যেভাবে খুব সহজেই আপনি ফেসবুকে বুদ্ধিজীবী হওয়ার ভাব ধরতে পারেন

৪৬৮২ পঠিত ... ২০:৫৮, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৯

আপনি কি বুদ্ধিজীবীদের বুঝতে চান? 

আপনি কি বুদ্ধিজীবী ভাব ধরতে চান?

আপনি কি বুঝতে চান কেউ বুদ্ধিজীবী ভাব ধরতেছে কিনা? 

 

উপরের প্রশ্নগুলির একটাতেও যদি  আপনার উত্তর হ্যা হয়, তাহলে এই লেখাটা আপনার জন্যে।

[পাঠকরে প্রশ্ন করে আবার সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়া শুরু করা লেখার যে তরিকা এইটা কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের এড়াইতে হবে। এই ফরম্যাট সেলফ-হেল্প তরিকার ফরম্যাট]

    

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন বুদ্ধিজীবী ভাব ধরা কঠিন কিছু। ব্যাপারটা এমন কঠিন কোন কর্ম না।

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন হইলেও বুদ্ধিজীবী হওয়ার চেয়ে বুদ্ধিজীবী ভাব ধরা সোজা। এই ভাব ধরাটা  জাস্ট প্রেজেন্টেশনের ঝকমারি। বুদ্ধিজীবীতার আসল ব্যাপার হইলো পাবলিক আপনারে বুদ্ধিজীবীসুলভ লোক মনে করে কিনা। আজ ধাপে ধাপে আমরা শিখবো, কীভাবে চাইলে সহজেই বুদ্ধিজীবী ভাব ধরা যায়।

 

১# জার্গন কিংবা বুদ্ধিজীবীর ভোকাবুলারি  

জ্ঞানের প্রতিটি শাখার (বুদ্ধিজীবী হিসেবে আপনার বলা উচিৎ 'ডিসিপ্লিন') কিছু জার্গন থাকে, যা চাইলে প্রায়ই সহজ, বোধগম্য ভাষায় বলা যায়। বুদ্ধিজীবীর কাজ হইতেছে সেইটা কঠিন করে বলা। অনেক সময় বিকল্প থাকে না ঠিক, কিন্তু সহজ বিকল্প থাকতেও কথাকে জটিল করে বলার চল আছে।

যেমন: 'এইটা ক্ষতিকর'- বলা যাবে না। বুদ্ধিজীবী হিসাবে আপনাকে বলতে হবে 'এটির নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে'।

'সহজ কথা জটিল করে বলা বুদ্ধিজীবীর কাজ। জটিল কথা সহজ করে বলেন শিল্পী।' এইটা বেশির ভাগ সময় সত্যি হইলেও সবসময় না। কারন, যেহেতু এই বানীটা দিছেন একজন শিল্পী, চার্লস বুকোভস্কি, শিল্পীদের প্রতি তার বায়াসড থাকা স্বাভাবিক।  

বইকে ভুলেও বই বলবেন না। এমনকি গল্প উপন্যাসকেও না। সব ধরনের বইকে অবশ্যই বলতে হবে 'টেক্সট'। বই, রচনা, কবিতা, প্যারাগ্রাফ সবকিছুর কমন নাম টেক্সট। 

ব্যক্তি, পারসন এমনকি ইন্ডিভিজুয়ালও বলা যাবে না। 'গেরামের আন্ডা'র শহরে আইসা অমলেট হয়ে যাওয়ার মতো ব্যক্তির ইন্টেলেকচুয়াল জগতে হয়ে যেতে হবে 'সাবজেক্ট'।

কয়েকটা নমুনা নিচে দেওয়া হলো (আপনি লিখবেন নিম্নরূপ):   

 

ফ্যাসিবাদী

সবচে বেশি এবিউজড হওয়া শব্দের নাম ফ্যাসিবাদ।

আপনার কাউরে পছন্দ হয় না? তাকে ফ্যাসিবাদী বলে দিন।

আপনি এই ব্যাপারে আমার সাথে এক মত না? তাহলে আপনি নিজেই ফ্যাসিবাদী!  

 

হায়ারার্কি

রাজনৈতিক দর্শন বা ক্রিটিক্যাল থিয়োরি নিয়ে বুদ্ধিজীবীতার ভাব নেয়ার জন্যে আপনারে জানতে হবে, হায়ারার্কি মানে কিন্তু উচ্চস্তরের ইয়ার্কি না। হায়ারার্কি কথাটার আক্ষরিক অর্থ স্তরবিন্যাস। উপর থেকে নিচ বা নিচ থেকে উপড়ে শ্রেণিবিভক্ত করা। সমাজে বা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন মাত্রার ক্ষমতা/কর্তৃত্বের স্তরবিন্যাস হলো হায়ারার্কি। অতি সরলীকরণ করে বললে, ছোট-বড়, উঁচু-নিচুর ভেদবিধি। 

 

হেজিমনি

বুদ্ধিজীবী হিসেবে যদি একটামাত্র শব্দও আপনি শিখেন, শব্দটা হওয়া উচিৎ হেজিমনি। এইটা কোনো হেঁজিপেঁজি শব্দ না, সোনামনিরা, খুবই ওজনদার শব্দ। শব্দটা নিয়া তাই বিশদে বলা ফরজ।

শব্দটা ইতালির বিখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্তনীয় গ্রামসির রাজনৈতিক দর্শনে বিখ্যাত অবদান। হেজেমনি কথাটার সহজ বাংলা এক শ্রেণির লোকের অপর শ্রেণিগুলির উপর আধিপত্য। সেই আধিপত্য হইতে পারে, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা মানসিক।  

আন্তনীয় গ্রামসি সম্পর্কে দুই একটা এনেকডোট পাঞ্চ করে দিতে পারলে তো কথাই নাই। আপনি নিজেই  আলাপকালীন হেজিমনি ক্রিয়েট করে ফেললেন!   

মার্ক্স মনে করতেন, পুঁজিবাদের একমাত্র চালক অর্থনৈতিক শোষণ না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা চালু রাখতে রুলিং ক্লাসের ধ্যান-ধারণা আর মূল্যবোধের আধিপত্য শ্রমিক শ্রেণিরে তারা যে শোষিত হইতেছে তা উপলব্ধি করতে ও বাঁধা না দিতে সাহায্য করে। এঙ্গেলস একে বলছেন, ফলস কনশাসনেস। আন্তনীয় গ্রামসি জীবনের বড় একটা অংশ কাটাইছেন ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির জেলে। তো, জেলে থাকাকালীন তার  নোটবুকে এই আইডিয়াটারে আরও আগায়ে নিছেন গ্রামসি। 

গ্রামসির নাম নিলে, বা হেজেমনি শব্দটা উচ্চারণ করলে একই সাথে আপনাকে ‘ম্যানুফ্যাকচার অফ কনসেন্ট’/ সম্মতি উৎপাদন কথাটাও বলতে হবে। আর নিজেরে দাবি করতে হবে একজন ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’ হিসেবে। অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল কথাটাও গ্রামসির। বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপের মধ্যে এই কথা বলতে ভুলবেন না যে ‘দেশে আসলে ‘অরগানিক ইন্টেলেকচুয়াল’দের অভাবেই ভালো কিছু হইতেছে না’।    

ফ্যালাসি, বুর্জোয়া, বায়াস, (এবং বায়াসের খালাতো ভাই ‘কগনিটিভ বায়াস’),  আইডিওলজি, পোস্টমডার্নিজম, নিওকলোয়নিয়ালিজম, ইত্যাদি এইরকম অনেক পরিভাষা আপনাকে এস্তেমাল করতে হবে।

 

২# লোকজনকে ভড়কায়ে দেয়ার প্রধান অস্ত্র: এনেকডোটস

বুদ্ধিজীবীতায় এনেকডোটসের দরকার না থাকলেও বুদ্ধিজীবী ভাব ধরতে এনেকডোটস এর ব্যবহার ব্যাপক। বুদ্ধিজীবী ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের  এনেকডোটস বা মজার ফ্যাক্ট এমনকি ট্রিভিয়াল ইনফো আপনার স্টকে থাকলে আপনি অনেকখানি আগায়ে থাকলেন।

আপনি জানেন কি, মার্সেল প্রুস্ত ছোটবেলায় দাবার পোকা ছিলেন? তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে খ্যাতিমান দাবারু হবেন?

জানেন কি ফরাসি বুদ্ধিজীবী জাক দেরিদা ছোটবেলায় প্রচুর বুলিং –এর শিকার হইছেন?  

ফেদেরিকো ফেলেনি ফিল্ম নির্মাতা হিসেবে নাম করার আগে কার্টুনিস্ট ছিলেন এবং ভালো নামডাকও ছিলো।

লুই আলথুসার তার জীবনসঙ্গীকে গুলি করে হত্যা করেন?

লোকজনরে চমকায়ে বা ভড়কায়ে দিতে এইসব ইনফো আপনার স্টকে রাখবেন। 

আরেকটা গোপন খবর বলি, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ফরাসি নামগুলির কাটতি ভালো। আলথুসার, সার্ত্র, বার্থ, বদ্রিয়া, বুরদিও, লাকা, ফুকো ইত্যাদি ডাকাবুকো বুদ্ধিজীবীদের নামের সহী ফরাসি উচ্চারণ করতে পারলে জুটবে বোনাস পয়েন্ট!  

 

৩# থিয়োরি থিয়োরি থিয়োরি এবং মনীষীদের নাম

মনে রাখতে হবে বুদ্ধিজীবীদের প্রধান কাজ ম্যাঙ্গোপিপলরে ভরকায়ে দেওয়া । সেইটা হইতে পারে, কোনো কঠিন থিয়োরির নাম দিয়া, মনীষীদের বা বইপুস্তকের রেফারেন্স দিয়া।

যেমন ধরেন, এমন ঘটনা আপনার জীবনে নিশ্চয়ই ঘটছে যে খুব জমজমাট বিতর্কের সময় দরকারি কথা/যুক্তিটা ভুলে গেছেন, পরে মনে পড়লে আফসোস হইলো’ আরে এইটা তখন বলতে পারলে কী দারুণ হইতো!  এই সিম্পল পরিস্থিতিটারও কিন্তু বেশ তাত্ত্বিক একখানা নাম আছে। ‘স্পিরিট অফ স্টেয়ারওয়ে’ বা ‘সিঁড়ির ভূত’-তত্ত্ব। মানে সিঁড়ি দিয়া নামতে নামতে যখন মনে পড়ে সেইটা বুঝাইতে এই নাম।  

অথবা আপনি হয়তো জানেন যে ‘খায়া শেষ করে দিবো’ বলা একটা জোক চালু আছে দেশে। 

: এই পুঁজিবাদ, কর্পোরেশনগুলির নগ্ন শোষণের বিরুদ্ধে কী করতে পারো?

: খায়া শেষ করে দিবো। ফতুর করে দিবো।

আপনি জানেন কি এইরকম ‘খায়া শেষ করে দিবো টাইপ’ একটা থিয়োরি আসলেই আছে?  নাম এক্সিলারেশনিজম। এই থিয়োরি নিয়ে পলিটিক্যাল ফিলসফাররা সিরিয়াস বইপত্র লিখতেছেন।  

মার্ক্স থেকে শুরু করে ক্যাপিটালিজমের শেষ কিভাবে হবে তার অনেক রকম তত্ত্বায়ন হইছে। এক্সিলারেশনিজম সেসবের একটা।

এক্সিলারেশনিজম অনুযায়ী কঞ্জাপশনরে এক্সট্রিমে নিয়া যাইতে হবে। এক্সট্রিমে নিয়াই র‍্যাডিকেল চেঞ্জ আনা যাবে। কারণ বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা প্রলোভনের উপরে দাঁড়ানো।

[ভাবি, আপনার মেয়ে ( বা ছেলে)টা এত্তো ভালো রেজাল্ট করে। রহস্য কী?

ও তো প্রতিদিন কমপ্লান খায়, ভাবি। 

এই যে কমপ্লান খাওয়া টাইপ লাইফস্টাইল বা এক্সপেরিয়েন্স- এর প্রলোভন , এটা ছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা ঠিকমতো কাজ করে না।]

কঞ্জাপশনের যে প্রলুব্ধ করা শক্তি ওইটারে নষ্ট করে দিতে হবে প্রচুর ভোগ করা দিয়া।

এক্সিলারেশনিজম থিয়োরির মূল কথা, পপ ল্যাংগুয়েজে বললে, কনসিউম লাইক ক্রেজি। কন্ট্রিবিউট টু সোসাইটি।

কী নাম? হ্যা এক্সিলারেশনিজম। তিনবার আদবের সাথে উচ্চারণ করেন, ‘এক্সিলারেশনিজম। বুদ্ধিজীবী ভাব ধরতে এইরকম অনেক ‘-ইজম’ এর নাম জানতে হবে আপনারে।

 

৪# বিদেশি ভাষায় উদ্ধৃতি এবং রেফারেন্স  

শিল্পীর যেই গ্ল্যামার বুদ্ধিজীবীর তা নাই। বেশিরভাগ লোকের কাছেই বুদ্ধিজীবীতা তেমন কুল ব্যাপার না হইলেও সুসান সনটাগের মতো অনেকের লোকের কাছে (বিশেষ করে যারা 'স্যাপিওসেক্সুয়াল!) 'ইন্টেলেক্ট ইজ সেক্সি'*।

যাহোক, এই অঞ্চলে বুদ্ধিজীবীতার ১ম শর্ত হইতেছে কারণে-অকারণে বিদেশী ভাষায় উদ্ধৃতি দিতে পারা।

আপনার অডিয়েন্সের মধ্যে কেউ ইতালিয়ান জানে না?

তাতে কী? ২-১টা উদ্ধৃতি ইতালিয়ানেই দিবেন। পাণ্ডিত্য জাহির হবে। বইয়ের এডিশান ও পৃষ্ঠা নাম্বারসহ বলতে পারলে এক্সট্রা পয়েন্ট।

একটা প্রবন্ধের কথা মনে পড়তেছে। লেখক একটা উদ্ধৃতি দিছেন, জার্মান, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়। লেখক নিজে, যতদূর মনে পড়ে, জার্মান ভাষা জানেন না। বেশিরভাগ পাঠকের তো জানার সম্ভাবনা আরও কম।

লেখক নিজেই যেই ভাষা জানে না, তা উদ্ধৃতি দেওয়ার কী ব্যাখ্যা হইতে পারে?

তিনি বুদ্ধিজীবী। এইটা বুদ্ধিজীবীতার সিগনাল।

কোনো ইংরেজি বইয়ে দেখছেন জার্মান উদ্ধৃতি। মনে করছে এইটা উদ্ধৃত করলে হেভি ইন্টেলেকচুয়াল মনে হবে। তা মনে হয়ও।

হাস্যকর মনে হইলেও এইটা সত্যি যে খালি একজোড়া ইনভার্টেড কমাও পাঠকের সমীহ আদায় করতে পারে অনেক সময়!

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে  কিছু চেষ্টা চরিত্র করলে আপনিও বুদ্ধিজীবী ভাব ধরতে পারবেন। তবে একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। ভুলেও ইয়ার্কি করবেন না। লঘুতা বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার নাম্বার ওয়ান বাধা। 

সবসময় সচেতনভাবে গাম্ভীর্য্যের চর্চা করুন। রাশভারি ভাব ধরে রাখুন। খুব অল্প পরিমাণে হাসতে পারেন, তবে ভুলেও দাঁত বের করে হাসবেন না।  

চেষ্টা করলে, অবশ্য, না পারার কিছু নাই যেহেতু শিব খেরা বলছেন, তুমিই জিতবে (You can win**)।

 

যাওয়ার আগে আরেকবার রেফারেন্সের মনে করায়ে দিয়ে যাই। বুদ্ধিজীবীতার বিষয়ে  কবির সুমন বলেছেন:

১মত আমি রেফারেন্স চাই

২য়ত আমি রেফারেন্স চাই

শেষ পর্যন্ত রেফারেন্স চাই

 

*সুসান সন্টাগের জার্নাল ২য় খন্ডে (As Consciousness Is Harnessed to Flesh: Journals and Notebooks, 1964-1980)

এই যে রেফারেন্স দিয়া বুদ্ধিজীবীতা দেখানোর জন্যে আরও এক ধাপ আগায়ে গেলাম!

** উদ্ধৃতি একাধিক ভাষায় দিলে এক্সট্রা পয়েন্ট। ব্রাকেটে তাই ইংরেজি!

৪৬৮২ পঠিত ... ২০:৫৮, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৯

Top