আলোচনাটা হবার কথা এই নিয়ে যে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে প্রতিটি নাগরিকের মাছ-মাংসের স্বাধীনতা নেই কেন। অল্প সংখ্যক মানুষের খাবার টেবিলে উপচে পড়ছে রাশি রাশি খানা খাজানা; আর বেশিরভাগ মানুষ বেঁচে থাকে খাদ্যের অনিশ্চয়তায়।
পৃথিবীর কুৎসিততম মিউজিক হচ্ছে দারিদ্র্যের অগমে-দুর্গমে মানুষকে অর্ধাহারে-অনাহারে রেখে রাষ্ট্রীয় ভোজ সভায় ভুরিভোজের কাঁটাচামচের টুংটাং আওয়াজ।
অথচ ৫৩ বছরে ক্ষমতামুখী রাজনৈতিক কথামালা, বুদ্ধিজীবীর কচকচানি, সংবাদপত্রের ট্র্যাশ উপসম্পাদকীয়, টিভি টকশোর উদ্দেশ্যহীন ভাটের আলাপ; কোথাও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিধেয়, মাথা গোঁজার ঠাঁই, মানবিক মর্যাদা, ন্যায় বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আলাপ নেই। কেউ কখনও এই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেনি; সামনে ঐ বছর থেকে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
নেটফ্লিক্সের ব্ল্যাক মিরর টেলিনাটকের মতো সমাজের চর্বিবহুল রুলিং এলিট, ট্রিকল ডাউন অ্যাফেক্টে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট খেয়ে মেদ বাড়ানো মিডল ক্লাস আর ঐ নিরন্ন মানুষের ধূসরতার নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন।
ঈশ্বর বসবাস করেন রাজনীতির লালসালুর মাজারে, জলপাই বাগানে, স্যারের বাথানে, দালালশালে, বাতাবি বনে আর বুদ্ধিজীবীদের এনজিওতে। সেইখানে আলাপ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় চেতনা, সংবিধান; এরকম এমন সব বিষয় নিয়ে; যার সঙ্গে মৌলিক মানবাধিকার ও কল্যাণরাষ্ট্রের দূরতম কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি গত ৫৩ বছরে।
বৃটিশ বিরোধী কৃষক প্রজা বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ; সেখানে মেহনতী মানুষ ঔপনিবেশিক শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনে; তারপর ফিরে গেছে প্রতিদিনের ভাতের লড়াইয়ে। বিজয় পায়ে হেঁটে চলে গেছে বিদ্রোহে, মুক্তিযুদ্ধে কথামালার বুলবুলি আখড়াই করা নব্য বুর্জোয়া শ্রেণীর পুষ্পশয্যার মধুচন্দ্রিমায়। মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের কথা বলে-স্বপ্ন দেখিয়ে শুধু ঢাকা ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে পাতলা ডাল খাওয়া যত লোক বুর্জোয়া হয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার ক্ষমতা জয় করেছে; অন্যান্য ইউনিভার্সিটির কথা নাই বা বললাম। ইউনিভার্সিটিতে হয়ত শেখানো হয়, কী করে স্বদেশী ঔপনিবেশিক হয়ে উঠতে হয়, কী করে অদৃশ্য সাবানে হাত কচলে রাজনীতির তেলাঞ্জলির মাজারে মাথা ঠুকে পদ-পদবী-প্লট-পদক বাগানো যায়।
ঢাকা শহরের প্লটের খতিয়ান নিয়ে কেউ যদি গবেষণা করে; বুঝতে পারবে; ব্ল্যাক মিররের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কেবল দালালি করে কে কীভাবে কখন প্লট বাগিয়েছিল। চোখে তাদের বৃটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকের শোষণ ও নিপীড়নের মাধ্যমে পাওয়া বিলাসী জীবনের ছবি ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই স্বদেশী সরকারি দালাল শ্রেণীর লোকেরা নব্য বুর্জোয়া হবার ইঁদুর দৌড়ে যোগ দেয়। যুদ্ধের বাজারে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার যে সাকসেস স্টোরি; সেটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কারিকুলাম হয়ে ওঠে।
ভাগ্যান্বেষী ভিক্ষুকেরা ইতিহাসের কোন বাঁকে নিজেদের গাত্রবর্ণের কারণে নিজেদের উচ্চবর্ণের দাবি করে; মানুষের শ্রেণি বিভাগ করেছিল; সেই উচ্চ বর্ণ বা এলিট হবার অশ্লীল স্বপ্নে বিভোর হয়ে কি করে গরিব মানুষের সিসটেমেটিক এথনিক ক্লেনসিং করতে হয়; সেই বিদ্যাটা রপ্ত করতে লোকে রাজনীতি ও প্রশাসনের ক্যাডার হয়, ব্যবসা ও মিডিয়ার কোলাবরেটর হয়।
বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোনো দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ধনাঢ্য হননি। স্বদেশী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বীরের নাটক থেকে ফিরে সরকারি কোলাবরেটর হয়ে সিসটেমেটিক জনগণহত্যায় উৎসাহী অনুতাপহীন লোকেরাই এদেশে ধনাঢ্য নামে পরিচিত।
জনজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন-বস্ত্র- বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা-মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারের আলোচনা উহ্য রেখে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামি চেতনার আলাপ, সংবিধান ও ফ্যাসিস্টাধিকার নিয়ে যে আলাপ; এসব ৫৩ বছর ধরে দেশলুণ্ঠনের গোপন মিশনটিকে অহেতুক মেদের আলাপে হৈ চৈ-এ ঢেকে রাখার কূটকৌশল।
এদেশে এফলুয়েন্স প্রদর্শনী, সংগীত ও সাহিত্যপ্রেমীর মুখোশ, পেলব ব্রান্মণ বা আশরাফ হবার যে ফাঁপা জীবনচর্যা; এইসব খেলনা আয়োজনে অনুচ্চারিত দেশের সিঙ্ঘভাগ মানুষের কথা। ফ্রিডেরিশে নিটশের সুপারম্যানের আলাপটাকে নাতসিরা তাদের ফ্যাসিজমের সিলেবাসে ফেলে যে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের মারণঘাতী সূত্র হাজির করেছিল; সেখানে আসলে নাতসিদের প্রবল ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সের এক্সরে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ সমাজে এই ইনফেরিয়রিটিকে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স দিয়ে প্রকাশের নিষ্ঠুরতম চিত্রটি বর্তমান। দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে যে কর্কশ আচরণ আমাদের নতুন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারা করে থাকে; পৃথিবীর আর কোনো সমাজে এরকম লক্ষ্য করা যায় না।
অন্যান্য সমাজে কৃষকের ছেলে রাজনীতিক হয়ে কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে, শ্রমিকের ছেলে আমলা ও ব্যবসায়ী হয়ে শ্রমিকের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে। গরিবের ছেলে এফলুয়েন্ট হয়ে গরিবদের জন্য ফিলানথ্রপি করে।
আর আমাদের সমাজে কৃষক-শ্রমিক-গরিবের ছেলে-মেয়েরা তার অতীত নিয়ে এত হীনমন্যতায় ভুগে যে; কৃষক-শ্রমিক-গরিব মানুষের সঙ্গে দ্বিগুন খারাপ ব্যবহার করে; নিজেকে জমিদারের নাতি-নাতনি পরিচয় দেয়; সেই জমিদারির ভূমির হিসাব করলে বাংলাদেশের আয়তন চীনের সমান হবার কথা। আরেকটি ট্রেন্ড রয়েছে, গরিবের ছেলে-মেয়ে নিজের চেষ্টায় এত বড় হয়েছে বলে; চারটে ফিচার পত্রিকায় প্রকাশ হলেই; এরপর তারা গরিবকে চড় দিয়ে বলে, এই তুই আমাকে স্যার না বলে ভাই-আপা বলছিস কেন!
জুলাই বিপ্লবের তারুণ্যকে সচেতন করার প্রয়োজনেই এরকম সমাজ বিশ্লেষণী তেতো আর্টিকেল লিখতে হয়। যাতে তারা বুঝতে পারে; ৫৩ বছর ধরে চলা এ শোষণ ও প্রবঞ্চনার অবসান ঘটাতে না পারলে; কেবল ক্ষমতা কাঠামোর চেহারা বদলে; বদলাবে না গরিব নিপীড়নের সংস্কৃতি। নতুন প্রজন্মের মনোজগতে সাম্যচিন্তা প্রবেশ না করলে; সভ্য সমাজ বিনির্মিত হবে না। বিংশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তি ব্যর্থ হয়েছে; সমস্ত ইজম নিক্ষিপ্ত হয়েছে আস্তাকুঁড়ে। ইজম আসলে একটাই, ওয়েলফেয়ারিজম। কারণ কল্যাণরাষ্ট্র তৈরি করা না গেলে সেটা কোনো রাষ্ট্রই নয়।
পাঠকের মন্তব্য