মেসির বিয়ে বাড়ি থেকে সরাসরি

৪৪৭৪ পঠিত ... ১৬:১৪, জুলাই ০১, ২০১৭

মেসি বিয়ের স্টেজও ছিল ফুটবলময়!

সিটি সেন্টার রোজারিওর পার্টি তখন মরিচ বাতিতে ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। গেটের সিকিউরিটি গার্ড পথ আটকালো, ঘাচু অল দো বারেদা? ইনবাইত কার্দ মো লে অস্ত্রেদা?

আমি ঘাগু মুখ করে উত্তর দিলাম, ঐশশালা কী কস?

সাথে সাথে দারোয়ান কাঁচুমাচু হয়ে বললো, ওহ স্যরি স্যার। আইয়ে সাব, ভিতরে মে যা লিয়ে সাব। উয়ো দেখা মেসি সাব, বহুত আচ্ছা প্লেয়ার হ্যায়। মাই মিস্টেক। কমা করি দিইয়্যুন!

আমি গট গট করে ঢুকে গেলাম। খ্রিস্টান বিয়ে। ল্যাটিনো কালচার। ছেলে-বুড়ো-মেয়ের দল আধা নেংটো সাজে এসেছে। এধারে ওধারে বো-টাই পরা ওয়েটারের দল। হাতের ট্রেতে লাল-নীল-বেগুনী নানা রঙের পানীয়ের পসরা।

আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো, একটু জিনের ভেজাল চলবে নাকি স্যার? নাকি মার্টিনি?

আমি বললাম, নাউজুবিল্লাহ মিন জালেক। এইসব লাল পানি বাদ দিয়ে সাদা পানি নাই? কোক-স্প্রাইট-ফান্টা?

-উনি পেপসির মডেল স্যার। কোক-স্প্রাইট রাখলে স্পন্সরশীপ যাইবো গা। মেসি, শাহরুখ খানের বিয়াতে এইসব পাইবেন না। অতো শখ থাকলে আমির খানের বিয়াতে যান।

দেশী সাজে মেসির স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোকে লাগছিল অপূর্ব সুন্দর!

আমি পেপসির গ্লাস হাতে নিয়ে একেবারে সামনের দিকে এগোলাম। ঐতো মেসি! পাদ্রী গম্ভীর গলায় কী যেন পড়ে শেষ করলেন। ওরে হাততালি চারদিকে। সবাই হাতের শ্যাম্পেনের গ্লাস উঁচু করে শুভ কামনা করলো। এদের পরকালের ভয় নাই? এদিকে বর-বউ শুরু করেছে আরেক উদ্ভট কাণ্ড। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া শুরু করেছে। আমার ভেতো বাঙালীর চোখ আর সহ্য করতে পারলো না। পেপসিতে চুমুক দিলাম। আহ পেপসি!

টুং করে কোথায় যেন একটা ঘণ্টা বেজে উঠলো। খাওয়ার ঘণ্টা। আমাদের মতো হুড়াহুড়ি করে বসার কিছু নাই। সবার খাবার জায়গা নাকি নির্দিষ্ট! শুধু শাকিরার জায়গাটা খালি থাকবে। বেচারীকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিলো, উনি আবার প্রেস কনফারেন্স করে না করেছেন!

এলো প্রথম দান। গরম গরম পেটিস। কী হলো ব্যাপারটা? যে জিনিস আমরা বইমেলার মাঠে মামার টিনের বাকসো থেকে বের করে ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে খাই, ঐটা কিভাবে আসলো মেসির বিয়েতে? খাবো না এসব, আহ্লাদ নাকি?

এলো মুরগির স্যুপ। ওয়েটার ফিসফিসিয়ে বললো, স্যারের শুয়োর-টুয়োর চলে নাকি? হালকা পর্ক ব্লাড মেশানো আছে। স্যুপে হেবি জমে।

আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম- শুয়োর ছাড়া কিছু নাই?

-আহা থাকবে না কেন? ঐ দেখেন ভেড়ার পায়ের রোস্ট!

আমি তাকিয়ে দেখলাম আস্ত ভেড়ার ঠ্যাং প্যাট-প্যাট করে তাকিয়ে আছে। তাতে মরুভূমির শুষ্কতা। আমাদের স্টারের ভেজা ভেজা লেগ রোস্ট হলে মুচমুচে পরোটা দিয়ে দুটা মেরে দেয়া যেতো। শুকনা মাংসের জাবর কাটে কোন বেকুবে?

এইবার এলো মেইন ডিশ। আর্জেন্টাইন বিখ্যাত গরুর মাংসের স্টেক। আশেপাশে সাইড ডিশ হিসেবে ছড়ানো ক্রিস্পি করে ভাজা বট, আই মিন গরুর ভূঁড়ি। আছে সুসিদ্ধ কিডনী। চুমুক দেয়ার জন্য রাখা হলো জিহবার ঠাণ্ডা স্যুপ! উপরে পরতের পর পরত গোল করে কাটা পেঁয়াজ। সাইডে ক্রিমের মতো ফেনা ওঠা আলু।

কসাইয়ের মতো ছুরিটা বাগিয়ে ধরে কাঁটাচামচে গেঁথে মাংস মুখে দিলাম। ক্যাচরম্যাচর করে চাবালাম। অহোহ! কী স্বাদ! আমার থেকে এই গরুটাই বরং জীবিত অবস্থায় ভালো স্বাদের ঘাস চিবিয়েছে!

অস্বস্তিতে পাশ ফিরে শুলাম! কী স্বপ্ন! মরার সকাল হয় না কেন?

মেসি তার বিয়েতে উপহার পেয়েছেন অর্ধশতাধিক ওভেন!

ওরে বাবা... আবার দেখি পার্টিতে ফেরত গেছি। নাহ, মেসির বিয়ে তো না! বাংলাদেশি কোন বিয়ে। আমারই কোন বন্ধু বান্ধবের বিয়ে বোধহয়। ফাজিলটা আমাদের ব্যাচেলরস ক্লাবের মেম্বারশিপ ছেড়ে দিচ্ছে।

আরে না না... ওইতো মেসি! কী সুন্দর শেরোয়ানি পরে বসে রয়েছে। লাজুক মুখে রুমাল দিয়ে হাসি ঢাকা। আর কনে? ছি ছি... তিনি সবার সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবেন কেন? লজ্জা নাই? মেয়ে মহলে ঘোমটা টেনে ন্যুজ হয়ে রয়েছেন।

এইদিকে ওয়েটার ডেকে চলেছে, এই সেকেন্ড ব্যাচ... সেকেন্ড ব্যাচ... খবরদার, ড্রাইভার ভাইয়েরা বইবেন না। আপনাদের পার্সেল আছে!

আমি টেবিলে বসলাম। ডেকোরেটরের ফুলতোলা কাঁচের প্লেট। চেয়ারের ওয়াড়ে বড় করে লেখা মায়ের দোয়া। ঠাস করে টেবিলে পড়লো বোরহানির জগ। সবুজ রঙের ঘোলাটে জগে বোরহানিটাও মনে হচ্ছে পুদিনাপাতার সস।

ওই দেখো কালো কুচকুচে পেলে। বোরহানিটা গ্লাসে ঢেলেই দুবার কুলকুচো করে মুখে চালান করে দিলেন। পাশেই ঘিয়ে-তামাটে ম্যারাডোনা। ফিসফিস করে বললেন- আস্তে খান পেলে ভাই। এই জিনিস খুব বেশী পেটে গেলে কিন্তু লস, পোলাও অতো টানতে পারবেন না।

পেলে বিরক্ত মুখে বললেন, পুদিনার ঝাঁজটা কি পাইতেছি দেখছো মিয়া? বিটলবণের টকটক ভাবটায় নাকে বাড়ি দিতেছে। খাইলাম পোলাও কম, অসুবিধা কী? দেখি, গ্লাসটা আবার ভর্তি কইরা দাও।

দুর্গার মতো দশহাতি বাবুর্চিরা বিশটা করে হাফপ্লেট এনে টেবিলে রাখলো। তাতে মুরগির মাখো মাখো রোস্ট আছে, উমদা টিকিয়া আছে, ফালি করা পনির আছে, কমলা রঙের গাজর আছে, ডায়েট করার শসা আছে, কচকচ করা কাঁচামরিচ আছে, ঝাঁজালো পেঁয়াজ আছে।

ফিসফিস করে ম্যারাডোনা বললেন, আস্তে খান পেলে ভাই। এই জিনিস খুব বেশী পেটে গেলে কিন্তু লস, পোলাও অতো টানতে পারবেন না।

আমি খুশি হয়ে উঠলাম। ডিশে করে বারোয়ারি বিতরণ করা রোস্ট আমার পছন্দ না। এইটা বরং শাহী ব্যবস্থা। একটা হাফপ্লেট সম্পূর্ণই আমার। একেবারে আমার নিজস্ব ভূবন। চাইলে পনিরটা রোস্টের সাথে গুঁজে গুঁজে খেতে পারবো, পোলাওয়ের সাথে পিশে পিশে খেতে পারবো, আমার ইচ্ছা। কারোর সাথে ঠেলাঠেলি করে পছন্দের পিস বেছে নেয়ার ঝামেলা নেই।

টেবিলের এক কোনায় চোঙা মুখে বসে আছে রোনালদো। ঠিক যেন প্রেমিকার বিয়ে খেতে আসা পাষাণ হৃদয়ের মজনু! সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে বোরহানিতে টান দিচ্ছে। খেকড়ে উঠে ওয়েটারকে বললো- ওই শুয়োরের বাচ্চা। রান না দিয়া বুকের পিস দিছোস ক্যান? রান নাই তোগো? এতো টাকা কামায়া মেসি কী মুরগি কিনে? চাইর রানের মুরগি পায় না বাজারে?

রোনালদোর পাশেই টেকো মাথার জিদান। পোলাও ভর্তি গবগবে মুখে বললো- গা... গা... আমি বুঝলাম, তিনি বলতে চাইছেন-খা খা। পাশের টেবিল থেকে ম্যারাডোনাও বললেন, গা... গা...

কোন কাচ্চীর ভেজাল নেই। একেবারে ঝরঝরে সাদা পোলাও। উপরে কিছু বেরেস্তা ছিটানো, গোল গোল টিকিয়া পোরা ভেতরে, কিছু বাদাম ছিটানো আর কাবাবচিনি। হাপুশহুপুশ খেতে গেলেই মুখ পুড়বে। বাবুর্চিরা কয়লা দিয়ে বহুক্ষণ দমে রেখেছে।

এইদিকে শুরু হয়েছে লংকাকাণ্ড। মেসির বাবা আস্ত মুরগির রোস্ট এনে তুলে দিয়েছেন ম্যারাডোনার পাতে। ম্যারাডোনা ‘আরে ছি ছি পেলে ভাই থাকতে আমি কেমনে আস্তা রোস্ট খাই’ বলে তুলে দিয়েছে পেলের পাতে। পেলে ঠেলে দিয়েছে জিকোর পাতে, জিকো পাস দিয়েছে রোমারিওর কাছে, রোমারিও টোকা দিলো বেবেতোর কাছে, বেবেতো ফিকে দিলো গোলকিপার তাফারেলের কাছে! গোল!!

তাফারেল মুখ তামা করে বসে রইলো। আসল কথা হলো, আস্ত রোস্ট খেয়ে কেউ পেট ভরতে চায় না, নেক্সট পাতে নাহলে রেজালা খাবে কে?

এলো রেজালা! টেবিলে হুড়াহুড়ি পড়ে গেলো। কেউ আগেই চামচের হাতা নিয়ে বেছে বেছে সিনার হাড্ডি বেছে নিলো, কেউ আবার চিল্লাচিল্লি শুরু করলো, আরে কী আনছো মিয়া বাটিতে। হাড্ডি ছাড়া মাংস নাই?

মেসির পানচিনির এই ছবিটি পাওয়া গেছে রোনালদোর সৌজন্যে!

রেজালা খেতে হয় তারিয়ে তারিয়ে। অল্প ঝোলে মাখানো পোলাও, একটুখানি পনিরে কামড়, টিকিয়ায় আলতো একটু চিমটি, তারপর গাপুস করে রেজালার মাংসে একটু কামড়! হাঁপসে গেলে বোরহানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে মুখ ঠিক করতে হয়।

শেষপাতে খিরের প্রলেপ দেয়া জর্দা। উপরে ছোট ছোট মিষ্টি বসানো। খুব স্বাভাবিকভাবে প্রথম দুই-তিনজনের হাত ঘোরার আগেই মিষ্টি চবাৎ চবাৎ করে খেয়ে ফেলা হলো। বাকিরা জর্দা খেয়েই প্রাণ হারাবে। কার কী আসে যায়?

আগেই পৌঁছে গেছে কাগজের প্যাকেটে মিষ্টি জর্দা দেয়া পান। বেসিনে লাইন বেঁধে এর ওর গা ভিজিয়ে হাত ধুয়ে সবাই দাঁত খেলাল করতে করতে পান চিবোতে চিবোতে ঘ্রউক ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ফ্যানের নিচে বসতে গেলো।

এদিকে মেসির বাবা চিল্লাচিল্লি শুরু করেছেন, কারোর কোন আক্কেল নাই। এখনও বিয়েটাই পড়ানো হলো না। কখন মেসি খাবে আর কখন যাওয়ার বাস ধরবে? মেসির মা আমার প্রেশারের ওষুধ কই?

মেসির বাচ্চা দুটা ছুটে-ছুটে খেলাধূলা করছে। বাংলাদেশের অন্য বাচ্চাদের মতো তাদের অন্তত পরে আর অভিমান হবে না যে, আব্বা-আম্মার বিয়েতে আমরা ছিলাম না ক্যান?

মাওলানা সাহেব হাত তুলেছেন, পরম করুনাময়, তুমি মেসিদের জীবনে শান্তি দিয়ো। উপস্থিত সবাই বিড়বিড় করলেন, শান্তি দিয়ো, শান্তি দিয়ো।

আমি বিছানায় আরামে পাশ ফিরে শুলাম। ভোর হয়ে এসেছে। মুখে তখনও যেন জাবড়ে রয়েছে মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান খাওয়ার তৃপ্তি।

গ্রাফিক্স: আবু হাসান

৪৪৭৪ পঠিত ... ১৬:১৪, জুলাই ০১, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top