উত্তরাধুনিক এইকালে সম্পর্কগুলো টেকে না। কিছুদিন পর পর তরুণ-তরুণীরা ফেসবুকে লেখে, সঠিক মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছি; ইন আ রিলেশনশিপ। আবার কী যে হয় একদিন, ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম বলেই লিখে দেয়, আই এম সিঙ্গেল এগেইন।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কগুলোও ঠিক টিকে না। এই তো গত এপ্রিলে যারা গদ্গদ হয়ে ম্যারেজ এনিভারসারির ক্যানডিড ফটো দিলো, মন্তব্যে ফেসবুক বন্ধুরা এসে, বেস্ট কাপল এভার লিখে লিখে আঙ্গুল ভেঙে ফেললো; তারপর কী যে হলো দুজন দুজনের বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ করে নিজেদের রিডিসকভার করতে লেগে পড়লো। এভাবে রান আউট হয়ে জুটি ভেঙে যায়। সম্পর্কগুলোর স্থায়ীত্ব যেন ক্রিকেট ক্রিজে আমাদের ব্যাটসম্যান-এর মতো।
সেই এলিয়েনেশনের সমাজে-ভাঙ্গনের নদীর ধারে হঠাতই চোখে পড়লো অনেকে লিখছে, ২৫ বছর ধরে প্রথম আলোর ঘর করছি!
প্রথম আলো কী রাজ্জাক নাকি বুলবুল আহমেদ যে এমন শাবানার মতো আকুল হয়ে লিখছে সবাই, শত জনমের স্বপ্ন
তুমি আমার জীবনে এলে
কত সাধনায় এমন ভাগ্য মেলে ।
সেই পিয়ং ইয়ং-এ ভোরবেলা আইস হকি খেলে এসে কফির টেবিলে বসে মিট মিট করে রোমান্টিক হাসি হেসে কিম জং উন প্রথম আলো পড়ছেন। উনি রহস্য করে বলেন, প্রথম আলো আমার টিকে থাকার অনুপ্রেরণা; একক ও অনবদ্য হয়ে ওঠার কল্পনা। সে সঙ্গে থাকলেই জিতবে উত্তর কোরিয়া।
বেলারুশের মিনস্ক শহরে জনপ্রিয়তার জরিপানন্দে বিহবল লুকাশেংকো প্রথম আলো হাতে নিয়ে বলেন, ওগো আমার জনপ্রিয়তার সঙ্গী; তুমিই তো শেখালে কী করে সবার হৃদয়ে ঠায় করে নিতে হয়। যতদিন নাশতার টেবিলে তোমার মুখ দেখবো, বুঝবো আমি ক্ষমতায় আছি। পথের বাধা সরিয়ে নিন, লুকাশেংকোকে দৌড়াতে দিন।
২৫ বছর একজন পার্টনারের সঙ্গেই থাকা মুশকিল; আর প্রথম আলোর সঙ্গে থাকা!
এটা কিম জং উন বা লুকাশেংকোর পক্ষেই সম্ভব।
হলিউডের অভিনেত্রী কেইট উইন্সলেট দুঃখ করে বলেন, প্রথম আলোকে এতো যে ভালোবাসি; অথচ সে আমায় মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার দিলো না। জানিনা কী করে জুরিদের মন পেতে হয়।
পাশ থেকে হলিউডের চলচ্চিত্রকার খ্রিস্টোফার নোলান বলেন, মনে হয় প্রথম আলোর ভাই বেরাদার হতে হয়। তার সংসার করে মন পাওয়া যায় না। এই যে তাকে এতো ভালোবাসি; কিন্তু বছরের পর বছর সে মুখ চেনা কিছু টেলিফিল্ম নির্মাতাকে পুরস্কার দেয়।
চিন্তক নোয়াম চমস্কি বলেন, আমি প্রথম আলোকে মন দিয়েছি; সে আমার যেই কলামটা তার এজেন্ডার সঙ্গে মিলে যায়, শুধু সেটাই ছাপে; আর যেটা একটু বিপ্লবী ও এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট; ওটা আর ছাপে না। আমার মনে হয়, সম্পাদক যখন প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছিলেন; তখন বেশ স্ট্রাগল গেছে তো; তাই তিনি প্রতিষ্ঠানকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই হয়তো আমার স্ট্রাগল মাখানো লেখাগুলো পছন্দ করেন না।
কথাসাহিত্যিক পাওলো কোয়েলহো পরিতাপ করেন, প্রথম আলোর সৃজনশীল ও মননশীল বইয়ের তালিকায় আমার কোন বই ধরাতে পারিনি; লেখক হিসেবে কী আমি আর টিকে থাকতে পারবো! কী করলে সাহিত্য সম্পাদকের মন পাওয়া যায় বলুন তো।
লেখক অরুন্ধতী রায় উষ্মা প্রকাশ করেন, একজন লেখকের লেখা তো সংগীতের স্বরলিপির মতো, তাতে সুর ও ছন্দ থাকে। প্রথম আলোতে লেখা দিলে, সেই যে অভিমত সম্পাদক কোন কালে সম্পাদনা করা শিখেছিলো; আর লেখকেরা তেলাঞ্জলি দিয়ে তাকে এভারেস্ট শীর্ষে বসিয়ে দেয়ায়, লেখার মাঝে সে আশুরার মিছিলের মতো চাকু তরোবারি চালায়; দুঃখ হয় অক্ষর, শব্দ, বাক্য, সুর, ছন্দের জন্য।
যে ভ্লাদিমির পুতিন প্রথম আলোর মাঝে মাঝে প্রো-এমেরিকান অবস্থানের কারণে ক্রেমলিনে প্রথম আলোর প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন, তিনিও লুকিয়ে লুকিয়ে প্রথম আলো পড়েন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন, আমি নেই, ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভেঙ্গে যায়; যেই ভাবি আর প্রথম আলোতে আমি নেই, আমি নেই।
জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানেচি লাজুক হাসি হেসে বলেন, প্রথম আলো আমাকে কোলে নিয়ে ভারসাম্য রক্ষার খেলা শিখিয়েছে। কী করে কখনো বামদিকে হেলে, কখনো ডানদিকে ঝুঁকে, কখনো বা সেন্টারে লাফ দিয়ে কী করে ব্যালান্স ধরে রাখতে হয়; সব শিখেছি ওর কাছে। জিমন্যাস্টিকস-এ প্রথম আলোই সেরা।
জাদুকর ডেভিড কপারফিল্ড বলেন, প্রথম আলোর অফিসে গিয়ে বার বার রিসেপশন থেকে ফিরে এসেছি। শুধু জিজ্ঞেস করে, বাঁশী বাজাতে জানেন কী সেই যে হ্যামিলনের বাঁশী! শুধু জাদুবিদ্যা দিয়ে চলবে না! আর খবর ভ্যানিশ করে দেয়ার জাদু শিখতে হলে এখানে ইনটার্ন হিসেবে যোগ দিন।
কিশোর আলোর সঙ্গে বেড়ে ওঠা এক সদ্য গোঁফ ওঠা যুবাকে "২৫ বছর ধরে প্রথম আলোর ঘর" করছি বলতে শুনে জিজ্ঞেস করলাম, এই ছেলে তোমার বয়স তো ২৫ হয়নি। সে পট উত্তর দেয়, চাইল্ড আর্টিস্টরা দ্রুত পাকে জানেন না। বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র।
প্রথম আলোর এক "নাম বললে চাকরি থাকবে না" সাংবাদিক জানালেন, থ্রী ইডিয়টস ছবির প্রিন্সিপ্যাল ভাইরাসের মতো একটা টেনশনের পরিবেশ আছে। কাজটা আনন্দেও করা যায়; কিন্তু ভয়ে ভয়ে টেনশনে কাজ করতে হয়। কে জানে এটা হয়তো রাম গোরুড়ের ছানা কালচার। তাই হাসতে তাদের মানা। দেখলেন না, গদ্য কার্টুনের সেই রসিক লেখকের রস কী করে শুকিয়ে গেলো। আমার তো মনে হয়, পারফেকশন একটা ব্যারাম। এই ব্যারাম প্রেম-ভালোবাসার জন্য ক্ষতিকর।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক; যারা দুজনেই প্রথম আলোর ওপরে ক্ষুব্ধ; এই পত্রিকাটা দুর্নীতির খবর ফাঁস করে রাজনীতি-ব্যবসার পেটে লাথি দেয় বলে; তারাও লুকিয়ে লুকিয়ে প্রথম আলো পড়ে; অনেকটা প্রেমিকার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করার মতো। আবার গালিতে বাঙ্গময় বাঙালি বলে প্রথম আলোকে গালি দিয়ে পুরোপুরি নিজের করে না পাবার দুঃখ মেটায় দলান্ধ খাদেমেরা। আর ধর্মান্ধ খাদেমেরা তো সারাক্ষণই রেগে থাকে প্রথম আলোর ওপর হ্যাঁচকা টানে তাদের ধর্ম-ব্যবসার মুখোশ খুলে দেয়ায়। তার অভিযোগ, প্রথম আলো ওমরাহ করে না কেন!
প্রথম আলো কাওরানবাজারে যেন আনন্দবাজার রচনা করেছে। রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজসেবা-দেশচেতনা; সব কিছুর কেন্দ্র হয়ে ওঠার বাতিক তার। এই সেন্টারের চোখে আর সবাই পেরিফেরি।
ঐ যে প্রত্যেক শহরে একটা এলিট আড্ডা থাকে না; পঁচিশজন স্যার ও ম্যাম বিভিন্ন পার্টিতে বসে রবীন্দ্র সংগীত শুনে মাথা দোলান; কার ছেলে-মেয়ে হার্ভার্ডে, আইভী লীগে পড়ছে তার গল্প করেন, ঊনবিংশ শতকের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো প্রত্ন কস্টিউম পরে এর ওর প্রগতিশীলতার পৈতে কেড়ে নেন, গালে সুপোরি পুরে দেশ চেতনার সনদ দেন, এর ওর উচ্চারণের ভুল ধরে প্রমিত শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠেন, ড্রইং রুমটাকে ফিল্মের সেটের মতো করে সাজান, নিজে মহীয়সীর মতো করে সাজেন; স্বামীকে মহীয়ান করে সাজান; সেই যে ১৭৯৩ সালের লর্ড কর্ণওয়ালিশ যেরকম করে আভিজাত্যের বন্দোবস্তী দিয়ে ছিলেন; প্রথম আলো ঠিক সেইভাবে একবিংশের এলিটিজমের বন্দোবস্তী দেয়। এ হয়তো সেই আদিম কাস্ট সিস্টেমের ক্ষত থেকে বেড়ে ওঠা গবাক তরুর সারি। অথচ সমসাময়িক বিশ্ববীক্ষার সাম্যভাবনাটাকে স্নিগ্ধ মনোভঙ্গিতে লালন করতে পারলে হয়তো ২৫ বছরের ঘর করার স্মৃতি আরো আনন্দময় হতে পারতো।
সাম্যের ঘর ছাড়া কী করে চলে আর, তাই তো কবি আহমদ ছফার মতো করে বলতে হলো, ‘ঘর করলাম নারে আমি/ সংসার করলাম না/ আউল বাউল ফকির সেজে/ আমি কোন ভেক নিলাম না।’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন