পরাজিত ভারতীয় ধনুক ব্যবসা

২৩৮ পঠিত ... ১৬:৫৮, নভেম্বর ২৭, ২০২৪

6

তরুণ প্রজন্ম যুগে যুগে সমাজ পরিবর্তন করতে চায়। অতীতে তাই তরুণেরা সমাজতন্ত্রী হতো। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন হলেও ইউরোপে সমাজতন্ত্রকে সামাজিক গণতন্ত্রে রুপান্তর করে কল্যাণরাষ্ট্র জন্ম দেয়া হয়েছে। চীনে সমাজতন্ত্রের অস্থিধারণ করে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটালিজম সমাজতন্ত্রের বিনাশ করে তরুণ প্রজন্মের সমাজ পরিবর্তনের আর কোনো পথ রাখেনি। যে কারণে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই এখন আদি ইজম কনজারভেটিজমের অধীনে চলে গেছে।

ক্যাপিটালিজমের ইঁদুর দৌড়, গাড়ি-বাড়ি-নারী-ভুঁড়ির যে খেলনা জীবনের লক্ষ্য; সেইখানে মানুষ একসময় ক্লান্ত হয়ে আবার চার্চে ছুটে যাচ্ছে জীবনের গভীর শুন্যতায় ঈশ্বরের আশ্রয় খুঁজতে। ইউরোপের ইতালি, নেদারল্যান্ডসে চার্চে ভিড় বাড়ছে, বাড়ছে ধর্মান্ধ মানুষের সংখ্যা।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র জনপ্রিয়তা পায়নি এর ঈশ্বরহীনতার কারণে। সেইখানে একমাত্র আশা ছিল উদারপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে। কিন্তু ভারতের কংগ্রেস পার্টিতে সেক্যুলার নেহেরুর চারপাশ ঘিরে বসে ছিলেন সরদার প্যাটেল থেকে প্রণব মুখার্জির মতো কথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। ফলে সেখানে কথিত নিম্নবর্গের হিন্দুরা ছিল অবহেলিত। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্রের দেউটি নিভে গেছে; তখন সমাজ পরিবর্তনে গুজরাটের গরিব চাওয়ালা মোদির সমাজ পরিবর্তনের ডাক জনপ্রিয়তা পায়। মোদির ইজমের আইকন খোদ ভগবান। ফলে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার মাঝ দিয়ে হিন্দুভারতের উদয় ঘটে।

পাকিস্তানে লিবেরেল রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টি রোটি কাপড়া মকান স্লোগান দিয়ে দেশ লুণ্ঠন করে নিজেরা প্রাসাদ গড়ে তোলে। তখন অধিকার বঞ্চিত মানুষের কাছে আফঘান মুজাহিদ হয়ে ওঠে সামাজিক মুক্তির প্রতীক। ইমরান খানের পিটি আই সেই দুঃস্বপ্ন থেকে সাধারণ মানুষকে বের করে এনে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন রচনা করে। কিন্তু দেশকে টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ব্যবহার করে যে মুসলিম লীগ নওয়াজ ও পিপলস পার্টি; তারা তা হতে দেবে কেন! ফলে ইমরানকে কারাগারে যেতে হয়।

বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মালিকানা দাবি করে সামাজিক সুবিচারের সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে জাতিকে বিভাজিত করে রাষ্ট্রকে টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ব্যবহার করে। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে ভারতের প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্রণব মুখার্জি থেকে নরেন্দ্র মোদির ছায়াতলে বসে আওয়ামীলীগ একইসঙ্গে কট্টর হিন্দুত্ববাদ ও কট্টর ইসলামপন্থা প্রতিপালন করে। শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম তখন মসজিদ ও মন্দিরে গিয়ে আশাহীনতায় আশা খোঁজে।

১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পেলে, ভারতের কংগ্রেস সংসদে আলাপ করে, আপাতত এটা মেনে নেওয়া হলো। কিন্তু আসমুদ্র হিমাচলের স্বপ্ন থেকে একদিনের জন্যও সরে আসেনি ভারত। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ পূর্ব বঙ্গের মানুষকে পীড়িত করলে; ১৯৪৭ সালে বৃটিশের দেওয়া জমিদারি হারিয়ে যারা পূর্ব বঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সেকেন্ড হোমে গিয়ে উঠেছিল; তারা গল্পে, সাহিত্যে, ইতিহাসের বয়ানে, চলচ্চিত্রে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে দেশবিভাগের যন্ত্রণা নিয়ে। যে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ তীব্রভাবে অপছন্দ করেন; তার আইকন ব্যবহার করে পূর্ববঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়। পাকিস্তানের স্থূল প্রশাসন রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ পালনে বাধা দিয়ে পূর্ব বঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে বিক্ষুব্ধ করে। ভাষা আন্দোলন থেকে পাকিস্তান উপনিবেশের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ দানা বাঁধে তা মুক্তিযুদ্ধের ঠিকানায় পৌঁছে যায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জিতে পুরো পাকিস্তান শাসনের ম্যান্ডেট পেলেও রোটি কাপড়া মকানের ফেইক স্লোগান দেওয়া ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হবার লোভে পাঞ্জাবের কিছু খুনে সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে শলা করে ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা করে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা চলতে থাকে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। তাজউদ্দিন ভারতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্য নিয়ে বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন।  

১৯৪৭ সাল থেকে নেহেরু প্রশাসন হয়ে ইন্দিরা গান্ধী এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাহায্য করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার এই সুযোগ কাজে লাগান ইন্দিরা। এতে আসল উপকারটা হয় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের। তারা তাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা পায়। বঙ্গবন্ধুর অনমনীয়তার কারণে ও পরে জিয়া-এরশাদ-খালেদার সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আকাংক্ষার কারণে বাংলাদেশকে ছায়া উপনিবেশ বানানোর পরিকল্পনা সফল হয়নি ভারতীয় প্রশাসনের।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দিল্লিতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনাকে গ্রুমিং করেন প্রণব মুখার্জি। তাকে বাংলাদেশে পাঠান। বাংলাদেশের লিবেরেল সমাজটিকে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি সংস্কৃতির মুক্তি ইত্যাদি স্বপ্ন দেখিয়ে আওয়ামীলীগ ঘন করে আনন্দবাজার ও পদ্মশ্রী পুরস্কার দেওয়া শুরু করে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রশাসন।

অবশেষে ২০০৮ সালে প্রণব মুখার্জি ওয়ান ইলেভেনকালের সেনাপ্রধান মইন উ কে ঘোড়া উপহার দিয়ে আওয়ামীলীগের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন। তিনি কংগ্রেস নেতা হলেও শেষ জীবনে এতই বিজেপি ভক্ত হয়ে ওঠেন যে, নিজের মেয়েকে বিজেপির সাংসদ হতে আহবান জানান। মেয়ে এই আহবান প্রত্যাখান করেন।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় এলে ভারতীয় প্রশাসন সরকারি স্থাপনার মানচিত্রে অখণ্ড ভারতের ছবি আঁকে; যেখানে বাংলাদেশ ভারতে বিলীন। এইসময় বাংলাদেশে অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মাতোয়ারা হয় শিক্ষিত হিন্দু যুবকেরা। মোদির ভঙ্গিতে তারা ইসলামোফোবিয়া প্রকাশ করতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর ডমিনো ইফেক্টে শিক্ষিত মুসলমান যুবকদের মাঝে অলীক খিলাফতের স্বপ্ন জাগ্রত হয়।

গুজরাট ও গোপালগঞ্জের কসাইয়ের রেসিপিতে নিরীহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সৃষ্টি করে জীবনের শুল্ক নেওয়া শুরু হয়। শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম জুলাই-অগাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ভেঙে পড়লে; হাসিনা পালিয়ে ভারতে যাওয়া, রিপাবলিক টিভির বাংলাদেশ প্রচারণা, কলকাতার সেই ৪৭-এর জমিদারী হারানো লোকেরা পুরোনো অভ্যাসে বয়ান তৈরি স্পষ্ট করে তোলে ভারতের ছায়া উপনিবেশ হারানোর বেদনা। মৌলবাদী মোদি সরকারের কোলে বসে, বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মৌলবাদী বলে তকমা দেয় ভারতের কিছু বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া। পুরোনো অভ্যাসে তারা মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত পাকিস্তান শব্দটিও নিয়ে আসে।

আদি এবং অকৃত্রিম কৌশলে বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুদের ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করে; সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভিক্টিম কার্ড নিয়ে মিছিল করতে লাগিয়ে দেওয়া হয় দেশে-বিদেশে। বিজেপির জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে ঘুরতে থাকে ইস্কন সদস্যদের একটি অংশ। উদ্দেশ্য একটাই ইউনূস সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। ভারতের অভ্যন্তরের মুসলমানদের স্বপ্রনোদিত অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ সরকার কখনও বিবৃতি দেয়নি। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরের হিন্দুদের মালিকানা ও অভিভাবকত্ব দাবি করে ছায়া উপনিবেশের আমেজটি ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকে।

বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমানকে এই ভারতীয় ধনুক ব্যবসার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের কৃত্রিম বিভাজন মুছে দিয়ে বন্ধু ও আত্মীয়ের মতো একে অপরের পাশে থাকতে হবে। কুঁচকুঁচানি হিন্দু ও কুঁচকুঁচানি মুসলমানদের উস্কানি উপেক্ষা করে দক্ষিণ এশিয়ায় উদাহরণীয় বহুত্ববাদী সমাজ গড়তে হবে। ভারত ও পাকিস্তানের বস্তাপচা বিভাজন ও বিদ্বেষের কালচারকে পিছে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র গড়ার গন্তব্যে।

২৩৮ পঠিত ... ১৬:৫৮, নভেম্বর ২৭, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top