আবরার হত্যাকাণ্ড যেভাবে বুয়েটকে খুনির আখড়া হিসেবে পরিচিত করেছিল; বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড যেভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে খুনেদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি দিয়েছিল; তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কসাইখানার পরিচিতি দিল।
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে; তাদের মাঝে এত অল্প বয়সে এরকম হিংস্রতা, হত্যাতৃষ্ণা থাকে কীভাবে! এরকম অস্বাভাবিক খুনি কী করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের মাঝে বসবাস করে!
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের দলীয় ফুটসোলজার বানিয়ে হত্যা-রিরংসার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; তা দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ও হত্যা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; দুই নেত্রীর বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা ঠিক তেমনই।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ছুঁতো ধরে হাসিনা ও খালেদার এই হত্যা প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাজ করতে শুরু করে।
হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় কিলিং স্কোয়াডের নেতৃত্ব দেয়; আর খালেদা ক্ষমতায় থাকলে সে স্কোয়াডের দায়িত্ব পায় ছাত্রদল। সাধারণ ছাত্ররা কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের বীরপুঙ্গবদের সদলবলে পাছা দুলিয়ে হেঁটে যাওয়া। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতা হলেই মঙ্গার দেশের ছেলেগুলো ফ্রিতে মোরগা মোসাল্লাম খেয়ে বেশ নধর গোলগাল হয়। তাদের মধ্যে তখন ষড়রিপু খেলা করে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য।
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল নেতাদের এই দাপট ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের লোভ জাগায় সাধারণ ছাত্রদের অনেকের মাঝে। কিন্তু সুযোগের অভাবে মেনিমুখো হয়ে থাকে। খুন-জখম-নৃশংসতাকে গত সাড়ে পনেরো বছরে পতিত স্বৈরশাসক এতই স্বাভাবিক আর লাইফ স্টাইলের অংশ করে তুলেছেন; যে ব্যাপারটা কিছুই নয়; এমন জনমনস্তত্ব তৈরি হয়েছে। এটা একটা সামাজিক মনোবৈকল্য; এই বৈকল্য এখন বাংলাদেশ সমাজে সবচেয়ে ঝুঁকির জায়গা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনীতে এক ছাত্রলীগ কর্মী শামীম মোল্লা হত্যা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে হত্যা ভয়াবহ এক সমাজ মনস্বত্বের চিহ্ন।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে; সাড়ে পনেরো বছর ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানো ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিণতি দেখেও কেউ শিক্ষা নিলো না যে; মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি পেতেই হয়। বাংলাদেশ সমাজের এই একটি বিষয় বুঝতে বেশ অসুবিধা হয়। চোখের সামনে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেখেও; আওয়ামী লীগ তা থেকে কোনো শিক্ষা নিলো না। আর চোখের সামনে মানবতা বিরোধী আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার হতে দেখেও সাধারণ মানুষ কোনো শিক্ষা নিলো না।
বাংলাদেশ সমাজের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে সিলেক্টিভ মানবতাবাদ। গত সাড়ে পনেরো বছর গুম-ক্রসফায়ার সবশেষে ছাত্র গণহত্যা দেখে যারা হত্যার উস্কানি দিত; হত্যার সম্মতি উৎপাদন করত; তারা তোফাজ্জলের জন্য কাঁদছে। তোফাজ্জলকে হত্যার আগে ভাত খাওয়ানো হয়েছিল বলে; আজ ভাত খেতে চাইছে না আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের সতত সমর্থকেরা।
আবার স্বৈরাচার পতনের পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচা সাধারণ জনগোষ্ঠীর অনেকে ৫ আগস্ট পরবর্তী হত্যা ও নৃশংসতাকে তেমন কিছু মনে করছে না; যারা অসংখ্য স্বজন-বন্ধু হত্যার রক্তের নদী পেরিয়ে আজকের এই অপেক্ষাকৃত স্বাধীন সময়ে বসবাস করছেন।
এই সিলেক্টিভ বেদনা ও আনন্দবোধ; সমাজে হত্যাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। লীগের কাছে একটা করে শিবির ধর সকাল বিকাল নাস্তা কর স্বাভাবিক; আবার ছাত্র শিবিরের কাছে একটা করে ছাত্রলীগ ধর, রগ কেটে হত্যা কর স্বাভাবিক। আর বিএনপি হত্যাকে তো আওয়ামী লীগ ফরজ করে তুলেছিল। বিএনপির কাছেও আওয়ামী লীগ হত্যা ফরজ; চোখের বদলে চোখ নীতিতে।
যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ ও বিচার আদায় করতে শিখবে না সমাজ; ততক্ষণ পর্যন্ত এই সিরিয়াল কিলিং থামবে না। দেশে অনুশীলিত জঙ্গলের আইনকে নিশ্চিহ্ন করে; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সামষ্টিক মনোভঙ্গি তৈরি না হলে; প্রতিটি মৃত্যু কেবল এক একটি সংখ্যা হয়ে রয়ে যাবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন