স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত; এই দুটি দলকে সবচেয়ে প্রবলেমেটিক মনে হয়েছে। কারণ এই দলদুটির মতাদর্শিক কচকচানিটা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি।
এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামি চেতনার দোকান খুলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি অনুষঙ্গকে বিষাক্ত চেহারা দিয়েছে।
লীগ ও জামায়াতের সাংগঠনিক ক্ষমতা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। কারণ এদের নেতা ও কর্মীরা রাজনীতিতে ফুল টাইমার। বাংলাদেশ ছোটো দেশ; এখানে সবাই সবাইকে চেনে। ফলে একটু অনুসন্ধান করলে দেখবেন; ১৯৭০ সালে যারা দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত ছিলেন; একটু ভ্যাগাবন্ড গোছের; গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারে, সেজেগুজে পাছা দুলিয়ে গ্রামময় হেঁটে বেড়াতে পারে; ওপরে ভালো মানুষের লেবাস থাকলেও ভেতরে একজন খুনি ও অনুতাপহীন মানুষ কিলবিল করে; তারা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়ে আর ১৯৭৫ সালের প্রতিবিপ্লবের সওদা করে ছোটোখাটো জমিদার হয়ে ওঠে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের পর অন্যের পাকা দালান দখল করে বাবু ও সাহেব সেজে ওঠে লীগ ও জামায়াতের নেতা।
এরা দুটি বিপ্রতীপ দল হিসেবে একে অন্যের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করেছে। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন প্রতিটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্যসেবা-শিক্ষার অধিকার পূরণের লক্ষ্য কোনো উদ্দেশ্য এই দল দুটির কর্মসুচিতে নেই।
এদের কাজই হলো, মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও বিপক্ষের এবং সহি মুসলমান ও কাফের এরকম বিভাজিত করে রাখা; যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায়িত না হতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংক-ব্যবসা দখল করার ক্ষেত্রে এই দুটি দলের লোকেরা এগিয়ে আছে।
এরশাদ আমলে ও ১৯৯১-৯৬ খালেদা শাসনামলে এই দলদুটির যূথবদ্ধতা লক্ষ্য করা গেছে। ৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা মাথায় কালো কাপড় বেঁধে ইসলামি চিহ্নকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেন। মনে করে দেখুন সেই থেকে ধীরে ধীরে হিজাব জায়গা করে নিতে শুরু করে সমাজ মনোজগতে।
আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সমস্যা হচ্ছে; এরা ক্ষমতা হাতে পেলে নাতসি ধারার রাজনীতি প্রকট করে তোলে। ২০০১-০৬ বিএনপির সঙ্গে যৌথ সরকারে জামায়াত কথিত বাংলা ভাইয়ের মাধ্যমে শরিয়াহ আইন প্রচলনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। যথারীতি বাড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। জামায়াতের রাজনীতির সমস্যা হচ্ছে সে জনগণকে বাস্তব জীবনের সংকট নিরসরে করণীয় কী তা না বলে, অস্পষ্টভাবে খেলাফতের ইউটোপিয়াতে নিয়ে যায়। মহানবীর সিম্বলকে সে ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যবহার করে।
২০০৯-২৪ (অগাস্ট ৫) শাসনামলে আওয়ামী লীগ নাতসি ধারার রাজনীতি প্রকট করে তোলে; সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সে কট্টর হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে কট্টর ইসলামপন্থা মিশিয়ে অখণ্ড ভারতের ইউটোপিয়া তৈরি করে। বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন করতে আওয়ামী লীগ তাদেরকে পুলিশ-প্রশাসক- মিডিয়ার ন্যারেটিভ নির্মাতা হিসেবে ব্যবহার করে আসছে নিয়মিতভাবে। এর পাশাপাশি হেফাজতে ইসলাম ও ওলামা লীগকে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে মোল্লা শফির ‘নাস্তিক কতল ওয়াজিব’ ফতোয়াকে ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা ব্লাসফেমি ল দিয়ে ক্ষমতায়িত করেছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর সিম্বলকে সে ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যবহার করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির নিষ্ঠুরতার যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে; তা আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নাতসি চিন্তার ফলাফল।
ক্ষমতায় না থাকলে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নির্যাতিতের ক্রন্দন আইডেন্টিক্যাল। এরা উভয়েই নিজ নিজ কালচারাল ক্যাডার তৈরিতে ওস্তাদ। দুই দলের কালচারাল মামাদের পার্থক্য কেবল পোশাকে; কিন্তু মানবতা বিরোধী অপরাধ করে অনুতাপহীন থাকা; ডাকাতের মা-বাপের বড় গলা, সামাজিক পুলিশি, হনুমান ও ছাগল পালের মতো গুচ্ছবদ্ধ হয়ে থাকা এসবই একইরকম নরভোজি সংস্কৃতির শিল্পিত উপস্থাপনা।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেল গেল ও ইসলামি চেতনা গেল গেল’ রব তুলে হুক্কা হুয়া করতে থাকা শেয়াল পাল এরা; মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামের মালিকানা জাহিরের দুই নির্লজ্জ গোষ্ঠী। লোকজনকে ‘রাজাকার’ বলে তকমা দিয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বলা আওয়ামী লীগার ও লোকজনকে ‘কাফের নাস্তিক’ তকমা দিয়ে ভারতে চলে যেতে বলা জামায়াতের চিন্তার মিলের কারণ এরা ভূমিহীন ছিন্নমূল শ্রেণি থেকে উঠে আসা। পার্টি করে বাড়ি-গাড়ি-চর্বি ও গলার জোর হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কালচারাল উইং পাকিস্তানকে চিত্রিত করে খুনে সেনাবাহিনী ও মোল্লার দেশ হিসেবে। আর জামায়াতের কালচারাল উইং ভারতকে চিত্রিত করে খুনে গোয়েন্দা সংস্থা আর পুরোহিতের দেশ হিসেবে। এর কারণ হচ্ছে ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরের পাকিস্তান; সেখানকার নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকেরা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় বৃত্তি করে না। সারাবছর দেশটিতে নানারকম সাংস্কৃতিক উৎসব চলতে থাকে। সুফি মাজারগুলো আজও সেখানে ভক্তি গান আর আধ্যাত্মিক আলোচনায় মশগুল থাকে। ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরের ভারত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উদযাপনের আনন্দময় সমাজ। নাগরিক সমাজের ঋজুতা প্রবাদ প্রতিম। সাংস্কৃতিক পরিসর দীপিত। কবির ও নিজামউদ্দীন আউলিয়ার সন্ধি চিন্তা ভারতীয় সমাজের মূল সুর।
ভারত ও পাকিস্তানের আসল চেহারা লুকিয়ে রেখে; নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে দেশগুলোর গণমানুষের দুটি রাক্ষস মূর্তি বানিয়ে চানমারি করে জামায়াত ও আওয়ামী লীগের ক্যানিবালেরা। যাতে ওদের চেয়ে নিকৃষ্ট লোকজন যে এই পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নেই; এই সত্যটিকে লুকিয়ে রাখা যায়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন