বেশিরভাগ ডাক্তার এবং মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে আপনার মনে হবে আমরা নির্বাক যুগে বাস করি। এখনো মৌখিক কিংবা লৈখিক ভাষা আবিষ্কার হয়নি। এমন নয় এবারই প্রথম—এর আগেও, যুগে যুগে যত সমস্যা, যত ঝড়-ঝঞ্ঝা এসেছে, তারা এমনই ছিলেন।
বিস্ময়ের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ইয়া লম্বা হয় আমাদের শিক্ষকদের দিকে তাকালে। না প্লিজ, ভুল বুঝবেন না। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, জি.সি দেব, আব্দুর রাজ্জাক বা মুনীর চৌধুরীর মতো শিক্ষক আমরা আপনাদের কাছে ওয়াইল্ডেস্ট ড্রিমেও আশা করি না। দেশে এতগুলো সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, আপনাদের হুংকারে হাসপাতালের ওয়ার্ড কেঁপে ওঠে, আপনারা উঠতে-বসতে মানবিকতা আর নৈতিকতার লেকচার দেন।
কিন্তু আফসোস!
একজন আসিফ নজরুল, গীতি আরা নাসরিন, সামিনা লুত্ফা, কিংবা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মতো শিক্ষকও আমরা পাইনি যিনি সাধারণ শিক্ষার্থীর হয়ে কথা বলছেন। এমন কাউকে পাইনি যাকে নিয়ে আমরা মন থেকে গর্ব করতে পারি।
আফসোস!
৫০ বছর আগে নিহত হওয়া জাতির রূপকারের জন্য কষ্টে আপনার বুক খাঁ খাঁ করলেও;‘বিনম্র শ্রদ্ধা’য় আপনার পিঠ, মাথা, শরীর একসাথে নুয়ে পড়লেও—গত অর্ধমাসে নিহত হওয়া ২৬৬+ মানুষের কষ্ট আপনাকে স্পর্শ করে না। আপনার শোক শুধু অগাস্টের জন্য পূর্ব বরাদ্দ।
কী লজ্জা!
.
১৯৬৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাস। স্বাধীনতার উদ্দীপনায় ক্ষুব্ধ তখন সারাদেশ। বাংলা একাডেমি-কার্জন হলের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে যাচ্ছে টগবগে মানুষের দীর্ঘ মিছিল। তখন দেখা যায় রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বেশভূষা দেখে বোঝা যায়, প্রতিদিনের মতই বাংলা একাডেমিতে যাচ্ছেন। তখন আঞ্চলিক অভিধান সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
তাঁকে দেখামাত্রই দেড়শো দুশো মানুষের দল ছুটে গিয়ে মিছিলে যোগ দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করে নিয়ে আসলো। ভাষা আন্দোলনের আগে-পরে মিলিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ড. শহীদুল্লাহ্ ছিলেন বাঙালি চেতনার প্রতীক। তিনি যোগ দেওয়ায় মানুষের উদ্দীপনা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো।
ড. শহীদুল্লাহ্ মিনিট দু-তিন মিছিলে হাঁটার পর হঠাৎ করেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় চাইলেন। সবাই মিছিলে থাকার জন্যে তাকে অনুরোধ জানালে তিনি হাতসুদ্ধ ঘড়ি বাড়িয়ে পরিচিত ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন- 'ডিউটি, আঁ ডিউটি...’
(কথার ভেতর সবসময় 'বুঝেছ' বা 'বুঝেছেন তো' কথাটার অনুভূতি বোঝাতে 'আঁ' বলতেন তিনি)
এর অর্থ হলো, সবার যুদ্ধক্ষেত্র আলাদা। সবাই জোন অব আর্ক বা স্পার্টানদের মতো ওয়ারিয়র হবে না। যুদ্ধের ময়দানে কেউ হবে সান জুর মতো স্ট্রাটেজিস্ট, কেউ হবে মুজিবের মতো ওরাটর, কেউ ফরাসি বিপ্লবে রুশো, মন্টেস্কু, ভলতেয়ারের মতো হাল ধরবে, কেউ হবে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল—আর কেউ হবে সুবিধাবাদী ইতর। এই ইতরের দল পা না ভিজিয়ে, বুট পরে গাড়িতে বসে সমুদ্র দেখতে চায়। কিন্তু এরা জানেনা যে—সমুদ্র দেখার আসল স্বাদ খালি পায়ে সমুদ্রের পায়ে দাঁড়িয়েই কেবল পাওয়া যায়।
.
অথচ আপনারা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কোনো পুলিশের বাপের সাধ্য নাই আপনাদের উপর কথা বলে, গায়ে হাত তোলে। অথচ আপনাদের সে সময় কোথায়?
ড. শহীদুল্লাহর মতো আপনাদের আছে 'চেম্বার, আঁ চেম্বার...!'
ডা. সজীব সরকার (৩০) ঢাকা থেকে ছোটো ভাইকে বাসায় আনতে নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। বুকে লাথি দিয়ে পুলিশ তাকে গুলি করে। দেশের এতো মানুষের কথা থাক, নিজ কম্যুনিটির ডা. সজীবের মৃত্যুও আপনাকে বিচলিত করেনি। আপনারা আসলে কীসের অপেক্ষা করছেন? আপনার সন্তানের মৃত্যুর? কিংবা আপনার নাতি-পুতির ছাদে খেলতে গিয়ে চোখ দিয়ে বুলেট ঢুকে মাথা দিয়ে বের হবার?
আপনারা প্লিজ ভাববেন না—আমরা আপনাদের চিনি না। আমরা আপনাদের চিনি। আর আপনারা কারা? ভবিষ্যৎ আমরাই তো! হাতে গোনা দুই তিন জন ছাড়া আপনারা আমাদের মুখে 'স্যার' ডাকই শুনেছেন, কিন্তু ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধা পাননি।
এই দুঃখ কোথায় রাখবেন?
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন