১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত যারা শেখ হাসিনার ছাত্রগণহত্যাকে সমর্থন করেছেন; তাদেরকে আজ বঙ্গবন্ধু হত্যা স্মরণের শোক দিবস পালনের দাবিতে সোচ্চার দেখলাম। শেখ হাসিনা এই ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির সূত্র ধরে ‘স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি’ এই বাক্যটি বলতে বলতে সিরিয়াল কিলিং করেছেন। ভিন্নমতের মানুষকে গুম, খুন করে, আয়নাঘরে অকথ্য নির্যাতন করে হাসিনা টিভি ক্যামেরার সামনে এসে ১৫ আগস্টের স্বজন হারানোর কষ্টে কেঁদেছেন।
হাসিনার কিলিং স্কোয়াডের হাতে নিহতদের স্বজনেরা ভেবেছেন, স্বজন হারানোর কষ্ট কেবল ভিআইপিদের জন্য। দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে যে অসহায় মানুষেরা বসবাস করে; নিষ্ঠুর সরকারের হাতে তাদের স্বজন গুম কিংবা খুন হলে শোক প্রকাশ করা যাবে না। শোক বিষয়টি কেবল ভিআইপিদের জন্য।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে বঙ্গবন্ধু তাদের মুক্তির নায়ক হিসেবে বসবাস করে বলেই; ২০০১-০৬ জামাত সমর্থিত বিএনপি শাসনামলে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধীদল হিসেবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল; সেই প্রতিকূল সময়ে বিবিসি জরিপে বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিয়ে তার মাথায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল। এরপর তারা বঙ্গবন্ধুর মার্কা নৌকাকে ভোট দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় এনেছিল ২০০৯ সালে।
ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দলীয় প্রতীকে পরিণত করলেন। টিভি ক্যামেরায় অহংকার প্রকাশ করতে শুরু করলেন, আমি জাতির জনকের কন্যা; ঐ জায়গাটি কেউ নিতে পারবে না।
শেখ হাসিনা তস্কর ব্যবসায়ীদের মুজিব কোট পরিয়ে সংসদ ও মন্ত্রীসভায় বসালেন; এরা ব্যাংক ও প্রকল্প খেয়ে দেশডাকাতি করে সম্পদ পাচার করতে শুরু করল। তেলাঞ্জলি দিতে প্রতিটি দপ্তরের একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু পূজার ঘর স্থাপিত হলো। শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দলীয় আমলা ক্যাডার ও পলিটিক্যাল ক্যাডাররা সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করে উত্তর কোরিয়ার দৃশ্যপট রচনা করল।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগ জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে হেলমেট পরে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শিশু-কিশোরের ওপর। এই স্লোগান দিয়ে তারা হত্যা করে বেড়াতে লাগল বিশ্বজিত ও আবরারদের।
বাংলাদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হলো বঙ্গবন্ধুর নামে। কালাকানুন ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিন্দুমাত্র সমালোচনা করলে কারাদণ্ডের বিধান হলো। উল্লেখ্য আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান কোথাও জাতির জনকের ভাবমূর্তি রক্ষার এমন কালাকানুন প্রচলিত নেই।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবন ও টুঙ্গিপাড়ার সমাধিস্থল লালসালুর মাজারের মতো খাদেমদের উদ্দেশ্যমূলক কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণের নাট্যমঞ্চে পরিণত হলো।
জনগণের বঙ্গবন্ধু এইভাবে সাইনবোর্ড হলেন শেখ হাসিনার ক্ষমতার দোকানে। গত ১৫ বছরে বঙ্গবন্ধুর নাম জপে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হলো; দেশ লুন্ঠন হলো; তার কোনোটির দায় বঙ্গবন্ধুর নয়। মহানবীর নাম উচ্চারণ করে ভাস্কর্য ভেঙে বেড়ানো কিংবা রামের নাম উচ্চারণ করে বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য যেমন উনারা দায়ী নন। খলচরিত্রের লোকেরা তাদের অপরাধ লুকাতে মুজিব কোট পরে, দাড়ি রেখে রাসুলের সুন্নত আদায় করে, গেরুয়া পরে রাম সাজে। জয় বঙ্গবন্ধু, নারায়ের তাকবির, জয় শ্রীরাম বলে মানুষ হত্যা করে বেড়ানোর দায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ইসলাম ধর্ম কিংবা হিন্দু ধর্মের নয়।
কিন্তু সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে হালের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে শিশু-কিশোর-তরুণদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নরভোজি হামলার কারণে এই শব্দগুলো ভয়ের প্রতীক হয়ে গেথে গেছে নতুন প্রজন্মের মনে। তারা শোকগ্রস্ত। ৫ আগস্টে হাসিনা শাহিকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর থেকে বাংলাদেশে যে বিশৃঙ্খল ঘটনাগুলো ঘটেছে; তার পেছনে রয়েছে হাসিনার ১৫ বছরের খুনে শাসনের আয়নাঘর থেকে মুক্তির পর পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
প্রতিবেশি ভারতের ক্ষমতা-কাঠামো যেহেতু প্রণব মুখার্জি, সুজাতা সিং, নরেন্দ্র মোদির মাধ্যমে হাসিনাকে অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে; হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর থেকে ভারতের মৌলবাদি মোদি সমর্থিত গোদি মিডিয়া যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের জুলাই বিপ্লবকে মৌলবাদিদের ক্ষমতা দখলের তকমা দিয়েছে; আওয়ামী লীগের হিন্দু নেতা কর্মী, পুলিশ-প্রশাসনের লোকের ওপর হামলাকে যেভাবে সংখ্যালঘুর ওপর হামলা বলে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে অসংখ্য ফেইক নিউজ ও ফটো শেয়ার করে; তাতে বিপ্লবী ছাত্রছাত্রী সচকিত হয়ে আওয়ামী লীগের যে কোনো ধরনের গোষ্ঠীবদ্ধতাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। ১৫ আগস্ট শোক পালনের নামে প্রতিবিপ্লবের ছায়ানৃত্য ভেবে তরুণ বিপ্লবীরা এরকম জমায়েত রুখে দিয়েছে।
১৫ বছরের নৈতিকতাহীন শাসনে বঙ্গবন্ধুর নামের অপব্যবহার করে; আওয়ামী লীগ রচিত ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মলগ্নের উল্লেখযোগ্য অন্য সব নেতার নাম প্রায় মুছে দিয়ে যে বঙ্গবন্ধু কাল্ট তৈরি করে শেখ হাসিনা একদলীয় স্বৈরশাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে চেষ্টা করেছেন; জুলাই বিপ্লবের তরুণ তরুণীরা সেই অশুভ কাল্টের বিরুদ্ধে রেজিট্যান্স জারী রেখেছে।
সময় ক্রমশ সব অস্থিরতা প্রশমন করে। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ যখন পরাজয় মেনে নিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসবে; বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তখন ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে অনুবাদ করবে জীবন চর্যায়; যেখানে গণতন্ত্র, সাম্য, সামাজিক সুবিচার, অন্তর্ভূক্তিমূলক অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন ঘটবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলে; তখন তারা ৭ মার্চের সোন্নত তর্জনির জননেতা বঙ্গবন্ধুকে পুনরাবিষ্কার করবে।
কোনো মানবতা বিরোধী অপরাধের অন্ধ সমর্থককে তখন ফেসবুকে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা শিক্ষা দিতে হবে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন