লেখা: মোজাফফর হোসেন
গোলামকে মুক্তি দিলেও সে মালিক খোঁজে। শুরু হয়ে গেছে খোঁজাখুঁজি।
বিপ্লবের ট্র্যাজেডিই হলো, মুক্তির জন্য আন্দোলন কখনো মালিকরা করে না, চিরদাসরা করে এবং সেটা করে কেবল মালিক বদল করার জন্যই।
---------
বুদ্ধির মুক্তি বিগত শাসনামলে যেমন ঘটেনি, এখনো সেই সম্ভাবনা দেখছি না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যা যা শুরু করেছিল প্রথম দিন থেকে সেটাই শুরু হয়েছে। শুধু সেট বদলেছে। প্রথম দিনই অর্ধেক নিউজ চ্যানেল বন্ধ, বদলে গেল টক শো, বিটিভির স্ক্রল, পলাতক আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, বদল ঘটছে পোস্ট-পদবির। মনে করে দেখেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঠিক এটাই ঘটেছিল। লাইসেন্স হারিয়েছিল টেলিভিশন-খবরের কাগজ, কণ্ঠ হারিয়েছিলেন আজ যারা কণ্ঠ ফিরে পেয়েছেন তারা। আমি সাধারণ মানুষ, আগে ছাত্রলীগের মিছিল দেখে ভয় পেতাম, গতকাল ছাত্রদলের মিছিল দেখে ভয় পেয়েছি, সংঘবদ্ধ ছাত্রশিবির দেখে আৎকে উঠেছি। আমার ভয়টা একই, ভয় দেখানো মুখোশটা ভিন্ন।
নতুন বাংলাদেশ? হ্যাঁ, আমিও চাই, মনেপ্রাণে চাই। কিন্তু সেই বাংলাদেশ গড়বে সেই আদ্দি জোট জামায়াত-বিএনপি? সেই মরচেধরা লাঙল? নাকি নয়া মোড়কে হাজার বছরের ** হেফাজতে ইসলাম? এরা নিশ্চিত করবে বাকস্বাধীনতা, যাদের মনে বোধে অব্যক্ত থাকে হাজার হাজার মৃত্যুর পরোয়ানা? দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়বে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন থাকা সেই দল? অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, ব্যক্তিস্বাধীনতা সপক্ষের বাংলাদেশ গড়বে X-Y? শিল্পীর ভাষ্কর্যচর্চান স্বাধীনতা যে দেয় না, সে করবে মূর্তিরক্ষা? আপনি বিশ্বাস করেন, আমার শ্রদ্ধা আপনার যে কোনো বিশ্বাসে। কিন্তু মনে রাখবেন, কুমিরকে দিয়ে মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না, মাছই কুমিরের আহার।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে নতুন কাউকে আসতে হবে। শঙ্কা হলো, নতুন যারা আসবে আমাদের শাসন করতে, তারা এ দেশেরই মানুষ, তরুণরা না, সেই তো বুড়োরাই। অলরেডি জেল থেকে বের হচ্ছেন নেতা হওয়ার জন্য, যারা বঙ্গভবনে বসে নেতা-নির্বাচন করছেন, তারা সব পরীক্ষিত মাল, সেই পুরাতন বোতলই। তারাই ছাড়ছে হুঙ্কার নিজ নিজ চেতনা-বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার। অলরেডি ভাস্কর্য ভাঙা শুরু হয়েছে। কেউ বলছে না, এদেশে একজনও দুর্নীতিবাজ, রক্তচোষা পুঁজিবাদীরা টিকতে পারবে না, বলছে ভাস্কর্য টিকবে না। বলছে না, একজনও অসৎ ভণ্ড ব্যবসায়ী, ঘুষখোর, সুদখোর টিকতে পারবে না, বলছে নাস্তিক থাকবে না। আর আমরা স্বপ্ন দেখছি পরিবর্তনের, নতুন বাংলাদেশের। একসেট জেলে যাচ্ছে, আরেকসেট বের হচ্ছে। এই-সেট যেদিন ঢুকবে হবে, ওইসেট সেদিন বের হবে। একটা ভিসিয়াস চক্র। কিন্তু এই ক্ষমতা হাতবদলের সময় বলি হবে কে? মানুষ। কোন ক্ষমতার জন্য? যে ক্ষমতা কখনোই এদের ছিল না, হবেও না। রাজা যায়, রাজা আসে। বিদ্বেষের আগুনে দগ্ধ হয় কেবল প্রজারাই। দেখবেন, ৫শতাধিক মানুষ মরলো। কারা মরলো? সেই নিচুপদের পুলিশ যারা বড়ো পুলিশের জুতো ঠিক করে দেয়; আর সেই ভাড়াটে নিম্নবিত্ত, যারা চিরকালই উচ্চবিত্তের বমির মধ্য থেকে দানা বেছে খায়, আর কিছু নিচুশ্রেণির মধ্যবিত্ত, যারা না খেয়ে থেকে ভাবে বিপ্লব করার জন্য অনশন করছে। এদের লাশ গণনা করে ক্ষমতার জন্য গোলটেবিলে বসে কারা? যাদের এই মৃত-শ্রেণির কেউ চেনেই না। ওরাও এদের চেনে না। অচেনা শাসকের জন্য শহিদ হয় অচেনা প্রজা!
স্যরি, আমার নৈরাশ্যবোধে আপনারা হতাশ হবেন না।
নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমিও দেখি, কিন্তু সেই নতুন বাংলাদেশ যেমন পুরাতন জোট দিয়ে হবে না, তেমনি CIA নির্ধারণ করা ব্যক্তি দিয়েও হবে না। সমাজে এখনো কিছু ভালো লোক আছে যাদের হাত দিয়ে একজন বেনজীর, মতিউরের জন্ম হবে না। যারা ধর্মব্যবসা আর মৌলবাদকে উসকে দেওয়ার ধান্দা করবে না।
নতুনভাবে যদি পুরাতন দলও আসে, আমার নির্বোধ প্রত্যাশা থাকবে; আওয়ামী লীগ যেভাবে থানাকে পার্টি অফিস বানিয়েছিল, ডিসি অফিসকে এমপি অফিস বানিয়েছিল, মন্ত্রণালয়কে মন্ত্রী অফিস বানিয়েছিল, ভিসি-অফিসকে পার্টি অফিস করে তুলেছিল, লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের দলীয়কর্মী করে তুলেছিল, বাংলা একাডেমি-শিল্পকলা একাডেমিকে করেছিল দলীয় গবেষণাগার, তারা যেন সেটা না করেন। দীর্ঘমেয়াদে তাতে আসলে তাদেরই অমঙ্গল। আওয়ামী লীগের এই পরিণতি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। নির্দলীয়করণে প্রতিষ্ঠানেরও মঙ্গল, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে দেশছাড়ার পথ খুঁজতে হবে না। কেউ কিন্তু সরকারের চাকরি করে না, করে রাষ্ট্রের। সরকারপ্রধানও রাষ্ট্রের চুক্তিভিত্তিক চাকুকেজীবী। সরকারি চাকুরিজীবী বলে বলে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বানিয়ে দেয় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের। প্লিজ, আর না। রাজনীতিতে সাংবাদিক, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নহীন আনুগত্য ও অকারণ তোষামোদ যে কোনো সরকারের (পড়ুন দলের) সবচেয়ে বড়ো ক্ষতিটা করে। কারণ তখন আর ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার কেউ থাকে না। অন্যের স্বাধীনতাসত্তা হরণ করার মধ্য দিয়ে নিজের স্বাধীনতাসত্তা অরক্ষিত হয়। বিগত সরকার সেনাবাহিনীকে পুরো দেশটাই যেন দিয়ে দিয়েছিল ক্ষমতায় থাকার জন্য, বেনজীরদের দিয়েছিল দুর্নীতির লাইসেন্স। তাতেও কাজ হয়নি। একশো বছরের বুড়ো একটা সামান্য পাথরে হোচট খেয়েও মরে যায়। কারণ বয়স হয়ে গেলে মৃত্যু একটা উছিলা খোঁজে মাত্র। দুর্বল পা পচাশামুকেই কাটে। এই কারণে সামান্য ছাগলের জের ধরে পতন ঘটে প্রতাপশালী মতিউরদের। কোটা আন্দোলনের মতো নির্দোষ আন্দোলনের জের ধরে পতন ঘটে মাইটি সরকারের। ক্ষমতা কোথাও চিরস্থায়ী না, পণ্যের মতো ক্ষমতারও এক্সপায়ার ডেট থাকে; তাই এক্সিটটার কথাও ভাবতে হয়। মৃত্যু তো থামানো যাবে না, কিন্তু মরে যাওয়র পর মানুষ যেন লাশ ছুড়ে না দেয়, সে জন্যই মানুষ জীবনে কিছু বন্দোবস্ত করে। এখন যারা শাসনক্ষমতায় আসবে তাদের কাছে আমার এই সামান্য প্রত্যাশা। হয়তো এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সামান্য কিছু নতুনত্ব—ক্ষমতায় থাকা না, সম্মানের সঙ্গে বিদায়টা নিশ্চিত করা। যে আসবে তাকে ধরেই নিতে হবে চিরকালের জন্য আসেনি, যেতে হবেই। এই বিশ্বাসটার মধ্যে কিছু নতুনত্ব আছে।
তবে, কিন্তু, মনে রাখতে হবে, ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ক্ষমতায় থাকে মাত্র কয়েকশ মানুষ। তাই ক্ষমতা বদল করার জন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠী না বদলালে কিচ্ছু হবে না। জনগণ যদি অন্ধ চাটুকারিতা, প্রশ্নহীন সমর্থন এবং বিবেচনাহীন বিরুদ্ধচারণে মেতে ওঠে তাহলে শাসক বদল হবে, শাসকের স্বভাব না।
আর, যারা মনে করছেন, বিগত শাসনামলে বাকস্বাধীনতা ছিল না, তাদের বলছি, আপনারা এখনো সেটা পাবেন না। বাকস্বাধীনতা কেউ দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। বাকস্বাধীনতা বাইরে থেকে আসে না, ভেতর থেকে উৎসারিত হয়। এটা প্রথত এবং প্রধানত আত্মচর্চার বিষয়। যারা মুক্তচিন্তা করেন, তারা প্রকাশেও মুক্ত। যারা চিন্তার দাস, তাদের মুক্ত করে দিলেও দাসত্ব খুঁজবেন। ড ইউনূস কাউকে এখনো দাস হতে বলেননি, কিন্তু তাঁর ক্ষমতা নিশ্চিত হওয়ার পর আপনিই দাসত্বের শিকল জড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর দিকে, যাচ্ছেন না? যদি না যান, কোনোদিনই আপনাকে যেতে হবে না, আপনি মুক্ত, বিশ্বাস রাখেন।
এবার, প্রধান ছাত্র সমন্বয়কদের বলছি, মনে রাখবেন,আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটা পর্যায়ের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও অগ্রনায়ক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই আওয়ামী লীগের যখন এইভাবে পতন ঘটলো, এবং সেই অগ্রনায়কের যখন এই করুণ পরিণতি ঘটাচ্ছে উগ্র জনতা, তখন নতুন স্বাধীনতা আনার জন্য জাতীয় মর্যাদা আপনারা পেলেও আপনাদের ভবিষ্যৎকর্মই কিন্তু আপনাদের ‘এক্সিট’ নির্ধারণ করবে। ফলে এখন দায়িত্ব আরো বেশি। যে মানুষ অন্ধবিশ্বাস করছে আপনাদের, তারাই কিন্তু একদিন ছুঁড়ে দেবে। বুক একটুও কাঁপবে না ওদের। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে যাচ্ছে, ভস্ম হচ্ছে ৩২, ওদের কারো বুক কাঁপছে না। আপনারা ওতো বড়ো নেতা এখনো হননি, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো নেতা হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু আছে। মানুষের সম্ভাবনা অনিঃশেষ, এটা শুধু বিশ্বাস না, বিজ্ঞানও।
এত কথা বলার আমি কে?
ভাষা, ধর্ম, জাতীয়তা, দেশ, দলীয় রাজনীতি—এসবের উর্ধ্বে আমার বিশ্বাস মানুষে। আমার বিশ্বাস আপনার উপরে। আমার মৃত্যু হলে আপনার হাতেই হবে, আমার সর্ব-মানবিক চৈতন্যের উন্মেষ আপনিই ঘটাবেন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন