আর পারি না, খুব হয়রান লাগে : একান্ত সাক্ষাৎকারে বনের 'রাজু' যুবরাজ

১৯৯৭ পঠিত ... ১২:২১, নভেম্বর ০১, ২০১৭

সিংহকে আমরা ছোটবেলা থেকেই বনের রাজা হিসেবই জানি। চিড়িয়াখানায় খাঁচায় বন্দী সিংহের সেই বন্য রাজত্ব কতটুকু আছে বা থাকে, সেটা প্রশ্নের বিষয় তো বটেই। তবে রাজত্ব থাকুক না থাকুক, রাজা যে রাজার মতো আয়েশী ভঙ্গীতে থাকবেন, এমনটাই তো স্বাভাবিক, এমনটাই হওয়ার কথা। অথচ কুমিল্লা চিড়িয়াখানার সিংহ 'যুবরাজ' অযত্ন, অপুষ্টি আর অসুস্থতার কারণে ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছে মৃত্যুর দিকে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, তার বয়স ১৮ (যা একটি সিংহের জন্য অস্বাভাবিক) এবং সে তার বয়সের কারণে মৃত্যুর দিকে পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু সিংহ যুবরাজ সাহেবের ছবি থেকেই বোঝা সম্ভব যে শুধু বয়স নয়, অযত্ন আর অবহেলাই এর এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। 

যেহেতু কুমিল্লা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো লাভ নেই, কারণ যোগাযোগ করে লাভ হওয়ার মতো দায়িত্বশীল তারা হলে যোগাযোগ করার প্রয়োজনটাই পড়তো না, আমরা সরাসরি কথা বলেছি যুবরাজের সঙ্গে। অসুস্থ অবস্থায় যদিও তিনি ঠিকঠাক সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি, তবুও আমাদের প্রতিবেদক উনার ইশারা ইঙ্গিত এবং মুখভঙ্গি থেকে অনেক তথ্য অনুবাদ করে নিয়েছেন।

eআরকি: রাজা সাহেব, জেগে আছেন?

(বনের রাজা চোখ বুঝে পড়ে ছিলেন। কথা শুনে একটু চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলেন। তারপর আবারও চোখ বুজে ফেললেন)

যুবরাজ: আর থাকা। বাঁইচা আছি, এইটুক টের পাই।

eআরকি: এখানে আসার আগে কী আপনি মিডিয়ায় কাজ করতেন? পরিচিত লাগছে।

: (এবার চোখ খুলে খুশি খুশি চেহারা করে, কথায় যেন আগ্রহ পেলেন) আপনার মনেও আছে নাকি? টম এন্ড জেরির কার্টুন শুরু করার আগে গর্জন করার কাজ করতাম। গর্জন করেই যেতে হলো শুধু, জুনিয়র আর্টিস্টের তকমাই থেকে গেল, ভালো পেলাম না। আরও বেশি অডিয়েন্স ধরার জন্য পরে চিড়িয়াখানায় আসা। জীবনটা নষ্ট হইলো, আর কিছু না।

eআরকি: সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার একটা ছবি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। আপনি কি অসুস্থ? ব্যাপার কী বলবেন একটু। চিড়িয়াখানার লোকজন কি অযত্ন করতেছে আপনার?

যুবরাজ: অযত্ন! হাহাহা! (একটু থেমে শ্বাস নিয়ে) যত্ন কী জিনিস ভাই? কখনো পাই নাই বলে যত্ন কী আর অযত্ন কী বুঝতে একটু অসুবিধা হয়!

eআরকি: খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো পান?

যুবরাজ: হ্যাঁ, খাওয়া দাওয়া নিয়মিতই পাই। ওরা রেগুলারিটি মেইনটেইন করে খুব। প্রতিদিনই খানিকটা পচা বাসি মাংস দেয়, ভুল করেও তাজা কিছু দেয় না...

আরকি: আর অসুখ-বিসুখ? রোগবালাই?

যুবরাজ: মানুষ বাদে অন্য পাবলিকদেরও যে অসুখ বিসুখ আছে, এইটাও আদৌ ওরা জানে বলে এদ্দিনে মনে হয় নাই। একবার দেখলাম একজন ডাক্তার এলেন, পরে দেখি আমার খাঁচার ভেতর থাকা টিকটিকিটার চিকিৎসা করতে আসছে, করে চলে গেলো। আমার তো হাঁটাচলার শক্তি নাই, উঠে গিয়ে কোনো সমস্যার কথা বলতেও পারি নাই।

eআরকি: কী বাজে ব্যাপার! কিন্তু কর্তৃপক্ষ বললো আপনার নাকি বয়স ১৮ হয়ে গেছে, এইগুলা নাকি বার্ধক্যের কারণে...

যুবরাজ: ভাইরে, মানুষ যে কী ধরণের প্রাণী বুঝি না। নিজেদের বয়স কমায়ে বলে, অন্য প্রাণীদের বয়স বাড়ায়ে বলে। আমার বয়স বাড়ায় বলার কারণ কী ছিল বুঝলাম না, আমার তো আর ভোটার আইডি কার্ডের দরকার নাই!

eআরকি: এই যে আপনি বনের রাজা, আপনার সঙ্গে এমন ব্যবহার, এত অবহেলা, আপনার প্রজারা ক্ষেপে যায় না?

যুবরাজ: রাজা তো আমি বনে ছিলাম। এই খাঁচার মধ্যে এখন তো আর রাজা নাই। খাঁচার ভেতর কেউ রাজা থাকে না, রাজু হয়ে যায়। আমি এখন বনের রাজু। এরাও আমারে যুবরাজ ডাকে না, রাজুই ডাকে। রাজার প্রজা থাকে, রাজুদের প্রজা থাকে না, সর্বোচ্চ থাকে লালী টাইপ গরু।

eআরকি: আপনাকে কেউ দেখতে আসেনি এর মধ্যে? চিকিৎসক কেউ?

যুবরাজ: এসেছিলেন। তবে চারুকলার ছাত্র। তারে নাকি সিংহের কঙ্কাল আঁকার কাজ দেওয়া হয়েছে! মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেলেও সিংহেরটা তো পাওয়া যায় না। কোথাও তা না পেয়ে সে আমারে দেখে সিংহের কঙ্কাল এঁকে ফেলছে। শুনছিলাম, ওই অ্যাসাইনমেন্টে নাকি হাইয়েস্টও পেয়েছে... সিংহের এত নিখুঁত কঙ্কাল নাকি টিচারদের কেউ কখনো দেখে নাই!

eআরকি: আপনার খাঁচায় আপনার রাইভাল গ্রুপ বাঘ মিয়ার খালা মানে বিড়ালকে দেখলাম। ওর কাজ কী?

যুবরাজ: একবার খাঁচায় ঢুকে পড়ছিলো। আমার যে অবস্থা, দেখতে আসা মানুষরা ওকেই সিংহ ভেবে নিয়েছে। এরপর থেকে খাঁচায় ঢুকে সিংহের ভাব নিয়া বসে থাকে। মানুষ ওকে সিংহ ভেবে ছবি টবি তোলে। মাঝেমধ্যে এত ওভার কনফিডেন্ট হয়ে যায়, পারলে আমাকেও চা-বিড়ি আনার অর্ডার দিয়ে ফেলে! ওর অবশ্য আরও উদ্দেশ্য আছে...

eআরকি: কী রকম?

যুবরাজ: ওই যে গল্প পড়ছেন না একবার? সিংহ বিপদে পড়লো, একটা ইঁদুর এসে জাল কেটে বাঁচাইলো...

eআরকি: আপনার ভগ্নদশার ছবি ভাইরাল হওয়ার পর আপনার যথাযথ যত্ন নেয়া এবং চিকিৎসার জন্য ফেসবুকে একটা ইভেন্ট খোলা হয়েছে দেখছেন?

যুবরাজ: (খুব কষ্টে হাই তুলে) ও, হ্যাঁ, নোটিফিকেশন আসছিলো, মেসেজ টোন শুনছিলাম। আমাকে ট্যাগ করছে মনে হয়। নোটিফিকেশন চেক করার এনার্জি ছিল না। ইভেন্ট খোলার নতুন কিছু পাওয়া গেছে, আপাতত মনে হয় সবাই এতেই খুশি।

eআরকি: আগেকার শৌর্য-বীর্যে ভরা রাজকীয় দিনগুলোর কথা কি মনে পড়ে?

যুবরাজ: পড়ে না আবার? আমার দাদা নিজে ডিজনির লায়ন কিং ছবিতে লিড রোলে অভিনয় করেছে। স্টার মানুষ। আমি হয়তো অত বড় হইতে পারি নাই, কার্টুনে গেস্ট এপিয়ারেন্স করতাম। তাই বলে এই দিন দেখতে হবে, কোনোদিন ভাবি নাই!

eআরকি: এ অবস্থা থাকে কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেন?

যুবরাজ: জানি না। আর পারি না, খুব হয়রান লাগে।

এই পর্যায়ে খাঁচার ভেতরে থাকা বিড়াল যুবরাজকে 'ওই রাজু ওই রাজু' বলে টিজ করতে থাকে। যুবরাজ আবেগপ্রবণ হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো দেখে আমারাও উনাকে আর কষ্ট দিতে চাইনি। প্রাণীদের কষ্ট দিতে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষরা তো আছেনই, অন্যদের সেজন্য আর কিছু করার কী দরকার! তবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কালো বিড়ালটি ফিসফিস করে জানালো, 'ভাই একটা বিষয়, পারলে মিডিয়াতে একটু প্রচার করবেন, আমি আসলে বিড়াল না, আমি ব্ল্যাক প্যান্থার। খাওয়ার অভাবে আজ আমার এই অবস্থা। কেউ বিশ্বাস করে না, আপনি ভালো মানুষ। আপনি বিশ্বাস করবেন।'

১৯৯৭ পঠিত ... ১২:২১, নভেম্বর ০১, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top