লেখা: জয়নাল আবেদীন
দুইটা গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। মিডিয়া ও ফেসবুকের একযোগে বিটিভি হবার কারণে অনেকেই এটা জানেন না। জানলেও হয়তো পুরো ঘটনা না।
প্রথম ঘটনা হলো, গতকাল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রীতিমতো তাণ্ডব চালানো হয়েছে। ছাত্র পরিচয় দিয়ে কমপক্ষে চারজন ডাক্তারকে দীর্ঘসময় নিয়ে চোর পেটানোর মতো মারা হয়েছে। তাদেরকে কর্মরত অবস্থায় ওটি থেকে পাকড়াও করে মারতে মারতে নেয়া হয়েছে পরিচালকের রুমে। আবার কোনো এক রোগীকে কুপিয়ে মেরে ফেলারও খবর পাচ্ছি।
ঢাকা মেডিকেল দূরে থাক, যে কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এমন ঘটনা ঘটার ইতিহাস বিরল।
দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে, এই হামলার প্রতিবাদে ডাক্তাররা চিকিৎসা শাটডাউন ঘোষণা করেছেন। ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলে খবর পেয়েছি।
ডাক্তারদের ওপর হামলা মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা। এসব ঘটনা সচরাচর ঘটে উপজেলায় অথবা প্রাইভেট ক্লিনিক হাসপাতালে। ঘটেও আকস্মিকভাবে। হঠাৎ কিছু লোক আসে, হামলা করে চলে যায়।
ঢাকা মেডিকেলে ঢুকে অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার ধরে নিয়ে মারতে মারতে শো ডাউন দেয়ার মতো ঘটনা চিন্তারও বাইরে। অতীতে কখনো এমন ঘটেছে কিনা বলতে পারি না। আবার আজকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ডাক্তার অবরুদ্ধ করে হামলার খবর পেয়েছি।
ডাক্তারদের পক্ষ থেকে কমপ্লিট চিকিৎসা শাট ডাউনের কর্মসূচীও বোধহয় এবারই প্রথম। দুইটাই অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা। এই দুই ঘটনা কোথায় গিয়ে শেষ হয় দেখার ব্যাপার।
আমি অবশ্য এই ঘটনা শুনে খুব একটা চমকে যাইনি। এটা ঘটারই ছিল।
গত প্রায় একমাসে ল অ্যান্ড অর্ডার বলে কিছুই নাই। এখানে ওখানে লুটপাট হচ্ছে,মানুষ দাঁত কেলিয়ে বলছে, স্বৈরাচারের দোসরদের সম্পদ লুট করাই যায়।
শিক্ষকদের টেনে হিঁচড়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। সবাই দাঁত কেলিয়ে বলছে, স্বৈরাচারের দোসরদের এভাবেই নামাতে হয়।
কোনো প্রশ্ন করলে, দ্বিমত জানালে সুশীল উপাধী নিতে হয়। কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলে, দালাল।
দালাল বলে যত লোককে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানতাম এদের সবাই হয় ঘাপটি মেরে বসে আছে, নইলে চুপ। কারো নড়াচড়া সেভাবে নেই। কিন্তু ফেসবুকে ঢুকলে শতশত দালাল ট্যাগের পোস্ট। এই দালাল তারাই যারা সামান্য দ্বিমত জানাচ্ছে, সামান্য প্রতিবাদ করছে।
মাথার ব্রেইনে কেন যে ঢুকে না সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। স্বৈরাচারের দোসরদের প্রতি সিম্প্যাথি দেখানোর কোনো কারণই নাই। রাস্তায় রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, স্বৈরাচারের প্রতি মমতা আসবে কীভাবে রে ভাই? তাছাড়া অল্প কিছু মানুষ ছাড়া এই বিপ্লব সবারই ছিল। এখন দ্বিমত জানালেই সে দালাল এমন ভাবার তো মানে নাই।
গত ১৬ বছর এবং তারও আগে যারা অপরাধ করেছে প্রত্যেকের বিচার হতে হবে। যারা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে পদ বাগিয়ে অন্যায় করেছে, প্রত্যেককে স্টেপ ডাউন করা হবে। যত অবৈধ সম্পদ সব বাজেয়াপ্ত করা হবে।
কিন্তু বিচারের মানে এই তো না আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া। কাউকে স্টেপ ডাউন করাতে গিয়ে তাকে ভয় পাইয়ে হার্ট এটাক করানোর কোনো সুযোগ নেই। অবৈধ সম্পদ নিজে দখল করা বিচার না, এটা আরেক চুরি।
সব কিছু নিয়ম মাফিক হতে দেন। সরকারকে ঠিকমতো কাজ করতে বলুন। গোটা আন্দোলনে পুলিশ র্যাব মিলিয়ে দুইশজন মারা গেছে, পালিয়েছে হয়তো আরো একশ। বাকি সবাই ই কাজে আছে। তাহলে আনসারের বিদ্রোহ কেন ছাত্রদের দিয়ে দমন করাতে হয়? প্রত্যেকটা কাজে কেন ছাত্রদেরই ডাকতে হবে?
এই প্রশ্ন তোলেন না কেন?
ঢাকা মেডিকেল ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে পরপর দুইদিনে যে ঘটনা ঘটল এটা মোটেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। এটা এতদিনে সবকিছুকে প্রশ্রয় দেয়ারই কনসিকোয়েন্স। আরো বেশি প্রশ্রয় দিলে আরও বেশি এমন ঘটনা ঘটবে।
ছাত্রদের মন ও মানসিকতা এখনও জুলাইয়ের বিপ্লবে আটকে আছে। তারা এখনো ঘরে ফিরেনি। এরা বেপরোয়া হবেই। তাছাড়া বয়স কম বলে অনেক কিছু ঠিকঠাক বুঝবেও না। মুরগীর দোকানে গিয়ে এক গ্রুপ ছাত্রকে হাস্যকারভাবে দোকানদারকে চার্জ করার ভিডিও দেখেছি। পেঁয়াজের দোকানদারকে তার কেনা দামের চেয়েও কমদামে বিক্রি করার একটা ভিডিও সামনে এসেছিল। এইগুলা তারা না বুঝেই করছে।
তাছাড়া প্রত্যেক গ্রুপেই কিছু ভায়োলেন্ট লোক ঢুকে পড়ে। পরিচয় ভাঙিয়ে অপকর্ম করার মানুষেরও অভাব নেই। এই পরিচয়ের সংস্কৃতি যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করতে হবে।
যে ডাক্তার শাট ডাউন ঘোষণা করেছেন তিনি শুরুতেই বলছেন, আমরাও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম। আজকে আমাদের ওপর হামলা হলো...
কথার প্যাটার্ন খেয়াল করেন। গত ১৬ বছর কেউ আক্রান্ত হলে তার পরিবারের লোকজন বিচারের আশায় বলত, আমাদের পরিবারও আওয়ামী লীগ করে। দুই আমলের ভিক্টিমদের কথায় অসহায়ত্ব একই।
আমার বন্ধু তালিকায় ডাক্তারের সংখ্যাই বেশি। ডাক্তারদের একটা বড় অংশই গত কিছুদিনের আইন বহির্ভূত জিনিসগুলোকে নানাভাবে জাস্টিফাই করছিলেন। আজকে তারা হাহাকার করছেন।
সঠিক সময়ে সঠিক জিনিসের প্রতিবাদ না করলে সবারই এই হাহাকার করতে হবে। আজকে হাসপাতাল, কালকে হামলা হবে প্রাইভেট চেম্বারে। এরপর ব্যাংকে, এরপর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ডাক্তার, ব্যাংক, ব্যবসা… এমন কোনো সেক্টর আছে যার প্রতি মানুষের ক্ষোভ নেই? সবখানে হামলা করে সিস্টেম ঠিক করলে কার পিঠে মাইর পড়বে না ভেবে দেখেন।
রিপিট করি, সব অপরাধের বিচার চাই। গত ১৬ বছরের কারিগরদের বিচার করতে হবে প্রায়োরিটি বেসিসে। কিন্তু সব কিছু নিয়মতান্ত্রীক ও আইনের ভেতরে থেকে করার দাবী তুলেন। আইনের বাইরে গেলে ইনস্ট্যান্ট নুডুলসের মতো ইনস্ট্যান্ট বিচারে হয়তো দেখে মজা পাবেন, কিন্তু সিস্টেমটা নষ্ট হবে আরও বেশি।
বিএনপি সরকার সন্ত্রাস দমনে বিশেষ বাহিনী র্যাব করেছিল। র্যাব সন্ত্রাসীদের ধরে ধরে কোর্টের ঝামেলায় না গিয়ে পুটুস করে দিতো। মানুষ দিতো হাততালি। ঘুণাক্ষরেও ভাবতো না যে, এটা আইনসিদ্ধ না। এক সময় এই র্যাব দিয়েই বিএনপি নেতাদের পুটুস করা শুরু করে দিল। তারপর পুটুস করল সাধারণ মানুষদের।
জ্ঞানীদের র্যাব থেকেই অনেক শিক্ষা নেবার আছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত প্রত্যেককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধরে আইনের আওতায় আনা হোক। চিকিৎসা শাট ডাউন হলে মানুষের দুর্ভোগ অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় হবে। ঘটনার বিচারের মাধ্যমে মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করা হোক।
ফেসবুকের মতামত নির্ভর এই সরকারের কাছে ফেসবুকে এই দাবী জানালাম।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন