বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাহফুজ আলমের ফেসবুক স্টেটাস নিয়ে মাঝে মাঝেই আকাশ ভেঙ্গে পড়ার আলোচনা শুনি। ছোটকাল থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর ন্যারেটিভ শুনে যারা বড় হয়েছে; তাদের অবচেতনে ঐ ন্যারেটিভের প্রতি একটি মায়া রয়ে গেছে। ঐ ন্যারেটিভটিকে প্রয়াত বাবার রুমালের মতো করে সযত্নে রেখে দিয়েছে যারা; তারা শেখ হাসিনাকে কিছুটা পছন্দ আবার অপছন্দ করতো। তবু চাইতো, মন্দের ভালো হাসিনাটাই ভালো; তাকে মাঝে মাঝে মৃদু বকে দিলেই হবে।
কিন্তু হঠাত আলোর ঝলকানির মতো নাহিদ, মাহফুজ, সার্জিস এসে কাউন্টার ন্যারেটিভ গড়ে তুললে; তখন ভীষণ রাগ হয় তাদের ওপর। শতমুখে যখন ভারতের বিজেপি, কংগ্রেস, মিডিয়া, প্রশাসন ও কলকাতার সংস্কৃতি দাদারা বলে, লিখে রেখো এক ফোটা দিলেম স্বাধীনতা; তখন মুনতাসির মামুনের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির বালকেরা কাচুমাচু মুখ করে, অদৃশ্য সাবানে হাত কচলে প্রবল পুলক পেয়েছে। ডিএনএ-এর মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের বাড়ির সামনে জুতা খুলে মাথায় করে নিয়ে যাবার শতবর্ষের স্মৃতি; নায়েব ও গোমেস্তা তুই তুকারি করে ম্লেচ্ছ বলে ডাকার সৌরভ মাতাল করে অধীনস্থ ডিএনএ-এর প্রোটোজায়া।
সেখানে কে এই নাহিদ যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের চোখে চোখ রেখে বলে, আমরা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলি না; ভারতেরও উচিত নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলা। সুতরাং অধীনস্থ বড্ড গোস্বা হয় নাহিদের ওপর। অত্র এলাকার ডাকসাইটে জমিদার ভুবন মুখুজ্যে বাবুর মুখে মুখে তক্কো করিসনে খোকা। ওরা অনেক বড়, ওদের সঙ্গে শক্তিতে আমরা পারব না।
আহারে ক্ষুদ্রত্ব, মেরুদণ্ডহীন কেঁচো, সমস্ত অপমান মাথা পেতে নিয়ে তবু জমিদার বাবু লাখপতি হলে লক্ষ বাতি জ্বেলে ভোজ দিলে, সেইখানে কুঁই কুঁই করে পদ্মপাতায় ড্যালাপাকানো ডাল ভাত খেতে যাওয়া।
নরেন্দ্র মোদী ভারতের সংসদে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র টাঙ্গালে; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরুয়া প্রোটোজায়া অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মাতোয়ারা হলে, অধীনস্থ ডিএনএ এসে হেসে উড়িয়ে হালকা করে দিতে চেষ্টা করে। জমিদার বাবু তাকে কোন মাসহরা দেয়না তার পক্ষে কথা বলার জন্য। এ হচ্ছে ডিএনএ-র কর্তব্য; জমিদার বাবুর সম্মান ধরে রাখার শতবর্ষের প্রশিক্ষণ।
গেরুয়া বসনের পেট মোটা বেগুণী মুখমণ্ডলের চন্দনচর্চিত জমিদার নাতি ভাঙ্গা ঘরে বসে জমিদারি ঢঙ্গে মাহফুজকে হিজবুত বলে উপহাস করলে অধীনস্থ ডিএনএ সংস্কৃতি মামার সাজে তাতে খুব সায় দেয়। বাতেন দুটি কবিতা পাঠ করে সাংস্কৃতিক হলে নাম ধারণ করে পথিকৃত বাতেন; তখন তার দায়িত্ব মুখুজ্যের দুইব্যাটারি নাতিটির মনোরঞ্জন করে সংস্কৃতির পৈতেটা ধরে রাখা। মনোরঞ্জন মানেই দাড়ি টুপি থাকলেই তাকে মৌলবাদি ডাকা; আর গেরুয়া বসনের চন্দন চর্চিতকে প্রগতিবাদির সম্মান প্রদান। মুখুজ্যের নাতি অনার্য শরীরে আর্য অহম এনে উচ্চবর্ণের গৌরব করলে, পথিকৃত বাতেন আর্যের স্নেহধন্য সংস্কৃতি আর্য হয়ে ওঠে।
পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানে যোগ দেবার জন্য জিন্নাহকে সকাল দুপুর গালি দিয়ে আলগোছে লুকিয়ে রাখে নেহেরুর, আমাদের কলকাতাটা চাই সংলাপটি। কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মার্কা নেতারা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবার গোঁ না ধরলে শরত বসু, সুহরোয়ার্দীরা যে অখণ্ড বাংলাকে ভারত পাকিস্তানের বাইরে তৃতীয় স্বাধীন দেশ হিসেবে বের করে আনতে পারতেন; সেই অমোঘ সত্যটাকে ঢেকে রাখতে মুখুজ্যে হিজড়ে লাগিয়ে দিয়ে ইতিহাসের পদ্য লেখে।
বাংলার ইসলাম সুফি ধারার কোমল ইসলাম যা অনায়াসে বাংলার কোমল বৈষ্ণব প্রভাবিত হিন্দু ও বুদ্ধের আলো স্নাত বৌদ্ধদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে সক্ষম। সে কারণে সুলতানি, মুঘল ও নবাবী আমলের বাংলায় বিভিন্ন ধর্ম গোত্রের মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতো। ভারতের বর্ণ হিন্দু বা পাকিস্তানের আশরাফ মুসলমানের মতো আউটডেটেড সুপিরিয়রিটির ধারণা বাংলায় কখনো ছিলো না। বৃটিশেরা বাংলা দখল করলে তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের জমি দখল করে রাতারাতি সুপিরিয়র রুলিং এলিট হয়ে ওঠে। সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরকে দুঃস্থ করে তোলে, দুর্ভিক্ষে এক কোটি মানুষ মারা যায়। এরপর এই পূর্ব বঙ্গের সম্পদ লুট করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারেরা নবাবী আমলের সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরদের নিম্নবর্গের তকমা দেয়। বাংলা, পালি-সংস্কৃত, আরবি ফারসি শিক্ষিতদের অশিক্ষিত বলে ঘোষণা করে; নতুন শেখা ইংরেজি ভাষাকে একমাত্র শিক্ষিতের পরিচয় হিসেবে দাঁড় করায়।
শেরে বাংলা যে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, ভাসানি মজলুমদের নিয়ে যে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন করেন; তা ছিলো ভূমির অধিকার ফিরে পাবার আন্দোলন। এ কারণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া জমিদারের ডিএনএ আজো পূর্ববঙ্গের জমিদারি হারানোর বেদনা ভুলতেই পারে না।
শেরে বাংলা, ভাসানি, যোগেন মণ্ডল, শরত বসু, সুহরোয়ার্দি যে অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, শেখ মুজিব-তাজউদ্দিন তরুণ বয়সে সে স্বপ্নের সারথি ছিলেন। কলকাতার কট্টর সাম্প্রদায়িক লোকেরা অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবিত মানচিত্র থেকে পশ্চিমবঙ্গকে কেটে নিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগ দেয়। বৃটিশ কেরানি রেডক্লিফের পেন্সিলের দাগে আসাম ও সন্নিহিত অঞ্চল ভারত নিয়ে নেয়। এ হচ্ছে জমি ভাগাভাগিতে নেহেরুর মুন্সীয়ানা।
ভারতের সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের ছবি, মিডিয়ায় হাজারবার অখণ্ড ভারতের সংকল্প। সেই হেজিমনিকে বাংলাদেশের অধীনস্থ ডিএনএগুলো কখনো প্রশ্ন করতে পারেনি। আর মাহফুজ একবার অখণ্ড বাংলার মানচিত্র দেখানোতেই অধীনস্থদের সেকি গেলো গেলো।
আজকের যুগ অস্ত্র-শস্ত্রের যুদ্ধের যুগ নয়, এ হচ্ছে তথ্যের যুগ, ন্যারেটিভ কাউন্টার ন্যারেটিভ, হেজিমনি কাউন্টার হেজিমনির যুগ। অমিত শাহ, শুভেন্দু'র গরম ন্যারেটিভ, মাহফুজের কাউন্টার গরম ন্যারেটিভ; এসবই রেটরিকের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ চলতেই থাকে। এতে ভূমিবাস্তবতায় রাষ্ট্রের পলিসিতে কোন হেলদোল হয় না। ন্যারেটিভের বিপরীতে কাউন্টার ন্যারেটিভ থাকলে একপেশে দাদাগিরির মাত্রা কমে আসে।
বাতেনের ডিএনএ বৃটিশ রাজ ও তার মধ্যস্বস্ত্বভোগী জমিদার, পাকিস্তান শাহী কারো কোন অন্যায়ের কোন প্রতিবাদ করেনি। চিকেন হার্টেড ডিএনএ ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকে বা জীবন্মৃত থাকে। মুখ বুঁজে বাইরের সব অন্যায় সহ্য করে এসে বাসায় বৌ-ছেলেমেয়ের ওপর চোটপাট দেখানো এদের শতবর্ষের সংস্কৃতি। ভিখিরি মন এদের। ছেলে-মেয়েরা বাইরের কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইলে, আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে সুপারি চিবাতে চিবাতে বলে, ও মানুষ তোমার দুইটা চোখ দেখপা, দুইটা কান শুনবা আর একটা মুখতো, একটু কথা কম কবা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন