শিল্পীদের কালো তালিকার কালা জাদু

৮৭ পঠিত ... ১৮:০৬, নভেম্বর ২০, ২০২৪

26

কবি আমীর খসরু সেই দিল্লি সালতানাতের সময় তিনজন বাদশাহর আমলে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। তার অমর সৃষ্টি কবিতা ও গীতিকবিতার পাশাপাশি তিনজন বাদশাহর জন্যই তিনি প্রশংসামূলক কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু একজন বাদশাহর পতনের পরেই অন্য কবিরা বলেননি, খসরুকে কালো তালিকাভুক্ত করো।

মির্জা গালিব মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন বলে; বৃটিশেরা ক্ষমতা দখলের পর দিল্লির কবিদল তাকে কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য উঠে পড়ে লাগেনি।

আজকের ভারত-পাকিস্তানেও গুণী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের কালো তালিকাভুক্ত করার চল নেই। পাকিস্তানে সেনাশাসন বিরোধী অ্যাক্টিভিজমের জন্য কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে বৈরুত ও মস্কোতে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে; কিন্তু কবি নির্বাসিত বলেই পাকিস্তানে ফয়েজের কাব্য-পাঠ বা তা নিয়ে লেখালেখি থেমে থাকেনি। ভারতের প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক অরুন্ধতী রায় গান্ধীজীর নিরন্তর সমালোচনা করেছেন; মোদীর সমালোচনা নিয়মিত করেন তিনি; এ কারণে সরকারের রোষানলে পড়লেও তাকে কোথাও কালোতালিকাভুক্ত করা হয়নি। পাকিস্তানে বুদ্ধিজীবী পারভেজ হুডবয় জিন্নাহর তির্যক সমালোচনা করেন, সেনাবাহিনীকে ধুয়ে ছেড়ে দেন; কিন্তু তাকে কখনও কালো তালিকাভুক্ত করা হয়নি।

তাহলে বাংলাদেশে কেন প্রতিটি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীদের কালো তালিকা করা হয়! সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে কিছু দায়িত্ব পালনকালে এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে শিল্পীর কালো তালিকা করার খেলাটা খুব কাছ থেকে দেখেছি।

যেসব কবির কবিতা হয় না, কথাসাহিত্যিকের গল্প জমে না, গায়কের গলায় সুর কম, অভিনেতার অভিনয় দক্ষতা নেই; এই ধরনের কিছু ডোয়ার্ফ সাপের মতো কিলবিল করে ঘুরে বেড়ায় বাংলাদেশের শিল্প জগতে। যেহেতু প্রতিভা নেই তাই আওয়ামীলীগ ও বিএনপি দলাদলি করে এরা শিল্পজগতে দাপাদাপি করে; কুস্তাকুস্তি করে। এরা খুঁজে খুঁজে দেখে, কার কবিতা ও গল্প শক্তিশালী, কার গান সুরেলা, কার অভিনয় প্রাণবন্ত; এরপর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের বিএনপি আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তাদের আওয়ামীলীগ বলে তকমা দিয়ে কালো তালিকা ভুক্ত করে। কাবাডি কাবাডি কাবাডি বলে স্টেজ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বুনো উল্লাস করে।

দ্বি-দলীয় রাজনীতির প্রতিভা হত্যা কার্যক্রমে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-অভিনয় জগতটি আজ ঊষর মরুভূমি। আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হিন্দুত্ববাদের সমর্থন আর বঙ্গবন্ধুর কসম মিশিয়ে এমন একটি রুদালি ধর্ম প্রচলন করেছে; যেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ করে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো ইভেন্টে’ গলায় গামছা দিয়ে ধরে আনা হয় শিল্পীদের। এটা অনেকটা শিল্প বাকশালে যোগদান করানোর মতো ব্যাপার। কেউ আসতে রাজি না হলেই তাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি তকমা দিয়ে; কালো তালিকায় তার নাম তুলে দেওয়া হয়।

বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এই ব্রেকিং নিউজ এলেই জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের পাণ্ডারা দৌড় দিয়ে ঢুকে পড়ে বিটিভির নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার কাঁচের বুথে। ঐখানে যে রবার্ট মুগাবেদের দেখা যায়; তারাই বেতার ও টেলিভিশন ভবনের দখল নিয়ে বেসুরো গান আর অভিনয়ের সুনামি বইয়ে দেয়।

ভারতের বুদ্ধিজীবী আম্বেদকার মনে করতেন, বৃটিশেরা ক্ষমতায় থাকলে দলিতেরা বৃটিশ আইনে কিছুটা হলেও অধিকার পাবে। বৃটিশ চলে গেলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দল কংগ্রেস দলিতদের অধিকারের প্রতি উদাসীন থাকবে। আম্বেদকারকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি ডেকে কালোতালিকাভুক্ত না করে কংগ্রেস তাকে আইনমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেছিল।

বাংলাদেশের কবি ফররুখ আহমেদ মনে করতেন, পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ভারতের আগ্রাসনে দরিদ্র মুসলমানদের জীবন অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পড়বে। এরকম ব্লাসফেমাস কথা বলায় আওয়ামীলীগ ফররুখ আহমেদকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি তকমা দিয়ে কালো তালিকাভুক্ত করে। অবশ্য কবি আল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস কলকাতায় থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে সক্রিয় থাকলেও; স্বাধীন দেশে বাকশালের বিরোধিতা করায় ও দাড়ি টুপি পরে জামায়াতের পত্রিকায় কাজ করায়; হিন্দুত্ববাদী প্রভাবিত আওয়ামীলীগের ক্ষুদ্র কবিরা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কৃতি এই কবিকে ‘রাজাকার’ তকমা দিয়ে দেয়।

এরশাদের মন্ত্রীসভায় থাকায়, এরশাদ পতনের পর আরেক প্রবাদ প্রতিম কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে টিএসসিতে ডেকে এনে এমনভাবে অপমান করে আওয়ামীলীগের মাজামরা ক্ষুদ্র কবি কতিপয়; যে বাসায় ফিরে উনি স্ট্রোক করে মারা যান।

এইভাবে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতটি দুর্বল কবিদের বুলবুলি আখড়াই-এ পরিণত হয়। আওয়ামীলীগের ফ্যাসিজমের সাড়ে পনেরো বছরে কৃতি থিয়েটার নির্দেশক মামুনর রশীদ, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, কৃতি অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী যেহেতু শেখ হাসিনার নব রত্ন সভায় যোগ দিয়েছেন; তাই জুলাই বিপ্লবের পরে তারা একরকমের কালো তালিকায় পড়ে গেলেন। এরা যদি শিল্প জগতে সক্রিয় থাকতে না পারেন; তাতে আসলে শিল্প জগতের ক্ষতি।

আওয়ামীলীগ কৃতি গায়িকা বেবি নাজনীন ও কনকচাপাকে কালো তালিকাভুক্ত করে রেখে যেভাবে সংগীত জগতটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে; যেহেতু ঐ দুজন শিল্পী বিএনপির সাংস্কৃতিক বলয়ে ছিলেন। এখন যদি আবার নাজনীন ও কনচাপার গানের বন্যা বইয়ে দিয়ে; রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী বন্যাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় তার আওয়ামীলীগ ঘনিষ্ঠতার কারণে; তাহলে ক্ষতির মুখে পড়বে সংগীত জগত।

আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, ক্যাডার, অনুগত পুলিশ, প্রশাসক, সেনাসদস্য হচ্ছে লাল পিঁপড়া। এদের কামড়ে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে; নানারকম ক্ষতি হয়। আর কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা হচ্ছে কালো পিঁপড়া। যারা চিনির ডিব্বার মুখে ভীড় জমায়; কিন্তু মানুষের ক্ষতি করার মতো বিষদাঁত তাদের নেই।

আওয়ামীলীগের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি করে মিলিয়ে অভিমত প্রকাশ না করায়; খান আতা, আমজাদ হোসেনের মতো চলচ্চিত্রকার ও শিল্পীদের কালো তালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সোনালি যুগের আলো নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। বিএনপির সমালোচনা করেন বলে অভিনেতা হাসান ইমামকে কালো তালিকাভুক্ত করা সংস্কৃতি জগতের ক্ষতিটাই বেশি করেছে।

যারা পারফর্মিং আর্টের সঙ্গে যুক্ত; যাদের পারফরম্যান্স সেরা; তাদেরকে বিচার করতে হবে তার শিল্পশৈলী দিয়ে। সে আওয়ামীলীগ নাকি বিএনপি এসব আলোচনা তার পারফরম্যান্সের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। ৫৩ বছর ধরে কালো তালিকাভুক্ত করতে করতে এখন যারা অবশিষ্ট আছে; তাদের গান-অভিনয়-কবিতা-গল্প সবই অত্যন্ত মিডিওকার। ফলে জনগণ নেটফ্লিক্সে ভারতের বলিউডের চলচ্চিত্র দেখে, ইউটিউবে কোক স্টুডিও পাকিস্তানের গান শুনে। রাজনীতির দুটি লালসালুর মাজার আর তাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির নামে ফইন্নি থেকে রুলিং অ্যালিট হবার যে সাপলুডু খেলা; তাতে লাভের লাভ তো কিছুই হয়নি; আমরা হারিয়েছি একটি সুষমামণ্ডিত সমাজ ও সংস্কৃতি।

৮৭ পঠিত ... ১৮:০৬, নভেম্বর ২০, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top