লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
প্রথমদিনের পর আমার ভয়ডর শেষ। সমস্যা হলো আম্মুকে মিথ্যা বলে বের হয়েছি৷ আগেরদিন পুলিশ অ্যাটাক করেনি, শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কাজেই নিশ্চিত ছিলাম অ্যাটাক করবেই। হলোও তাই। মেয়েদের বিশাল জনস্রোতটাকে জেলখানা রোডে পাঠিয়েই তারা ছেলেদের ওপর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করল। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তার প্রভাব কমাতে টায়ার জ্বালিয়ে দিল। আমরা শুরুতে টের পাইনি ওদিকে কী চলছে। মিছিল ঘুরে আবার সাতমাথা আসতেই দেখি পুরো এলাকা ধোঁয়ায় অন্ধকার, স্লোগানে মুখর। এতদিন বইয়ে পড়েছি, কিন্তু সত্যি সত্যি outrageous জিনিসটা কী সেদিন টের পেলাম। একদম বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা মিছিলের সামনে থেকে প্রবল আক্রোশ নিয়ে, গভীর ক্রোধে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। তাদের ডিকশনারিতে ভয় বলে কোনো শব্দ নাই। সেই মুহূর্তে courage is contagious and fear doesn’t exist anymore.
মিছিলগুলো একটা দেহের মতো। মানুষগুলো একেকটা কোষ। একজন আরেকজনকে সাহায্য করছে, একসাথে গলা মেলাচ্ছে। কখনও কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছে পানির বোতল, কখনও মাস্ক, ছাতা, চকলেট। সম্মিলিতভাবে তারা আগায়, সম্মিলিতভাবে থামে। এইদিন স্টুডেন্টদের সাথে বিপুল পরিমাণ প্যারেন্টসদের যোগ দিতে দেখলাম। বাচ্চাদের তারা ঘরে আটকাতে যেহেতু পারছেন না, তাদের সাথেই চলে এসেছেন। কারও বাবা, কারও মা। আন্টিদের উৎসাহের সীমা নাই। কী যে ভালো লাগল উনাদের মিছিলে দেখে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ঐতিহাসিক দৃশ্যের সাক্ষী হলাম। হাজার হাজার মানুষকে রাগিয়ে দিয়ে পুলিশ মোটেই ভালো কাজ করেনি। তাদের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়া হলো সাতমাথার বিশাল বিশাল বিলবোর্ডের আওয়ামী লীগের ব্যানার টেনে নামিয়ে, তাতে আগুন ধরিয়ে ওদেরই ছোঁড়া টিয়ার শেলের জবাব দিয়ে। মনে হচ্ছিল সিনেমার দৃশ্য দেখছি। সেই কত কত যুগ ধরে এইসব বস্তাপচা জিনিস আমরা মুখ বুজে সহ্য করেছি। এই সুবিশাল জনশক্তিরই একমাত্র ক্ষমতা ছিল এসব টেনে নামানোর। একের পর এক যখন চারপাশ থেকে ব্যানারগুলো নামানো হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমাদের জয় অর্ধেক পেয়ে গেছি আমরা। এইসব প্রতীকী জিনিস যে জনমনে গভীর ছাপ ফেলার ক্ষমতা রাখে তাও টের পেলাম।
আমাদের ভাইরে মারছিস তোরা, বোনরে মারছিস তোরা। একটা একটা করে রাত পার হইছে আমরা ঘুমাতে পারি নাই, চোখের পাতা বন্ধ হয় নাই। কী অপরাধ ছিল চারতলার কার্নিশ ধরে জান বাঁচানোর চেষ্টা করা ছেলেটার? কী অপরাধ ছিল রিয়া গোপের? গ্রাম থেকে শহরে কলেজে পড়তে আসা ছেলেটা যে প্রথমদিন মিছিলে গিয়েই গুলি খেয়ে মারা গেলে, তাকে তো কেউ চেনেও না ঠিকমতো। কেন মারলি তোরা? আবু সাঈদ যে গুলির সামনে দাঁড়ায় গেছিল, বিস্মিত হয়ে তোদের দিকে তাকায় ছিল; এভাবেও মারা যায় মানুষকে? এভাবেও? যখন তখন যাকে তাকে গ্রেফতার করছিস। রাতের বেলা বাসায় বাসায় গিয়ে রেইড দিছিস। HSC স্টুডেন্টগুলারে পর্যন্ত ছাড়িস নাই। আমাদের অশিক্ষিত, মূর্খ, মাতাল মন্ত্রীরা যা নয় তা বক্তব্য দেয় টিভিতে। একটা একটা করে জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা খবর আমাদের সামনে আসে, আমরা ক্রোধে, অসহায়ত্বে অস্থির হয়ে যাই। তখন আর নিজেকে ঘরে রাখা যায় না। কোনোভাবেই না। মনে হয় এরচেয়ে গুলি খেয়ে মরে গেলেও ভালো।
.
গুলি খাওয়ার মতো ভাগ্য নিয়ে দেখি জন্মাই নাই। কপালে জুটল হালকা টিয়ার গ্যাস আর কিছুটা আতংক। সাতমাথার মিছিল শেষে যেই লোকজন কমতে শুরু করল, সেই গোলাগুলি আর টিয়ার শেল নিক্ষেপ শুরু হলো আরেক দফা। বাসায় ফেরার জন্য সাতমাথা আর জলেশ্বরীতলার চারপাশে ঘুরপাক খেলাম পাক্কা একঘণ্টা। ফাইনালি যখন বাসায় এসে পৌঁছালাম, শুনলাম ছাত্রলীগ রামদা নিয়ে বের হইছে, কেউ যেন জলেশ্বরীতলার দিকে না থাকে। এর সত্যি মিথ্যা জানি না। এইদিনই শেষ। এরপরের দিন আমি আর বের হইনি। রবিবারে আম্মুর অফিস থাকায় আমার দায়িত্ব পরে হৃদি-রুহানকে দেখে রাখার, ওরা যেন বাসা থেকে বের না হয়। আর শেষদিন তো ছিল 'লংমার্চ টু ঢাকা'৷ ঢাকা যাইতে খুব ইচ্ছা করতেছিল, কিন্তু মানুষ না পাওয়ায় আর বের হতে পারি নাই। সেইদিনও গুলি খেয়ে মারা গেছে কয়েকজন। এত এত লাশের ওপর দাঁড়ায়েও খুনী হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা চেয়ে গেছে। এখনও ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। সামনের দিনগুলাতে আমরা কী দেখব জানি না, কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। সেনাপ্রধান বিট্রে করল না, সেনাবাহিনী বন্ধুর মতো আচরণ করছে। বিশ্বাস হয়, এরাই UN peace keeping mission এর ট্যাংক নিয়ে নেমে গেছিল রাস্তায় আমাদেরকেই গুলি করে মারার জন্য? কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আমরা দেখতেছি একজন মানবিক মানুষ আমাদের প্রধান উপদেষ্টা। আমাদের মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা শিক্ষিত মার্জিত, তারা ন্যায়ের কথা, ন্যায্য কথা বলেন। আমরা তাই দেখেও রাতে ঘুমাতে পারছি না। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। আমাদের কি এদের বিশ্বাস করা উচিত? এরা যদি সত্যি ভালো মানুষ হয়, আমাদের সুখের দিন কি টিকবে? হাসিনার বিরাট ছাত্রলীগ যে সনাতন সেজে মিছিল করে বেড়াচ্ছে, এদের শেষ কোথায়? এরা কী চায়? আমার এক ফ্রেন্ড বলছে, হাসিনা মরে গেলেও আমরা শান্তিতে থাকতে পারব না, কারণ ও হচ্ছে ডার্ক লর্ড। ওর জায়গায় জায়গায় হোর্ক্রাক্স লুকানো।
আমরা দেখছিলাম ডার্ক লর্ডেরও শেষ দিন আসে। কাজেই এরও শেষদিন আসবে। শুধু আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের হ্যারির জন্ম হইছে কি না।
(পুনশ্চঃ ৩৪ জুলাইয়ের কাহিনি লিখা শুরু করছিলাম। কোথায় জানি এসে শেষ হলো)
বগুড়া
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন