কেন আমি চিরস্থায়ী বিরোধীদল

৩১৪ পঠিত ... ১৬:০২, আগস্ট ০৯, ২০২৪

WhatsApp Image 2024-08-09 at 15.58.39_1aca8eee

শিরোনামে যে ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করেছি; এটি খুবই অপছন্দের শব্দ। কারণ এই আমি শব্দটির মধ্যে ‘স্বৈরাচার’ লুকিয়ে থাকে। যতদিন পর্যন্ত এই আমি শব্দটি আমরায় রুপান্তরিত হবে না; ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। ব্যক্তিমনের আমিত্বের অহংকার বাংলাদেশকে একটি চিরস্থায়ী স্বৈরাচারী শাসনের গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছে।

অনেক রক্ত ও ত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, এই আমিত্বের অহম মুক্তিযুদ্ধের সুফল কেবল গুটিকয়ের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল। সেই থেকে কতিপয়তন্ত্র রাষ্ট্রকে টাকা বানানোর মেশিনে রুপান্তর করে। মুক্তিযুদ্ধের আগে যারা কুঁড়েঘরে বাস করত; তারা ক্ষমতাকাঠামোর কোলাবরেটর হয়ে দ্রুত জমিদার হয়ে পড়ে।

সেই যে বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদার আর পাকিস্তানি কোলাবরেটর জমিদারের ভ্রান্ত আর্যস্বপ্নে এলিট বা অভিজাত হবার উদগ্রবাসনা; তা স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতা উপনিবেশের কোলাবরেটরদের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ানোতে বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে বৈষম্যের ধূসর বিষাদসিন্ধুতে পরিণত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা; প্রত্যেককে শিখণ্ডি বানিয়ে পাওয়ার ব্রোকাররা আসলে জমিদার হওয়ার চেষ্টা করেছে। এদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর নায়ক কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ, প্রবাসী শ্রমিকের উপার্জিত অর্থ লুন্ঠন করে প্রতিটি সরকারের ৩০০ সংসদ ও তাদের লেঠেলরা জমিদার হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা-কাঠামোর কোলাবরেটর হয়ে ব্যবসায়ী সমাজ তৈরি হয়েছে; শ্রম শোষণ ও ঋণখেলাপ করে যারা জমিদার হয়ে উঠেছে। এমনকি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গড়েও কিছু লোক কর্মী শোষণ করে ও অনুদান লুট করে জমিদার হয়েছে।

সেই যে বৃটিশ শাসক লর্ড কর্নওয়ালিশের কোলাবরেটর হয়ে চিরস্থায়ী জমিদারির বন্দোবস্তী পাওয়া; সেই ভ্রান্ত স্বপ্ন ডিএনএ প্রবাহে গেথে যাওয়ায়; বাংলাদেশে সাফল্যের সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়েছে কোলাবরেটর জমিদার হওয়া।

বৃটিশ সিভিল সার্ভিস ও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর মাঝ দিয়ে সুপিরিয়র হয়ে ওঠার যে ঘৃণ্যমানস; তা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসকে আচ্ছন্ন করেছে। এরা আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দলীয় ক্যাডার হয়ে দেশ লুন্ঠনের স্থায়ী চক্রে পরিণত হয়েছে।

বৃটিশ আমলে মুঘল ও নবাবী যুগের দুর্নাম করে বৃটিশ শাসককে খুশি করার যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ঐতিহ্য, পাকিস্তানি শাসককে খুশি করে কাব্য চর্চার যে শিল্প-সাহিত্য চর্চা, জমিদার বাড়িতে পুরুষ কমলা সুন্দরী হয়ে নাচা কিংবা বাঈজি নাচানোর কালচার; ঐটিই পাঁচ বছরের ক্ষমতার প্রতীক হাওয়া ভবন ও পনেরো বছরের দুর্নীতি ও নির্যাতনের প্রতীক আয়না ঘরের কালচার হিসেবে শাসক-শোষক-পরিতোষক-স্থূলসৌন্দর্য্যধারক-ভণ্ড সংস্কৃতি মামা খালার আদিম এক বিকৃত সংস্কৃতি জগত সৃষ্টি করেছে। পদ-পদক-প্লটের জন্য লালায়িত হয়ে ‘একটি মিথ্যাকে একশোবার উচ্চারণ করে সত্য বানানো’র গোয়েবলস-সাংবাদিক সমাজ তৈরি হয়েছে; তা গণশত্রু হিসেবে জন নির্যাতনের সারিন্দা হয়েছে।

হাওয়া ভবন ও আয়না ঘর কেন্দ্রিক অর্ধশিক্ষিত ক্ষমতা-কাঠামো বাংলাদেশের জ্ঞান নির্ভর সমাজ বিনাশ করে টেকাটুকানির্ভর সমাজ তৈরির যে অনগ্রসর চিন্তা জনপ্রিয় করেছে; তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন অধরা করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে দলান্ধ ও ধর্মান্ধ ফুটসোলজার-কোটালপুত্র তৈরির যে ভিলেজ পলিটিক্স তা বাংলাদেশকে একটি চিরস্থায়ী বিভাজনের গহবরে ফেলে দিয়েছে। ফলে অন্তর্ভূক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ সমাজ তৈরি হতে পারেনি। বিদ্বেষের বাজারে ভালোবাসার দোকান খোলা হয়নি কখনোই।

ইউরোপের দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গ্রাউন্ড জিরোতে দাঁড়িয়ে মাত্র বছর দশেকের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। দ্রুত কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে দেশগুলো। আর বাংলাদেশে বিভাজনের মাধ্যমে জমিদারি তৈরির কতিপয়তন্ত্র অশ্লীল ভি আইপি কালচারে নিমজ্জিত করেছে দেশটিকে। ভি আইপি কালচারের নোংরা মানস; সাম্য চিন্তার সভ্য সমাজ গড়ার শত্রু।

মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের প্রতি বিপ্লব, নব্বুইয়ের গণ-অভ্যুত্থান, ওয়ান ইলেভেন থেকে শাহবাগ মুভমেন্ট; প্রতিটি পরিবর্তনে আমরা একদল মুজিব কোট, জিয়ার সাফারি, শিফন-জামদানি, নক্সী পাঞ্জাবি পরা দেশ লুন্ঠক পেয়েছি। তাই ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত জুলাই জেন জি রেনেসাঁর বিজয় উদযাপনে পরিমিতি প্রয়োজন। ডিএনএ-তে যে জমিদার হয়ে ওঠার মানসিক দৈন্য; সেখানে স্বাধীনতার সুফল প্রান্তিক মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়া পাহাড় প্রমাণ একটি চ্যালেঞ্জ। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলে রাষ্ট্র শব্দটি অর্থহীন হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের পারিবারিক জমিদারি কেন্দ্রিক দুই লালসালুর মাজার, তা কট্টর মুসলমান, কট্টর হিন্দু ও কট্টর ছাত্র খাদেম নিয়ে যে চর দখলের লড়াইয়ে বাংলাদেশকে কবরস্থান ও মহাশ্মশানে রুপান্তর করেছে; এই নরভোজি রাজনীতির খুনে রাক্ষস-মানস জিইয়ে রেখে বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা সুদূর পরাহত।

ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুত কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে সেখানকার সাধারণ মানুষ। যখন যে সরকার ক্ষমতায় তাকে তেলাঞ্জলি দিয়ে সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, রহমত ভাই, শরিয়ত ভাই না হয়ে; চিরস্থায়ী বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি নাগরিক। ক্রিটিক্যাল সিভিল সোসাইটি ছাড়া সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

তাই ক্ষমতার পালা বদলে হাওয়া বুঝে ক্ষমতার মাথায় ছাতা ধরার যে দরিদ্র মন; তা থেকে বেরিয়ে এসে চিরস্থায়ী বিরোধী দলের মনের ঐশ্বর্য নিয়ে সরকারের যে কোনো অন্যায়ের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করার সংস্কৃতি বাংলাদেশ উত্তরণের একমাত্র পথ।

চোখের বদলে চোখের রাজনীতি বাংলাদেশকে অন্ধ করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের কুঁচকুঁচানি থেকে বেরিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশকে ভালোবাসতে হবে। ন্যায়ের ব্যাপারে তবে কিন্তু করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একচক্ষু নির্লজ্জতার যে অপসংস্কৃতি; এইসব বদ অভ্যাস পরিবর্তন জরুরি।

মানুষের দুটো হাত আছে, মেধা আছে; পরিশ্রম করে সৎভাবে দুটো ভাত খাওয়া যায়। এই মানুষ পরিচয়কে অপমান করে দলের ছিটিয়ে দেওয়া ভাতের জন্য লোভাতুর কাকজীবন আসলে বন্দীত্ব। দলদাস মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে স্বাধীন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার যে আনন্দ; এরচেয়ে সন্তুষ্টির জীবন আর কিছুই হতে পারে না।

৩১৪ পঠিত ... ১৬:০২, আগস্ট ০৯, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top