জিভ কাটো লজ্জায়!

১৫০ পঠিত ... ১৬:২০, আগস্ট ১৭, ২০২৪

26

আপনি পনেরো বছর ধরে আপনার অভিমতের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি মেলাতে না পারলেই ভ্রু কুঁচকে তাকে রাজাকার, জামায়াত, বিএনপি বলে তকমা দিলেন; এক পর্যায়ে তাকে পাকিস্তানে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। শেখ হাসিনাকে বুবু ডেকে আপনি দেশের মালিক হয়ে উঠলেন।

মুক্তিযুদ্ধে আপনার পরিবারের সরাসরি অংশগ্রহণ নেই, শহীদ স্বজনের সমাধি বা গণকবর নেই, আপনি শরণার্থী জীবনের বেদনা পোহাননি; আপনার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়নি খুনে পাকিস্তানি সেনা; অথচ আপনি মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিক্ষা দিয়ে বেড়াতে থাকলেন, সামনের লোকটির মুক্তিযুদ্ধে পারিবারিক ত্যাগের কথা না জেনেই।

ঢাকায় মিডিয়াজেনিক কিছু কিছু শহীদ পরিবারের আওয়ামী লীগ দলীয় শিখণ্ডি সামনে রেখে আপনিও কল্পনায় প্রকাণ্ড মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠলেন।

আপনার দাদা সবুজ লুঙ্গি পরে দুগাছা দাড়ি নিয়ে নিকটস্থ মাজারের খাদেম ছিলেন। আপনার দাদি সেই আমলে বোরখা পরে ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতেন না। অথচ আপনি হালের টি-শার্ট পরে ও কফি ওয়ার্ল্ডে কফি খেতে খেতে; দাড়ি টুপি পরা লোকজনকে উপহাস শুরু করলেন। হিজাব পরা মেয়েদের নিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলেন। প্রথম প্রজন্মের প্রগতিশীলতার কী যে অহংকার আপনার।

আপনার দাদা খসখসে ধুতি পরে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে বেড়াতেন মন্দিরের পুরোহিতকে। আপনার দাদিও ঘোমটা দিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেন। অথচ একটু শিক্ষিত হয়েই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সদস্যের মতো পোশাক পরে ঘুরে ফেসবুকে প্রগতিশীলতার চারুপাঠ দিতে দিতে লোকজনকে ছাগু-মুমিন বলে উপহাস করলেন। কল্পনায় আপনি তখন আর্য স্বপ্নে বিভোর। নিজের প্রোপিকের ঝলসানো মুখখানা কিংবা হাঞ্জব্যাক অফ নটরডেমের দেহাবয়ব নিয়ে সুপিরিয়রিটি দেখালেন যাকে তাকে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট দেশে সবাই সবাইকে চেনে। আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি যে কয়েক পুরুষ ধরে সুফি প্রগতিশীলতা ও পশ্চিমা রেনেসাঁর আলোয় স্নাত; তাকে কি অবলীলায় মৌলবাদী তকমা দিলেন! আবার মোদি কত ভালো শাসক সে আলোচনাও আপনি সময় সুযোগ পেলেই করেন! গুন্টার গ্রাসের মতোই বলতে ইচ্ছা করে, জিভ কাটো লজ্জায়!

এই যে আওয়ামী লীগ দলীয় ফেসবুক কর্মীরা যারা দলীয় অনুগ্রহে কুঁড়ে ঘর থেকে পাঁচতলা দালানে উঠলেন, মহিষের পিঠ থেকে প্রাডোতে চড়লেন, পান্তার থালা রেখে পাঁচতারায় পাস্তা খেতে ঢুকলেন, ২০০৮ সালে বাটার বন কলা খেয়ে ২০১৩ থেকে জন্মদিনের কেক কাটতে শুরু করলেন; অমনি ধরাকে সরা জ্ঞান করলেন আপনি। সত্যজিত রায়ের জলসাঘর চলচ্চিত্রের নতুন বড়লোকের মতো দাঁত বের করে নিওএফলুয়েন্স শো-অফ করলেন। আপনি কী ভেবেছিলেন, আপনার কাক-শরীরে ময়ুরপুচ্ছটি সারাজীবন থাকবে। আয়নার সামনে দাঁড়ান; দেখবেন, ওটা খসে পড়েছে।

আপনি মিয়া শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে ঘুরে খুব সংস্কৃতি মামা হয়ে উঠেছেন। সাক্ষাত রবি ঠাকুর হয়ে সমাজকে শেখাচ্ছেন শিল্প-সংস্কৃতি।

পূর্ব বঙ্গ গানের দেশ, কবিতার দেশ। এইখানে প্রতিটি মানুষের কন্ঠে সুর, হাতে শিল্পের তুলি; সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরের পরিশ্রম আর শিল্পের ছোয়ায় নান্দনিক এই বদ্বীপের মানুষকে আপনি প্রগতিশীলতা শেখাতে এসেছেন।

বৃটিশ আমলে যখন কলকাতার হিন্দু জমিদার আর পাঞ্জাবের মুসলমান জমিদার বৃটিশের দালালি করে বেড়াচ্ছিল ঠিক আপনার মতো; সে সময় পূর্ব বাংলায় জ্বলে উঠেছিল দ্রোহের মশাল। বৃটিশের টাকা-পয়সা খেয়ে ইতিহাস ও সাহিত্য রচনা করে পূর্ববঙ্গের বিদ্রোহী মানুষকে নিম্নবর্গের মানুষ বলে তকমা দেওয়ার যে ন্যারেটিভ চালু হয়েছিল; আপনি সেই ন্যারেটিভের কাকাতুয়া। নিজের জনপদের মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আপনি পরিবেশিত হতে চেয়েছেন প্রগতিশীলতার পাত্রে। অথচ তা ঘৃণ্য রেসিজম। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে বলুন তো; পূর্ব বঙ্গের কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের মতো মানসিক আভিজাত্য আপনার আছে কিনা।

আপনারা ইসলামোফোবিয়া তাড়িত হয়ে শেখ হাসিনার ক্রসফায়ার গুম খুন কারাগারে নির্যাতনকে সমর্থন করতে করতে ক্রমশ নরভোজি হয়ে উঠেছেন। বাক-স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে সমর্থন দিয়েছেন। মৌলবাদি নরেন্দ্র মোদির সমর্থনে হাসিনার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখতে আপনি লাল বাতি এলাকার পিম্পের ভাষায় কথা বলেছেন।

এখন দেখলেন তো শিল্পী এস এম সুলতানের পেশীবহুল কৃষক-কারিগরের ডিএনএ-এর শক্তি। হাসিনার খুনে বাহিনীর মারণাস্ত্রের সামনে বুক পেতে দিয়ে কীভাবে স্বাধীন করল তারা অবরুদ্ধ জনপদ। পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর-রায়দুর্লভ-রাজবল্লভ-জগতশেঠের চক্রান্তে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হবার পর থেকেই পূর্ববঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেই মুক্তিযুদ্ধে ১৯৪৭ সালে তারা বৃটিশ ও তাদের দেশি কোলাবরেটরদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দেশী রাজাকারদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশে দুটি রাজনৈতিক লালসালুর মাজার সে স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে অনূদিত হতে দেয়নি। স্বদেশী খুনে শাসকদের লেলিয়ে দেওয়া দলীয় লেঠেল আর পুলিশ-এলিট ফোর্স জিম্মি করে রেখেছিল বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে।

শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী হত্যাকান্ড দমিয়ে রাখতে পারেনি স্বাধীনতার আকাংক্ষাকে। অসহায় বাবা-মা, মেহনতী মানুষ, শিশু-কিশোর পথে নেমে এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস রচিত হয়েছে পৃথিবীর বুকে।

ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, এমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট; কোথাও বিপ্লব-পরবর্তী দিনগুলো সুশৃংখল ছিল না। অথচ ৫ আগস্টে স্বৈরশাসক হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর; পনেরো বছরের হত্যা-গুম-ক্রসফায়ার, আয়নাঘরে নির্যাতন, দেশ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ দেখে কুঁচ কুঁচ করে চলেছেন হাসিনা সমর্থকেরা। পদে পদে বিপ্লবী তরুণদের ভুল ধরা ও তাদেরকে ডিফেম করা এদের কাজ। এরা আসলে পিন পিন করে নৈতিকতাহীন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের কাজটি শুরু করে দিয়েছে জোরেশোরে। কারণ এদের জীবন ও জীবিকা, সামাজিক মর্যাদা নির্ভরশীল আওয়ামী লীগের দলীয় ক্ষমতার ওপর।

যে কোনো নতুন একটি সরকার ব্যবস্থাকে ১০০ দিন সময় দিতে হয় তাদের প্রবেশন পিরিয়ড হিসেবে; অতীতে জামায়াত সমর্থিত বিএনপি ও বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগ সরকারকে জনগণ সে সময়টি দিয়েছিল।

তবে আওয়ামী লীগের পরাজিত স্বৈরশাসকের অংকশায়িনীদের আজকের মরা-কান্না, বাক-স্বাধীনতার দাবী, ১৬ জুলাই থেকে ৪ অগাস্ট দেশের সন্তান হত্যায় উল্লাস করে ১৫ আগস্ট জাতির জনকের স্মরণে শোক প্রকাশের রিচুয়াল পালনের দাবি, নতুন সরকারের উপদেষ্টাদের গালাগাল, বিপ্লবী তরুণদের ছিদ্রান্বেষণ; এগুলো হাসিনা অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে আজকের মুক্ত স্বদেশে স্বাধীনতার চিহ্ন। নাগরিক সমাজের এই সক্রিয়তার দাবিটিই আমরা ২০০১ সাল থেকে ২০২৪-এর ৫ অগাস্ট দুপুর পর্যন্ত করে এসেছি। তখন অবশ্য দলীয় লোকগুলো ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ ছিল, প্রতিহিংসার নেশায় বুঁদ ছিল। এই অন্ধ অক্ষম লোম ওঠা নেকড়েগুলো যদি আজ সভ্যতার দাবি তোলে; আমি তাকে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবেই দেখব।

১৫০ পঠিত ... ১৬:২০, আগস্ট ১৭, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top