ইট'স ওভার

২৩৬ পঠিত ... ১৭:১২, অক্টোবর ২৭, ২০২৪

40

রংপুরে জামায়াতের হিন্দু শাখা গঠনের খবরটা নিয়ে ফেসবুকে যাদের ঠাট্টা তামাশা করতে দেখলাম; ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তারা হাসিনার ছাত্রগণহত্যা সমর্থন করে; ৫ আগস্ট রাত থেকে বৈষম্যবিরোধী বিপ্লবী ছাত্রদের ছিদ্রান্বেষণ শুরু করেছেন। এরপর ফটোশপ করে ড ইউনূসের মাথায় টুপি দিয়ে তরুণ উপদেষ্টাদের মাথায় টুপি পরিয়ে বাংলাদেশ ‘মৌলবাদীদের খপ্পরে’ এই ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা করছেন।

এর কারণ হচ্ছে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সমর্থিত আওয়ামীলীগ; বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ভোট ব্যাংক হিসেবে দেখেছে, পুলিশে নিয়োগ দিয়ে ঘাড়ে বন্দুক রেখে ইসলামোফোবিয়ার চানমারি করেছে; আবার মিডিয়ায় আওয়ামীলীগের ন্যারেটিভ প্রচারের কাজটি করিয়েছে তাদের দিয়ে। এতে বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্যালেস্টাইনের অসহায়ত্ব সৃষ্টি হলে; ডমিনো অ্যাফেক্টে তারা প্রত্যাঘাত করলে; তখন ‘বাংলাদেশে হিন্দু গণহত্যা’ বলে ভারতীয় মিডিয়ায় ন্যারেটিভ নির্মাণের চেষ্টা করে। মোদি ও হাসিনার ল্যাবরেটরিতে হিন্দু জনগোষ্ঠী নেহাত পরীক্ষা-নিরীক্ষার নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। হিন্দুদেরকে তাই বিএনপি বা জামায়াত করতে দেখলে; আওয়ামীলীগ ও বিজেপির মনে হয়; ওদের খেলার পুতুল কেন নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল বাছাইয়ে সক্ষম হবে।

বৃটিশেরা কোলাবরেটর হিন্দুদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর জমিদারি দিয়ে; তাদের ছেলেদের ইংরেজি ও বাংলা আধুনিক গদ্য শিখিয়ে ‘মুঘল-নবাবী-সুলতানী’ আমলকে অন্ধকার যুগ হিসেবে ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার হাতে খড়ি দেয়। বঙ্গভঙ্গের পরে এই ন্যারেটিভ নির্মাণ ইসলামোফোবিয়ার আধুনিক চেহারা পায়।

সেই ন্যারেটিভ তৈরির দক্ষতায় পূর্ব বঙ্গের হিন্দু জমিদার তনয়েরা কলকাতার সেকেন্ড হোমে বসে; মুঘল-নবাবী-সুলতানি আমলের মুসলমান সমাজের বাংলা-আরবি-ফার্সি সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে অশিক্ষা তকমা দিয়ে ‘নিম্নবর্গের হিন্দুরা মুসলমান’ হয়েছিল ন্যারেটিভ চালু করে। এই যে উচ্চ বর্গ বা আর্য বলে যারা দাবি করেন;  এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করলে দেখবেন; এরা আর্য নন। ন্যারেটিভের মাধুরীতে কল্পনায় আর্য সেজে গিয়ে তারা নিজেদের ভীষণ অভিজাত ভাবতে শুরু করেন। গালে সুপোরী পুরে গম্ভীর মুখে এমন ভস ভস করে কথা বলা রপ্ত করেন যে; তারা বৃটিশের কোলে বসে রেনেসাঁ এনে না দিলে; বাংলার মানুষ বুঝি গাছের পাতা পরে কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেত; ভাগ্যিস তারা আলো এনেছে। অথচ প্রত্ন অনুসন্ধানে পূর্ব বঙ্গে সমৃদ্ধ-সভ্য-সংস্কৃতি মনস্ক উদার মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের কোমল রুপ আকৃষ্ট করেছিল এই জনপদের প্রত্ন মানুষকে।

বৃটিশের সঙ্গে মিলে পূর্ববঙ্গের মানুষকে দলাই মলাই করে হিন্দু জমিদাররা; দুর্ভিক্ষে এক কোটি গনমানুষকে হত্যা করেছে ১৭৭০ -৭৬ সময়ে। সম্পন্ন কৃষককে ভূমিহীন করে; সম্পন্ন কারিগরের আড়ং ভেঙে দিয়ে তাদের দুঃস্থ করে ফেলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কলকাতায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষাবিদের নেতিবাচক মনোভাব ও সুইপিং কমেন্ট; মনোজগতের এক্সরে রিপোর্ট তুলে ধরে। পূর্ব বঙ্গের কৃষক প্রজা আন্দোলন সেই বৃটিশ সমর্থিত হিন্দু জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহ। এই হিন্দু জমিদারেরা চেয়েছিল পূর্ব বঙ্গসহ পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে। সে কারণে সোহরাওয়ার্দি ও শরতবসুর অখণ্ড বাংলা আলাদাভাবে স্বাধীন হবার প্রস্তাব সফল হতে দেননি; শ্যামাচরণ সহ সেকেন্ড হোমের জমিদার শ্রেণি। পাকিস্তানের নেতা জিন্নার এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না। সেটা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়। ‘কলকাতা আমাদের চাই’-এই মন্তব্য ছিল কংগ্রেস নেতাদের। তারা নেহেরুকে দিয়ে বোম্বেতে ঐ ঘোষণা দেওয়ান। ফলে ১৯৪৭ সালে এই বিখণ্ডিত বাংলা; পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ব ভারতের অংশ হয়ে পরাধীন দুটি জনপদ হিসেবে রয়ে গিয়েছিল।

পূর্ববঙ্গের মানুষ ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে ১৯৫২ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশের রুপকল্প তৈরি করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিম অংশের বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ আন্দোলনকে; কলকাতার সেকেন্ড হোমের ততদিনে কট্টর হিন্দুত্ববাদী হয়ে ওঠা লোকেরা জমিদারী পুনরুদ্ধার প্রকল্প হিসেবে দেখে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রিয় মানুষ ধারাবাহিক আন্দোলনের মাঝ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দ্বার প্রান্তে উপস্থিত হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও কিছু রাজনীতিকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে; বাংলাদেশকে ভারতের কৌশলগত সাহায্য নিতে হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা করে। তাদের সহযোগী ৮৫ হাজার দেশীয় রাজাকারের অপরাধ; ন্যারেটিভ মামাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির বিভাজন রেখা টানতে বেশ কাজে দিয়েছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৮৫ হাজার মানুষের রাজাকার হবার উপাত্ত; শেখ হাসিনাকে লাখো-কোটি জেন জিকে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলার দুঃসাহস দিয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া ও ভারতের পূর্ব দিকে শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান না থাকা; বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য উইন উইন সিচুয়েশান। কিন্তু ন্যারেটিভ মামারা বাংলাদেশকে সারাজীবন কৃতজ্ঞ করে রেখে ভারতের সেভেন সিস্টারস শাসনের ডোর ম্যাট হিসেবে একে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু এতে রাজি হননি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা এমনকি ১৯৯৬-০১ পর্বের হাসিনাকে দিয়েও তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ভারতের কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জি ২০০৮ সালে এই ডোর ম্যাট প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী মোদি ক্ষমতায় এলে; এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়; শেখ হাসিনা তখন ক্ষমতায় থাকার জন্য সিকিমের লেন্দুপ দর্জি হতেও এক পায়ে খাড়া।

২০০৯ থেকে ২০২৪ আগস্ট ৫ দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল সার্বভৌমত্বহীন এক ভারতীয় ছায়া উপনিবেশ। এটাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী দেবার আকাংক্ষা ন্যারেটিভ মামাদের ছিল। বাংলাদেশে এসে ফেলে যাওয়া ভিটের চিহ্নের সামনে কান্নাকাটি; একের পর এক দেশ বিভাগে দেশ হারানো হিন্দু জনগোষ্ঠীর ট্র্যাজেডি নিয়ে চলচ্চিত্র, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাহাদুরীর গল্প, স্পাই মুভিতে বাংলাদেশ ঢুকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার বাহাদুরীর মধ্যে দিয়ে ভারত এক খেলনা যুক্তরাষ্ট্র ও হলিউড হবার শখ হিসেবে নিজের শৌর্য বীর্য ডিসপ্লে করতে শুরু করে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু অভিজাত মুসলমান বাংলাদেশে এসে শুন্য থেকে জীবন শুরু করেছে; উত্তর প্রদেশ থেকে বহু অভিজাত মুসলমান পাকিস্তানে শুন্য হাতে গিয়ে জীবন শুরু করেছে। কিন্তু তারা ভারতে গিয়ে কখনও ফেলে আসা ভিটায় দাঁড়িয়ে কেঁদে সিনক্রিয়েট করেননি; উপন্যাস-চলচ্চিত্র কোথাও দেশান্তরী মুসলমানের জীবনের ট্র্যাজেডির কাহিনী নেই।  এরকম মানুষের মুখে শৈশবের সোনালী স্মৃতির কথা শোনা যায় ; ট্র্যাজেডির অংশকে তারা প্রগাঢ় করে না তুলে নিয়তি বলে উল্লেখ করেন। তিক্ত স্মৃতি চর্চা করে আরেকটি দেশ সম্পর্কে তিক্ততা প্রকাশকে তারা শোভন মনে করেননি।

আমি ভারতের কতিপয় ন্যারেটিভ মামাদের অনুরোধ করব; তিক্ত স্মৃতি রোমন্থন করে; মনটাকে তেতো না করে; হৃদয়ের পরিচর্যা করুন। এই কলকাতাতেই নতুন প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে দেখুন; তারা আনন্দভুক। তারা ধর্মীয় বিদ্বেষ, অপর দেশ বিদ্বেষ, খেলনা দাদাগিরি, মিথ্যে গুজব বানিয়ে হাস্যকর করে তোলার মতো আনস্মার্ট বিষয়গুলো একদম পছন্দ করেন না।

২০০২ সাল থেকে জার্মানির ডয়চেভেলেতে কাজ করার সূত্রে ভারত-পাকিস্তানের সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী-কবি ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের অগ্রসর শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব চোখে পড়ার মতো। ক্ষমতা-কাঠামোর শত্রু শত্রু খেলাটাকে তারা অসূয়া বলে আক্ষেপ করেন। কিছু আউট ডেটেড লোকের ধর্মীয় বিদ্বেষ ও লোকজ হিংসার বলি এই দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্ক।

আর ২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বন্ধুভাবাপন্ন মানুষের মাঝে গভীর ভালোবাসা ছিল। প্রণব ও মোদির ষড়যন্ত্রে আর হাসিনার ফাঁপা বুদ্ধিতে অযথা সম্পর্কগুলোতে মালিন্য এল। এসব আউটডেটেড চিন্তার অচলায়তনকে অস্বীকার করে ধর্ম-গোত্র-খেলনা সুপিরিয়রিটির কল্পনার বিভাজনকে অগ্রাহ্য করে; বন্ধুত্বে ফিরতে হবে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে। সমমর্যাদা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার বন্ধুত্বের চেয়ে বড় আনন্দপ্রদ অভিজ্ঞতা আর কিছুই হতে পারে না।

 

২৩৬ পঠিত ... ১৭:১২, অক্টোবর ২৭, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top