আওয়ামী লীগের রাজনীতি হচ্ছে প্রতিপক্ষকে অচ্ছুত বা অস্পৃশ্য করে দেওয়া। বলাই বাহুল্য এই রাজনৈতিক কৌশল কট্টর হিন্দুত্ববাদী মানসের কাছ থেকে ধার করা। বেগুণী মুখমণ্ডলের পেট মোটা কুঁজো একটি লোক যেমন নিজেকে আর্য দাবি করে; সুঠাম সুদর্শন পরিশ্রমী মানুষদের দলিত বা নিম্নবর্গের বলে তকমা দিয়ে কথিত কাস্ট সিস্টেম চালু করেছিল; আওয়ামী লীগের রাজনীতি হুবহু ঐ নিজের অযোগ্যতা ও হীনমন্যতা ঢাকতে যোগ্য ও সুপিরিয়রদের আনটাচেবল করে দেওয়ার রাজনীতি।
অমিত শাহর মতো ব্যাং মুখমণ্ডলের লোকটি যেরকম বাংলাদেশের মানুষকে উঁইপোকা বলে নিজের ইনফেরিওরিটি ঢাকতে চায়। শেখ হাসিনার ঠিক তেমনি স্বভাব। প্রতিপক্ষ বলে স্মার্ট ও সুন্দরী খালেদা জিয়াকে তিনি অত্যন্ত আপত্তিজনক কথা বলতেন। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন বলে পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট লোক বলে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়া ড. ইউনূসকে তিনি আজে বাজে কথা বলেছেন স্বচ্ছন্দে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নেওয়া সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার দল বিএনপিকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির তকমা দিয়ে আনটাচেবল করে দিতে চেষ্টা করেছিলেন হাসিনা। টিভি টকশোতে দেখবেন বিএনপির প্রমিত উচ্চারণের স্মার্ট নারী-পুরুষ অংশ নেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অপ্রমিত গোপালগঞ্জ ডায়ালেক্টের নারী-পুরুষ এসে বড্ড উচ্চ বর্ণের সেজে বসে থাকত। অথচ আওয়ামী লীগের পাংশু সংস্কৃতি মামা-খালার কন্ঠে সারাক্ষণ কালচারাল সুপিরিওরিটির গাল গল্প।
পূর্ববঙ্গের পাল-সেন-সুলতানি-মুঘল-নবাবী আমলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সর্বধর্ম ও সংস্কৃতির বিকাশ আওয়ামী লীগকে আকৃষ্ট করেনি। তারা বৃটিশ আমলে বংকিম চন্দ্রের বিভাজন উন্মুখ হিন্দুত্ববাদে আকৃষ্ট হয়েছে; যা বাঙ্গালী মুসলমানের বাঙালি পরিচয় কেড়ে নিয়ে তাকে নিম্নবর্গের মুসলমান হিসেবে চিত্রায়িত করেছে।
বংকিমের আঁকা এই বিভাজন উন্মুখ হিন্দুত্ববাদকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যে কারণে দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদীর দোর্দণ্ড প্রতাপের প্রতিকূল পরিবেশে তার কট্টরপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গবাসী। কিন্তু আওয়ামী লীগের অদ্ভুত হনুমানের পিঠে চড়ে বাংলাদেশে মোদি রোপণ করেছিলেন কাল্পনিক সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের বিষবৃক্ষ।
সেই মোদি প্রকল্পের কালচারাল হেজিমনি আর কিছুই নয়; স্ট্রেট কাট ইসলামোফোবিয়া। মোদির শিবসেনা বাংলাদেশে শিবির নিয়ে রগড় করে নিজেকে প্রগতিশীল প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের স্বঘোষিত প্রগতিশীল নারী-পুরুষের লাইফ স্টাইল কালচারালি ব্যাকওয়ার্ড হিন্দুত্ববাদীদের জীবন চর্যা। বিজেপির লোকের সাজ পোশাকের সঙ্গে আশ্চর্যজনক সাযুজ্য তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের লোকের সাজপোশাকে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি রাজাকার তালিকা দিয়েছিল। এরপর তা প্রত্যাহার করে; কারণ সেখানে বড় সংখ্যক আওয়ামী লীগ সদস্যের নাম ছিল।
প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতকে আনটাচেবল করে দিতে ‘রাজাকার’ তকমাটিকে ব্যবহার করতে করতে শেখ হাসিনা নিজেই মোদির কোলাবরেটর হিসেবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেন। তবু হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের দোসরদের কোনো লজ্জা হয়নি। তারা এমন ভঙ্গিতে এখনও রাজাকার শব্দটি নিয়ে রগড় করে; এজ ইফ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গত সাড়ে পনেরো বছরে প্রণব মুখার্জি ও মোদির রাজাকার হিসেবে নানা কুকীর্তি করতে দেখেনি তাদের।
বাংলাদেশের মানুষ স্বজাতির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের কখনও ভুলতে পারে না। সে কারণে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত যতই ভালো মানুষ সেজে আসুক; মানুষ তাদের গ্রহণ করে না। কখনও তাদের ভোট দুই তিন শতাংশের ওপরে ওঠে না। কিন্তু জামায়াতকে নিয়ে রগড়ের যোগ্যতা আওয়ামী লীগ হারিয়েছে গত সাড়ে পনেরো বছরে স্বজাতির বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ করে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জামাতের ধর্ম চেতনার পুলিশিকে যেমন অপছন্দ করে; একইরকম অপছন্দ করে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুলিশি। জামায়াত ইসলামি চেতনার মৌল আদর্শ থেকে বিচ্যুত; আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৌল আদর্শ থেকে বিচ্যুত। ফলে বাংলাদেশ সমাজে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ উভয়েই ট্যাবু হয়ে গেছে। এই পরিচয় কখনোই গর্বের হতে পারে না।
৫ আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগের পতনের নায়ক হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের গান্ধা করে দিতে মানবতাবিরোধী অপরাধী এই লীগের সমর্থকেরা প্রতিদিন সক্রিয়। ভারতের গদি মিডিয়ার যে ন্যারেটিভ, কথিত হিজবুত তাহরীর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছে; সেই মিথ্যাটাকে এক লক্ষ বার বলে সত্য প্রমাণের মিশনে নেমেছে হিন্দুত্ববাদী প্রণোদিত আওয়ামী লীগ।
ভারতে ২০১৪ সাল থেকে জনপ্রিয় ভোটে ক্ষমতায় মৌলবাদি বিজেপি দলটি। অথচ সেই মৌলবাদী দলের মিডিয়া ও শিবব্রত দাদারা বাংলাদেশকে মৌলবাদী দেশ হিসেবে তকমা দিয়ে আনটাচেবল করে দিতে মরিয়া। সহমত ভাইয়েরা বাংলাদেশে বিজেপির মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয়।
২০২৪-এর বিপ্লবের ইতিহাস ১৯৭১ কিংবা ১৯৪৭ সালের ইতিহাস নয় যে; সুদূর অতীতের ঘটনা আমরা স্বচক্ষে দেখিনি বলে মুনতসির মামুন কিংবা বংকিম চন্দ্রের মুখের দলীয় ঝাল খেতে হবে। ২০২৪ আমাদের চোখের সামনে গড়া একটি ইতিহাস; যা গোটা বিশ্বে আলোচিত ও দৃষ্টান্ত হিসেবে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপিত। আমরা দেখেছি; কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গোটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে আলোড়িত করেছে; কীভাবে আবাল বৃদ্ধ বণিতা পথে নেমেছে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে। মোদির ফ্রাইংকেস্টাইনকে মোদির কাছে ফেরত পাঠিয়ে তবেই সাধারণ মানুষ ঘরে ফিরেছে। এস এম সুলতানের চিত্রকলার সেই পেশী বহুল মানুষকে জীবন্ত রুপে আমরা আওয়ামী রাক্ষসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখেছি। কথা ক ও আওয়াজ উডার আহবানে গোটা বাংলাদেশ চিৎকার করেছে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের দাবিতে সেই আর্তনাদে স্বৈররাক্ষস ভয় পেয়ে মোদি রাক্ষসের কাছে ফিরে গেছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন