খাগড়াছড়িতে মামুন নামে এক যুবককে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করার প্রেক্ষিতে; বিষয়টিকে পাহাড়ি বনাম বাঙালি সংঘাতে রুপ দিয়ে পাহাড়িদের বাড়ি-দোকানে হামলা করে ও আগুন দিয়ে ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে; ঘরছাড়া হয়েছে অনেক পাহাড়ি।
৫ অগাস্টের পর থেকে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেবার গণপিটুনিতে হত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় খাগড়া ছড়িতে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে আরো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জলকেও চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি রাজধানীতে ঘটায়; নাগরিক সমাজের জোর দাবির মুখে তোফাজ্জল হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু রাজধানী থেকে দূরে মামুনের হত্যাকাণ্ডটি সম্পর্কে নাগরিক সমাজের কোন প্রতিক্রিয়া ছিলো না। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন সক্রিয়তা ছিলো না। সেই সুযোগে বিভাজন ও বিদ্বেষ উন্মুখ মব বিষয়টিকে পাহাড়িদের পিটুনিতে বাঙালি হত্যা; অতএব পাহাড়িদের ওপর প্রতিশোধ; এরকম আদিম পরিস্থিতিতে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবেশী একটি রষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে বিচ্ছিন্নতাবাদী সক্রিয়তাকে ইন্ধন দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গতানুগতিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পাহাড়িদের মনোজগতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। বিচ্ছিন্নতাবাদ শব্দটি শুনলেই রাষ্ট্র এর স্বাভাবিক বোধ হারিয়ে পেশী শক্তির মাধ্যমে তা নির্মূল করতে থাকে। এই হুব্রিস বা হামারশিয়া মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বিস্তৃত করে।
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায়; প্রতিবেশী রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেবার জায়গা থেকে খানিকটা সরে আসে। ফলে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে আমাকে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এই জনপদকে দেখে মনে হয়েছে; বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বল প্রয়োগ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মদদ প্রয়োগে পাহাড়িদের মনোস্তত্বে গভীর বেদনা ও বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সেই জায়গাতে স্পর্শকাতরতা ও ভালোবাসা নিয়ে বিভাজন ও বিদ্বেষ নিরাময়ে কাজ করা প্রয়োজন ছিলো।
বাংলাদেশের আয়তন মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল। ফলে এইখানে কোন একটি অঞ্চলকে কেবল একটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত রাখার ধারণা একটি ইউটোপিয়া। সেক্ষেত্রে যে বাঙ্গালিরা পাহাড়ে বসবাস শুরু করেছেন; তাদের ঐ এলাকার ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন থাকা প্রয়োজন। বাঙ্গালিরা ইউরোপে বা এমেরিকায় বসবাস শুরু করলে সেখানকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি যে রকম সচেতনতা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। কেউ যদি ইউরোপে কিংবা এমেরিকায় গিয়ে তাকে ইসলামি বা হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতিতে রুপান্তরের চেষ্টা করে; তবে তা হবে নেহাত নির্বুদ্ধিতা।
অন্যদিকে পাহাড়িদের মধ্যে রক্ষণশীল একটি গোষ্ঠী রয়েছেন; যাদের মধ্যে একটি ছদ্ম শ্রেষ্ঠত্বের ভুল ধারণা রয়েছে। এশিয়ার বৌদ্ধিক সংস্কৃতি হোক, হিন্দু সংস্কৃতি হোক, আর ইসলামি সংস্কৃতি হোক; তার যেমন সুন্দর বৈশিষ্ট্য রয়েছে; আবার মায়ানমার, ভারত ও আফঘানিস্তানে সংস্কৃতিগুলোর কট্টর ও অশুভ চেহারা রয়েছে। কাজেই এই তিন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের কাল্পনিক সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত অধ্যাস শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য ক্ষতিকর।
পাহাড়ে পাহাড়ি ও বাঙালি সেন্টিমেন্টের সংঘাত; আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি উপকার দিয়েছে। নিজের দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নিধন করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে আবির্ভূত হয় সেকুলারিজমের রক্ষা কর্তা হিসেবে; আর তার কোলে বসে বিভাজন ও বিদ্বেষের খড়ের গাদায় আওয়ামী লীগের ম্যাচের কাঠি ফেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে কথিত সংস্কৃতি মামা ও খালারা যারা ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থক হিসেবে সক্রিয় ছিলো। তারা গতকাল তোফাজ্জলের জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়েছে; কিন্তু মামুন তাদের কাছে ছিলো অপর বা আদার; আজ আবার তারা পাহাড়ের জন্য কাঁদছে। অথচ এই রুদালিরা নামমাত্র একটি শান্তিচুক্তি করে তা বাস্তবায়ন করেনি। ৯৭-০১, ২০০৯-২৪; দুই মেয়াদের দুই দশক সময় পেয়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করেনি; উপরন্তু পরিবেশ বিনাশী হোটেল-রিসোর্ট-অবকাঠামো নির্মাণ করেছে; সংস্কৃতি মামা-খালাদের কাছে পাহাড় বিক্রি করেছে।
পাহাড়ের মানুষের সংস্কৃতিতে ভূমি নিবন্ধনের ধারণা প্রচলিত ছিলো না। কাজেই শান্তি চুক্তির পরে তাদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি ছিলো। বাঙালি অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করে; পাহাড়ের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানানসই জনমিতি রক্ষায় উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজনীয় ছিলো। যত্র তত্র মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ করে ইসলামাইজেশন বন্ধ রাখতে হতো। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মদদ বন্ধ করতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পুনর্বাসনের কাজটি যত্নের সঙ্গে করা আবশ্যক ছিলো। পাহাড়ের খুফিয়া কর্মকাণ্ড বন্ধে পাহাড়ি সমাজের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হতো।
সাম্প্রতিক ঘটনার প্রথম ক্রিয়া বাঙালি হত্যা ও প্রতিক্রিয়া পাহাড়ি হত্যা, হামলা, আগুনের গর্হিত অপরাধগুলোকে তদন্ত করে দ্রুত বিচারে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নিরপেক্ষতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে পাহাড়ি ও বাঙালি উভয়কে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বিবেচনা করে; তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পার্বত্য জেলা তিনটিতে দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরি নয়; জনসেবা করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পানিশমেন্ট পোস্টিং-এর ভাগাড় করে না রেখে প্রত্যেক ক্যাডারের মেধা তালিকার প্রথম দিকের সদস্যদের সেখানে পোস্টিং দিতে হবে। কনফ্লিক্ট নিরসন দুর্বল ছাত্রের কাজ নয়।
আর পতিত স্বৈরাচারের যে দোসরেরা ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা হত্যার সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সম্মতি উতপাদন করেছেন ও ফেসবুকে ক্যানিবাল হিসেবে নিজেকে সুচিহ্নিত করেছেন; তাদের কুম্ভীরাশ্রু ও অফুরান আফসোসের উদ্দেশ্য ম্যাজিক সলিউশনে খুফিয়া মুভির মতো আপাকে ফিরিয়ে আনার বারিধারা। আমার মনে হয় তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।
যারা ১৫ জুলাই থেকে আজ অবধি প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন; তারাই মানবিক বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা যারা বিভাজন নয়; ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষিত; মানুষকে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-পাহাড়ি-বাঙ্গালি এরকম একচোখে পৃথিবীকে না দেখে দুই চোখে পৃথিবীকে দেখেন। তৃতীয় চোখ দিয়ে মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে ভালোবাসেন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন