লেখা: আদীবা রাইদাহ্ (কঙ্গো)
এটা আমার আজকের ইফতার।
ভাত, আলু ভর্তা, ডিম ভাজি, ডাল।
আমার জন্য কমফোর্ট ফুড। তাও পোস্ট দিলাম তার কারণ এটা বিদেশে প্রথম একা ইফতার আমার।
গত দেড় মাস উদ্বাস্তু থাকলেও সাথে কেউ না কেউ ছিল। উগান্ডার হোটেলে থেকে থেকে ঠান্ডা চুইংগামের মতো ডিম ভাজি খেয়ে বিরক্ত হয়ে রোজার প্রথম দিন আমি আর আর্মির একজন সিনিয়র স্যার একটা বাসা নিয়ে নিয়েছিলাম। আল্লাহ কেন জানি আমাকে মাঝে মাঝে খুব ভালো মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৪ রোজা পর্যন্ত আমি আর স্যার অফিস থেকে এসে টুক টুক করে এটা ওটা গল্প করতে করতে রান্না করে ফেলতাম । এনতেবেতে পাওয়া যায় না এমন কিছু নাই। কোনোদিন স্যান্ডউইচ, কোনোদিন ম্যাগি নুডলস, খিচুড়ি, পাস্তা, কেএফসি... অপশনের অভাব ছিল না। ইফতার করে নামাজ পড়ে আমি যখন সোফা থেকে উঠতে পারতাম না, স্যার সুন্দর করে আমাদের দুজনের জন্য মজার একটা দুধ চা বানাতেন। আর আমি বেয়াদ্দব জুনিয়রের মতো সোফায় শুয়ে শুয়ে ওই বেহেশতি চা আর বাকি ইফতারিটা খাইতাম।
তারপর এসে পড়লাম আবার এই বেনী প্যারাডাইসে।
এখানে মনে হয় মানুষজন কালো রং বাদে আর কাউকেই খুব একটা পছন্দ করে না। অফিস আর বাসার মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব, যেটা গাড়ি ছাড়া পার হওয়া যায় না। সেই রাস্তাও আবার সন্ধ্যার পর ব্যবহার বন্ধ।
তাও এতদিন স্যার ছিলেন সাথে। গতকালকে স্যার বাংলাদেশে গিয়েছে ছুটিতে। তাই নতুন বাসায় উঠেছি। নতুন জায়গা, নতুন ওয়েদারে গায়ে জ্বর থাকায় অফিসে যাইনি আজ। এই কয়েকদিন এখানে এসে যা বুঝলাম, অফিস করে একা কাজ করে পারা যাবে না। একটা মামা রাখলাম রান্নাবান্না, ঘরদোর গোছানোর জন্য।
(এখানে সকল মহিলাকে মামা আর সকল পুরুষকে পাপা ডাকা হয়। কেন ডাকা হয়, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নাই। আমি জানি না।)
সকালে প্রচণ্ড মাথা-ব্যথা আর জ্বর নিয়ে উঠে দেখি বাসায় গ্যাস, পানি ও ইলেক্ট্রিসিটি কিছুই নাই। আমার বাসার মামা-পাপারা সোহাইলি ব্যতীত বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফ্রেঞ্চ কোনোটাই বোঝে না। আন্তাকশারির মতো হাত-পা নেড়ে নেড়ে যা বোঝাতে পারছি তার উত্তরে ওরা আমাকে বলল যে বাইরে প্রোটেস্ট চলতেছে দেখে সব বন্ধ। ভালো লাগল, যাই হোক বাংলাদেশ শুধু একা না!
কী আর করব! জ্বর-টর বাদ দিয়ে ওদেরকে বোঝানো শুরু করলাম যে ভাই, আমি রোজা। আমাকে রান্না করতে হবে। যেভাবেই হোক পানি আর গ্যাসটা ব্যবস্থা করে দাও। এই সকল আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তারা বিকাল চারটায় আমার জন্য একটা গ্যাসের সিলিন্ডার, ইলেকট্রিসিটির কানেকশন আর একটা ডিব্বায় কিছুটা পানি নিয়ে আসলো। জানতে পারলাম, এখানে ২০ লিটার খাবার পানির দাম বিশ ডলার! প্রাণের চেয়ে প্রিয় ওই পানি থেকে বিন্দু বিন্দু পানি দিয়ে রান্না চড়ালাম, আর মামাকে বললাম একটু পেঁয়াজ মরিচ কেটে দেওয়ার জন্য। মামা আমার খুব শার্প। দুই সেকেন্ডেই কাজটা করে ফেলল। দুই সেকেন্ড লাগার কারণটা একটু পরে বুঝতে পেরেছি। তেলে পেঁয়াজ ছাড়তে গিয়ে দেখি মামা আমার আলুর মত দুই কোপে পেঁয়াজ কাটছে, আর এক ডিমের জন্য নাগা মরিচ কাটছে পুরো একটা!
গত দুই রোজায় আমি ক্যাডেট কলেজে ছিলাম অ্যা্ডজুটেন্ট হিসেবে। একে তো নিজের কলেজ, তার উপরে স্যার ম্যাডামরা জানতেন যে আমি একা থাকতাম। এমন কোনোদিন ছিল না, যেদিন আমার বাসায় কারও না কারও বাসা থেকে বাহারি ইফতার আসেনি । এবং শুধু ইফতার না, ইফতারের সাথে রাতের ডিনারও পাঠায় দিতেন। যদি কোনো কারণে কোনোদিন ইফতার মিস গিয়েছে, ঐদিন আমার বাসায় যে খালা কাজ করত ওই খালা বাসা থেকে ইফতার বানায়ে নিয়ে আসত। বকা দিয়ে, রাগ করেও আমি কখনও উনাকে আটকাতে পারিনি। আমি যখন ক্যাডেট ছিলাম, তখনও আমি উনাকে কলেজে পেয়েছিলাম। খালা নিজে কিন্তু হিন্দু এবং আমি যতই রিকুয়েস্ট করি নাই কেন, আমি রোজা থাকা অবস্থায় উনাকে আমি কখনও আমার বাসায় খাওয়াতে পারি নাই। হয়তো এই জন্যই রোজায় আব্বু আম্মু আসুক বা না আসুক কখনও আমার কষ্ট হয়নি। দোয়া করি যারা আমাকে সেল্ফলেসলি এত ভালোবাসা দেখিয়েছেন, আল্লাহ যেন তাদেরকে ঐ মায়া ও ভালোবাসা হাজারগুণে ফিরিয়ে দেন।
যাইহোক, ইফতারির ২০ মিনিট পর যুদ্ধ শেষ করে এই তিন আইটেম নিয়ে খেতে বসতে পেরেছি। আমি সব সময় নিজেকে একদমই হোমসিক পারসন হিসেবে দাবি করি না।
কিন্তু আজকে খেতে বসে কেন যে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল!
আম্মু জানলে কী একটা লজ্জার ব্যাপার হবে!
পাঠকের মন্তব্য