তানকে ঘৃণা প্রকাশের শর্তে। এরা পত্রিকার পাতায় ঘৃণা উস্কে দেয়। নিজের সীমাবদ্ধ চিন্তার গজফিতা দিয়ে আরেকজন মানুষের দেশপ্রেম মাপামাপি করে গড়ে তাকে ভারতপন্থী অথবা পাকিস্তানপন্থী তকমা দিয়ে দেয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ও অবাঙ্গালিদের বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করে রাতারাতি সাহেব সেজে বসা লোকগুলো এই ঘৃণা উৎপাদন কারখানার সর্দার। দেশের সাধারণ মানুষকে ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী এই কাল্পনিক দুইভাগে বিভক্ত করে; ঘৃণা বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করে এস্টাবলিশমেন্টের দালাল ও দলদাসেরা। এরা যেহেতু দালালি ছাড়া নিজের জীবনের বাগানের একটি ফুলও ফুটাতে পারে না; তাই এরা আগেভাগেই অন্য লোককে দালাল তকমা দিয়ে নিজের সারিতে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে।

৫৪ বছর এই হীন উপমানবদের বিভাজন ও ঘৃণার কারবার দেখেও আমরা যদি এই প্যাটার্নটাকে ধরতে না পারি; সে দায় আমাদের নিজের। ফুল মি ওয়ান্স, শেইম অন ইউ; ফুল মি টুয়াইস, শেইম অন মাইসেলফ। হাসিনাৎসির ১৫ বছরে পাকিস্তানের দালাল তকমা দিয়ে রক্তপিপাসা, গুম, ক্রসফায়ার, মানবতাবিরোধী অপরাধ দেখেছি। সুতরাং বিপ্রতীপ ঘৃণার কারবারিদের ভাষায় ভারতের দালাল তকমা দিয়ে একই মানবতা বিরোধী অপরাধের পথে যেন কেউ না হাঁটে সেটাই জুলাই-এর শিক্ষা।

সময় এখন ঐক্যের। ধর্ম গোত্রের সীমারেখার বাইরে গিয়ে মানবিক বন্ধুত্বের স্বদেশ রচনাই আমাদের শেকড়ে ফেরা। প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রে ৭৮ বছরেও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে না পারায়; বৈষম্যে জর্জরিত সমাজে সাম্যের দিশা দেখাতে না পেরে কট্টর ধর্মীয় চিন্তাকে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শিখণ্ডি করে সংখ্যালঘু নির্যাতন সেখানে প্রতিদিনের ঘটনা। তিনশো বছর আগের ইতিহাসকে মনের মাধুরী মিশিয়ে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করে সংখ্যালঘু হত্যার কায়দা কানুন শেখানো হয়েছে ছাব্বা নামের একটি চলচ্চিত্রে।

এগারো বছর ধরে সংখ্যালঘু নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে মোদি প্রশাসন ও রাজনৈতিক কাঠামো; আর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাল্পনিক উপাখ্যান নিয়ে মেতে রয়েছে গদি মিডিয়া। ঐ যে নিজে দালালি করে জীবন নির্বাহ করা লোকেরা যেমন অন্যকে দালাল তকমা দিয়ে একটা ইকুয়ালাইজিং-এর খেলা খেলতে চেষ্টা করে।

এখন বাংলাদেশের মানুষের সামনে চ্যালেঞ্জ মোদি অনুসারীদের সংখ্যালঘু নির্যাতনের উস্কানিতে পা না দেয়া। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসী বন্ধুত্ব, বিপদে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ানো ভারতের ক্ষমতা কাঠামো ও গদি মিডিয়ার উস্কানির একমাত্র জবাব। ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে বরং ভারতের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন; আর সেখানে মানবাধিকার লংঘন নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জারী রাখা কর্তব্য। বাংলাদেশের মানুষ যদি ভারতের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করে; তাহলে গদি মিডিয়ার বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা হ্রাস পাবে।

কখনও ফেসবুকে কারণে অকারণে হিন্দু ধর্মের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের ন্যারেটিভ অনুসরণ করে গালি দিয়ে গেলে; সেটাকে পুরো হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গালি কল্পনা করা অনুচিত। তাহলে মানবের বাড়ি পুড়ল কেন! এই মানবেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ; যাদের সঙ্গে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছি আমরা; সভ্য ও অগ্রসর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি একসঙ্গে; হাসি-আনন্দে জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তগুলো নির্মাণ করেছি। রক্তের সম্পর্ক কেবল রক্তীয় হয়; আসল হচ্ছে আত্মার সম্পর্কের আত্মীয়তা। এই আত্মীয়ের মাঝে কোন ধর্ম গোত্রের বিভেদ থাকে না; থাকে শুভাকাংক্ষিতার ঐক্য।

১০১ পঠিত ... ১৬:৩২, এপ্রিল ১৭, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top