বেঁচে থাকুক শাকিব খানরা, বেঁচে থাকুক এফডিসির কালাভূনা!

৭১১৩ পঠিত ... ১০:২২, এপ্রিল ২১, ২০১৭


পেটের দায়ে পড়ে চারবার লাঞ্চ করলাম।

এতোবার লাঞ্চ করা খুব সুখের বিষয় না। খাবারের শ্যুটিং করতে বেরিয়েছি, ডিরেক্টর সাহেবের শিডিউল পাওয়া কষ্টকর। কাজেই যেদিন সুযোগ পাও সেদিন ক্যামেরা-মাইক্রোফোন নিয়ে বেরিয়ে যাও; পেটের ভেতর ঠাসো!


চার নম্বর লাঞ্চের শ্যুটিং শেষ করার সাথে সাথে মুখের মেকি হাসি ছুঁড়ে ফেলে বললাম- এইবার পেট ঠাস করে ফুটে যাবে! এইখান থেকে উঠে বাসায় যাবার সামর্থ্যও আমার নাই! একটা সিএনজি ডাকতে বলেন, তারপর কোলে করে সিএনজিতে তুলে দেন।

ডিরেক্টর চোখ কপালে তুলে বললো, বাসায় যাবেন মানে? আজকের প্রধান আকর্ষণের জায়গায়ই তো এখনও গেলাম না!

আমার ডাক ছেড়ে কান্না পেলো, কিন্তু বয়সটা উপযোগি না। মুখে আবার মেকি হাসি টেনে বললাম, আপনার কি এইটাই শেষ শ্যুটিং? মরে গেলে কাকে সাথে নিয়ে শো করবেন?

ডিরেক্টর সাহেব কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, ভাই, আমার শো করা লাগবে না। আপনি খালি চলেন আমার সাথে। ঢাকা শহরে থেকে আপনি এই জিনিস খান নাই, আমি আর একদিনও এটা মানতে পারতেছি না!

মানুষ জোর-জবরদস্তি করলে সেটা না করা যায়। এইভাবে অনুরোধ করলে কোন পাষাণ সেটা অগ্রাহ্য করে? কোনমতে একে-ওকে ধরে দাঁড়িয়ে রওনা দিলাম।

ঘণ্টাখানেক রাস্তাঘাটের ধুলোবালি, ট্র্যাফিক জ্যাম দাঁত-মুখ খিঁচে সহ্য করার পর তিনি আমায় আনলেন এফডিসির সামনে। ভুল বললাম, এফডিসির একটু আগে এক মোটর কার গ্যারেজের সামনে। হাতে গ্রিজ মোবিল লাগানো লোকজন কাজ করে চলেছে।

আমি বিরক্ত মুখে বললাম, এইখানে কী? মোবিল খাওয়াতে এনেছেন নাকি?

ডিরেক্টর গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন গ্যারেজের সামনে। ও আল্লা, পাশেই দেখি তিন-চারটা ছাপড়া হোটেল। মানুষজন ছাপড়ার মধ্যে বসেই সমানে খেয়ে যাচ্ছে।

আমি টেবিলে বসতেই ডিরেক্টরের হুকুম- ডাল ভর্তা হবে, চিংড়ি ভূনা হবে, নলার হাড্ডি আর কালা ভূনা!

পিচ্চি ওয়েটার বললো, নলার হাড্ডী শেষ হইয়া গেছে।

ডিরেক্টর এমনভাবে হাত নাড়লেন যে আমি বুঝে গেলাম নলার হাড্ডি এইখানে প্রধান চরিত্র না!

এলো পিরিচে ডালভর্তা । ওদিকে ক্যামেরা চালু হয়ে গেছে। সাদা ভাতে ভর্তা মাখিয়ে খেয়ে আমি মাথা নাড়লাম। যে কোন মানদণ্ডে এই ভর্তা ভালো। ক্ষুধা থাকলে এই জিনিস দিয়েই এক থাল খেয়ে ওঠা সম্ভব!


এলো চিংড়ি ভূনা! আহা... ঝোলের মাঝেই কেমন একটা টক-মিষ্টি স্বাদ! খোসাটা খুলে আস্ত চিংড়িটা মুখের ভেতর দিতেই মাখনের মতো গলে গেলো। কী স্বাদ। আমি আরেকটা চিংড়ি নিতে গেলাম, শ্যুটিং চলার মাঝখানেই ডিরেক্টর সাহেব চিংড়ির বাটি সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে বললেন- এইসব ছাইপাশ খেয়ে মুখ নষ্ট করার মানে কী?

ছাইপাশ? এমন রসালো চিংড়ি ভূনা ছাইপাশ? ডিরেক্টর ব্যাটার মাথাটা গেছে। এমন চিংড়ি ভূনা এখানে পাওয়া যায় জানলে তো রোজই একবার এখানে হানা দিতাম।

শ্যুটিঙের খাতিরে কালাভূনার বাটিতে টান দিলাম। একটু খেয়ে আবার চিংড়িতে ফেরা যাবে। এক্কেবারে কালো কুচকুচে রঙ! মাংসে কয়লা মেশায় নাকি? নাকি পুড়ে-টুড়ে গেলো? ভয়ে ভয়ে একটুখানি মুখে ছোঁয়ালাম।

ওরে আল্লা... কী খেলাম? জিভে যেন মিলেমিশে গেলো গরুর মাংসের ঘন সুরুয়া। তাতে কাঁচামরিচের ঝালের স্বাদ মেলে, কাটা মশলার গন্ধ মেলে, অনেকক্ষণ ধরে জ্বাল দেয়া মাংসের সুবাস মেলে। নাক দিয়ে স্পার্ক করলো পোড়া পোড়া বারবিকিউ মাংসের ঝাঁজ! আমি ঝিম মারলাম। অমৃত মুখে গেলে কথা বন্ধ হয়ে যায়!

ডিরেক্টর খুক খুক করে কাশি দিলো। নকল কাশি। মিনিট খানেকের বেশি ঝিম ধরে বসে আছি। ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ হয়ে আসছে।

আমি মাংস তুলে একটুখানি মুখে দিলাম। হাড্ডির গায়ে নামেমাত্র লাগানো। হাতের ইশারাতেই যেন খুলে চলে এলো। এই মাংস দাঁতে ঢুকবে না, মাড়িতে চাপ পড়বে না। ক্যাঁচক্যাঁচ করে দাঁতের নিচে পড়ে সুড়ুৎ করে ভেতরে চলে যাবে! গরুর মাংস এতো পিচ্ছিল!! ভুটানের মার্মালেড খেলাম নাকি?

শসা খাবার মতো কচকচ করে হাড্ডি চাবালাম। আমার দাঁতের কোন ক্রেডিট নেই, বহুক্ষণ ধরে জ্বাল দেয়া বাবুর্চির ধৈর্য্যের ক্রেডিট! এই জিনিস পেলে বাবুর বাদশাহ হিন্দুস্তানের বাদশাহি ছেড়ে কালাভূনা খেয়েই জিন্দেগি পার করে দিতেন। উনি খাওয়া-খাদ্যের কদর বুঝতেন!

ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে টিপে টিপে খেলাম। তারপর ক্যামেরা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ নিয়ে কালাভূনার বাটি ভাতের থালে উপুড় করে ফেললাম। হাপুস করে ঝোল মাখানো ভাত মুখে দেই, টুক করে চালান করে দেই টুকরাখানেক মাংস। হাড্ডি থাকলেও অসুবিধা নেই, দাঁতে পিষে যাবে। কচকচ করে কামড় দেই পেঁয়াজে, হু হা করতে করতে চুমু খাই কাঁচা মরিচের ঠোঁটে!

পাশে তাকিয়ে দেখি, আমার ডিরেক্টর সাহেব তখন ডুব দিয়েছেন কালাভূনার ঝোলে! বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে তিনিও খেয়ে যাচ্ছেন, আমিও আবার ডুব দিলাম সুখ সাগরে।

ওপাশের টেবিলে কে যেন একটুখানি কালাভূনা রেখেই উঠে গেছে হাত ধুতে! ঐ ব্যাটা কি মানুষ? নাকি সীমার? বুকে লোম নেই?

এফডিসির এই কালাভূনা খেয়েই বাংলা-বিহার-ঊড়িষ্যার নবাবের ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন আনোয়ার হোসেন, অসংখ্যবার গুলি খেয়ে মরেছেন প্রবীর মিত্র, সেলাই করা টাকায় বহুবার শাকিব খানকে বড় করে তুলেছেন শাবানা। এই পরমান্ন আজকে আমিও খেয়ে কৃতার্থ হলাম। আজকে মানে যখন শ্যুটিংটা করেছিলাম, মাস-দুয়েক আগে।

হাত ধুয়ে, ঢেঁকুর তুলে ডিরেক্টর সাহেব বললেন- কী ভাই, বলেছিলাম না?

আমি মাত্রই শেষ হওয়া কালাভূনার ভাবালুতায় তখনও আচ্ছ্বন্ন। কোনমতে বললাম- আপনার পঞ্চমবার লাঞ্চ করানোর অন্যায় আমি মাফ করে দিলাম! আজকের দিনের সর্বোচ্চ কমপ্লিমেন্ট!!

বেঁচে থাকুক এফডিসির কালাভূনা!! বেঁচে থাকুক শাকিব খানরা!

৭১১৩ পঠিত ... ১০:২২, এপ্রিল ২১, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top