লেখা: জাহিদ হোসাইন
এটা খুবই বিরল যে, যৌনজীবনে সুখী একজন মানুষ ধর্ষক হয়ে উঠবে। বরং আমার ধারণা, যৌনতায় অক্ষম, অবদমিত ও অশিক্ষিত পুরুষ ছাড়া কেউ ধর্ষক হয় না। তাই, যৌনশিক্ষার প্রচলন হওয়া দরকার। যে দেশে শিশুদের হাতে ইন্টারনেট আছে কিন্তু যৌনশিক্ষা নাই, সে দেশে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি করা আর ধর্ষণ প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
দেড়শো বছর আগে মেয়েদের জীবন যেমন ছিল আজ তেমন নেই। যে মেয়েরা আগে অসূর্যস্পর্শ্যা ছিল, আজ তাঁরা ফতোয়াবাজ আর নীতিপুলিশদের পরোয়া না করে পড়তে, কাজ করতে, খেলতে, নাচতে, গাইতে বাড়ির বাইরে বের হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো দেড়শো বছর আগের আইন দিয়েই এখনো তাঁদের উপর ঘটে চলা শারীরিক হেনস্থার বিচার চলে। ফলে যা হবার তা-ই হয়; পেনিট্রেশন প্রমাণ করা যায় না, ধর্ষণও প্রমাণিত হয় না!
আপনাদের নুসরাত জাহান রাফির কথা মনে আছে নিশ্চয়। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী, মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল তাঁকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সারাদেশ ফুঁসে ওঠে প্রতিবাদে। সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে দেয়। কিন্তু ধর্ষণ কি কমেছে তাতে?
কমেনি। কেন কমেনি তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি । আইনের সংশোধন একটি অন্যতম উপায় হলেও একমাত্র উপায় নয়। কেবল আইন দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হয় না। বরং রুট কজ গুলি দূর করতে হয়।
ধর্ষণ একটি ফৌজদারি অপরাধ। কোন ফৌজদারি অপরাধ যখন ক্রনিক হয়ে ওঠে, অর্থাৎ প্রায় একই প্যাটার্নে বারবার ঘটে, কোন কিছু দিয়েই ঠেকানো যায় না, তখন বুঝতে হয় এগুলো আর কেবল বাদী আর বিবাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। বরং পুরো সমাজ বা রাষ্ট্র এখানে জড়িত। রাষ্ট্রের পদ্ধতি বা সিস্টেমের কোথাও বড় কোনো গলদ আছে বলেই বারবার এমন ঘটছে। ফৌজদারি অপরাধটি তখন সিস্টেমিক মানবাধিকার লংঘনে রূপ নেয়। দু একটা গ্রেফতার বা দু একটা সাজা দিয়ে বা দু একটা আন্দোলন করে এটা আর বন্ধ করা যায় না।
এই সিস্টেম সারিয়ে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আপনারা যারা এ পর্যন্ত পড়েছেন, তাঁদের কাছে এখন একটা প্রশ্ন রেখে এই লেখা শেষ করতে চাই। বলেন তো, আমাদের রাষ্ট্র কি ধর্ষণ প্রতিরোধে সত্যিই আন্তরিক? ধর্ষণের রুট কজ গুলি দূর করার কোন উদ্যোগ কি রাষ্ট্র নিয়েছে?
শুধু যে যৌনতৃপ্তির জন্য পুরুষ ধর্ষণ করে, তা তো নয়। ধর্ষণ এমন একটা অপরাধ যাতে অফেন্ডারের সামাজিক ও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বেরও প্রতিফলন ঘটে। যেখানে নারীকে নিপীড়ন করার মধ্যে ‘পৌরুষ’, ক্ষমতা, আর সিনেম্যাটিক ফ্যান্টাসি চরিতার্থ করতে পারার তৃপ্তিও আছে। রাষ্ট্র কি মেল শোভেনিজম দূর করার কোন উদ্যোগ নিয়েছে?
প্রতিটি ধর্ষণের পেছনেই ছোট বা বড় ক্ষমতার উপস্থিতি আছে। ধর্ষণ কেবল দুটি প্রত্যঙ্গের ব্যাপার না। পুরুষাঙ্গ একটা নিরীহ মাংসপিণ্ড। মনের নির্দেশ ছাড়া এর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। যে ‘মন’–এর নির্দেশে একজন পুরুষ আপাদমস্তক পুরুষাঙ্গ হয়ে ওঠে, সেই মনকে যে ‘ক্ষমতা’ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই ক্ষমতার পরিচর্যা বন্ধ করার কোন উদ্যোগ নিয়েছে? বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছে? সামাজিক নিরাপত্তা বাড়িয়েছে? নারীর ক্ষমতায়ন করেছে? যৌনশিক্ষা দিয়েছে? নারীর প্রতি সম্মানহানিকর বক্তব্য বন্ধ করেছে?
বারবার মেয়েরা ফুলকি হয়ে পথে নামবে আর বারবার তাঁদেরকে খালি হাতে ফিরতে হবে? নুসরাত, তনু, মুনিয়া, প্রীতি উরাং, আছিয়া…কেবল নামের পর নাম যোগ হতে থাকবে? এই প্রশ্নটা রেখে গেলাম আপনাদের জন্যে যাঁরা বাংলাদেশের ভার নিয়েছেন নিজের কাঁধে, স্বেচ্ছায়।
পাঠকের মন্তব্য