ড. ইউনূস জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তরুণ-তরুণীদের মঞ্চে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় জুলাই বিপ্লব সম্পর্কে বলেছেন, এভ্রিথিং ওয়াজ পারফেক্টলি প্ল্যানড।
ওমনি আফসোস লীগের সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদা ‘এভ্রিথিং ওয়াজ পারফেক্টলি প্ল্যানড’ বাক্যাংশটিকে ঘাড়ে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছেন। ঐ যে শৈশবে পড়া গল্পে দুটি গ্রামের মানুষের জ্ঞান প্রতিযোগিতায় গোপালগঞ্জ গ্রামের লোক বুদ্ধি করে চাটগাঁ-র লোককে জিজ্ঞেস করেছিলো, বলুন দেখি, আই ডোন্ট নো মানে কী! চাটগাঁর লোক উত্তর দেয়, আমি জানি না। অমনি গোপালগঞ্জ গ্রামের লোকেরা চাটগাঁ জানে না জানে না বলে ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজিয়ে বিজয় মিছিল করে।
‘এভ্রিথিং ওয়াজ পারফেক্টলি প্ল্যানড’ এই বাক্যটির মধ্যে তারা খুঁজে পেয়েছে; তেমনি এক ঐ যে কইছিলাম না-র আনন্দ। ভারতের রিপাবলিক বাংলার উত্তেজিত উপস্থাপক ময়ূখ এই সদা উত্তেজিত সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদার প্রতিবিম্বিত প্রতিরুপ।
প্ল্যান বলতে গোপালগঞ্জের লোক বুঝে, ওয়ান ইলেভেনের সেনা সর্দার মইন উ-কে দিল্লিতে ডেকে ঘোড়া উপহার; প্রণব মুখার্জি গালে সুপোরি পুরে মইন উ-কে বুঝিয়ে বলা, হাসিনাকে ক্ষমতায় আনলে তুমি সেনাপ্রধান হিসেবেই রিটায়ার করে; সেইফ এক্সিট পাবে; তখন এমেরিকায় গিয়ে মনের আনন্দে বিড়ি ফুঁকবে দাদা। এরপর ২০১৪ সালে ভারতের সুজাতা সিং এসে ছোট স্বৈরাচার এরশাদকে বড় স্বৈরাচার হাসিনার গৃহপালিত বিরোধী দল হতে বাধ্য করা, আর ভারতে মোদি ক্ষমতায় এলে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র হাতে নিয়ে বাংলাদেশে গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে সেভেন সিস্টারস শাসন। হাসিনাকে সিকিমের লেন্দুপ দর্জির ভাস্কর্য রুপে গড়ে তোলাটাকেই প্ল্যান বলে বুঝে থাকে সহমত-শিবব্রত-ললিতা দর্জিরা।
সে কারণেই তারা ইউনুসের ‘এভ্রিথিং ওয়াজ পারফেক্টলি প্ল্যানড’ বাক্যের মধ্যে এতো হাকালুকি খুঁজে পেয়েছে। সারাজীবন এই ভূতের আলোর পিছে দৌড়ে আওয়ামী লীগ কখনো বাংলাদেশের মানুষের মন বুঝতে পারেনি; যে মন চাঁদের টানে নদী ও সমুদ্রের জোয়ার ভাটার মতো পরিবর্তনশীল। যে মন কখনোই কোন পরাভব মানেনি।
জুলাই বিপ্লবের যে কারিগর জেন জি; তারা সহমত ভাই বা শিবব্রত দাদার মতো খারাপ ছাত্র বা মুখস্থ ইতিহাসের দাস নয়। জেন জি গোপালগঞ্জ গ্রামের মাতবরতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে; জন আকাংক্ষাকে বুঝতে চেষ্টা করেছে। ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ভারতের বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগের লক্ষ্মণরেখা পার হয়ে; বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অনুসন্ধান করেছে। এই প্রজন্ম স্টাডি সার্কেল ও ডিবেট মুভমেন্টের মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুত করেছে। যে কারণে গণমাধ্যমে প্রতিটি ইন্টারভিউতে প্রতিটি তরুণ তরুণী স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছে। আর এর বিপরীতে স্বৈরশাসকের মিডিয়া ও কালচারাল ফুটসোলজাররা; বহু ব্যবহারে জীর্ণ শব্দ নিয়ে আঁ উঁ করে ফাম্বলে জর্জরিত করেছে প্রতিটি বক্তব্য। এইখানে জেন জি'দের প্ল্যানড ও প্রিপিয়ারড বুদ্ধিবৃত্তির কাছে হেরে গেছে আনপ্ল্যানড ও আনপ্রিপিয়ারড আওয়ামী জেনেরেশান।
সমর কৌশল বিদ সান জু বলতেন, প্রতিপক্ষকে কনফিউজড করে দিতে পারলে তারা কখনোই তোমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে না। জেন জি'রা ঠিক সেটাই করেছে। আওয়ামী লীগের এককেন্দ্রিক আপা নেতৃত্বের বিপরীতে বহু কেন্দ্রিক নেতৃত্ব রচনা করেছে। আর সহমত ও শিবব্রতের ভ্যাজর ভ্যাজর যেখানে ফেসবুক কেন্দ্রিক; সেখানে জেন জি'রা ছিলো ইনস্টাগ্রামে; হোয়াটস এপ গ্রুপে ও টেলিগ্রামে। আবার ভার্চুয়াল যুগে ভূমি বাস্তবতায় মিলিত হয়ে স্টাডি সার্কেলের ইন্টার পারসোনাল যোগাযোগে তারা তথ্য ও বোধ বিনিময় করেছে।
গোটা পৃথিবীর জেন জি'দের নিজস্ব ভাষা, দর্শন আছে। ফলে সুইডেনের পরিবেশ বিপ্লবী গ্রোয়েটে থুনবার্গ কিংবা এমেরিকার আই ভি লীগ ও হার্ভাডের জেন জি-দের প্যালেস্টাইন গণহত্যা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের জেন জি'দের আন্দোলন কৌশলের মিল হচ্ছে তাদের অন্তর্গত অনুরণন। পার্থক্যের জায়গা একটাই সুইডেন বা এমেরিকায় হাসিনার মতো খুনে শাসক নেই; ফলে পাখির মতো গুলি করে মারা হয়নি সেখানকার জেন জি-দের।
শেখ হাসিনার প্রশাসন ও পুলিশ ছিলো বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো কর্কশ শৈশবের লোকজন নিয়ে। ফলে তারা এতোটা নৃশংস হতে পেরেছে জুলাই বিপ্লবের শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রতি। আর হাসিনার পলিসি মেকার মানেই মিডিওকার ও অযোগ্য আসাদুজ্জামান কামাল, আরাফাত, পলক, হারুন,মনির; ফলে তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন প্রস্তুত জেন জি প্রজন্ম তাদেরকে অনায়াসে ফেলে দিয়েছে। যে অন্য কোন কাজ না পেয়ে টেনেটুনে পাশ সাংবাদিকগুলো হাসিনার প্রোপাগান্ডার দায়িত্বে ছিলো; যে থার্ড ক্লাস সংস্কৃতি মামা ও খালারা মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও ফেসবুকে গান্ধা করে দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো; তারা দাঁড়াতেই পারেনি জেন জি'দের মিম, কার্টুন-ক্যারিকেচার, সংগীত, চিত্রকলা, গ্রাফিতি, দেয়াল লিখনসহ আন্দোলনের নানা শৈল্পিক কৌশলের সামনে।
জেন জি বনাম আওয়ামি চাওয়াজি প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো অনেকটা ফ্রান্সের সঙ্গে ফরাশগঞ্জের ফুটবল খেলা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ম্যাচের মতো। কোন তুলনাই হতে পারেনা দুটি পক্ষের মেধা ও দক্ষতার।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর; জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রধান সমস্যা বুঝে পরিবার পরিকল্পনার আহবান জানিয়েছিলেন। সেই আহবানে সাড়া দেননি যারা তাদের সন্তানরাই দুর্ভাগ্য জনকভাবে গত পনেরো বছর আওয়ামী লীগের নৌকায় বসে দেশ ডাকাতি, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। ফলে প্ল্যান শব্দটি তদের কাছে অজানা। এ কারণেই ড ইউনুসের মুখে প্ল্যানড শব্দটা শুনে আনপ্ল্যান্ডেরা চোখ টেপাটেপি, চিমটি কাটাকাটি করে ক্ষমতা হারানোর ব্যথা উপশমের চেষ্টা করছে। আসলে মাথায় সারাক্ষণ চুরি-চামারির প্ল্যান নিয়ে ঘুরলে জীবনটা এরকম আনপ্ল্যানড আফসোসের দিনরাত্রিতে পরিণত হয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন