ছোটবেলায় আমাদেরকে সত্যের পাতিলে ভরে অনেক মিথ্যা গেলানো হয়। আজ সকাল সকাল এমন এক ডাহা মিথ্যে আমার সামনে ধরা খেলো। শিশু অবস্থায় বইয়ে পড়েছিলাম জড় বস্তুর প্রাণ নেই। প্রাণ না থাকায় এরা নড়াচড়া করে না, খাওয়া দাওয়া-হাঁটা চলা কিছুই করে না। এমনকি এদের কোনো আবেগ পর্যন্ত নেই।
কিন্তু আজ এক রেললাইন ধরে হাঁটার সময় আমার সাথে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। ঘটনাটি এতটাই বিস্ময়কর যে কেউ বিশ্বাস করছে না। তাই eআরকির নামে চালিয়ে দিচ্ছি।
ব্যাপারটা হলো, আজ আমি একটি রেললাইনকে কাঁদতে শুনেছি। শুধু রেললাইন না, লাইনে আটকে থাকা এক পরিত্যক্ত ট্রেনও সুর মিলিয়ে কাঁদছিলো। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ একে হ্যালুসিনেশন বলে কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও সেই কান্নার শব্দ থামলো না।
বুঝতে পারছিলাম না এরকম পরিস্থিতিতে আমার কি করা উচিত। আমি ট্রেনটির কাছে গিয়ে একে আলতোভাবে স্পর্শ করলাম। কান্নার শব্দ আরও বেড়ে গেলো। ট্রেন এবং রেললাইনটিকে ছয় বছরে পা দেওয়া জেদী শিশুর মতো মনে হচ্ছিলো। কান্নার সময় যাদের জড়িয়ে ধরলে কান্নার গতি-তীব্রতা দুটোই বেড়ে যায়।
খেয়াল করে দেখলাম, ট্রেনটির শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানিও পড়ছে। একটু পরই খেয়াল হলো, আরে! পানি আসবে কোথা থেকে? মাথার উপর রৌদ্রাজ্জ্বল আকাশ, আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। ঠিক তখনই হিসাব মিলে গেলো। এ তো ট্রেনের কান্না!
ট্রেনকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?’
ট্রেন কোনো উত্তর দিলো না।
‘অ্যাঁই’
‘হুউ’
‘কাঁদো কেন?’
‘আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না’
‘তোমাকে কার বিশ্বাস করার কথা? তুমি তো একটা মেশিন। হুকুম পালন করাই তোমার কাজ’
‘হুউ'
‘তাহলে?'
‘যে-ই মারা যায় খালি আমাদের দোষ দেয়। আমরা নাকি মানুষ মারি’
‘মারো না?'
‘না’
‘কীভাবে মরে তাহলে?’
'নিজের দোষেই মরে। আমরা প্রথমে কারো সাথে মারামারি লাগি না। ওরাই আমাদের সাথে লাগতে আসে, কম্পিটিশন দেয়, আঘাত করে। এরপর নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো আমরা বিপরীত ও সমান প্রতিক্রিয়া দেখাই। এছাড়া সেল্ফ ডিফেন্স বলেও একটা কথা আছে। ওরা এসে ধাক্কা খাবে, আর আমরা ব্যথা পাব না, তা তো হয় না। আত্মরক্ষা করতে গেলেই ওরা মরে...’
‘তাহলে তোমাদের কোন দোষ নেই?'
ট্রেন কোনো উত্তর দিলো না। বরং পালটা প্রশ্ন করলো, ‘আপনি আইয়ুব বাচ্চুর গান শোনেন?'
‘অবশ্যই শুনি'
‘ওই গানটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে৷
আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে।
আমাকে ভেঙেচুরে
চুরে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো…
এই গানের সাইকোলজিক্যাল ফরম্যাটেই আমরা চলি। মানুষ আমাদের উপর পড়ে। আমরা পড়ি না, আমরা নির্দোষ। আব্বা ছাড়া কেউ আমাদেরকে বোঝে না..’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘তোমাদের আব্বাও আছে?’
‘হ্যাঁ, যদিও আমাদের আব্বা কয়েক বছর পরপরই বদলায়। শুধু আমার না, এই দেশে যত ট্রেন, রেল লাইন আছে, সবার আব্বাই উনি..'
আমার মাথার ভেতর সব দলা পাকিয়ে এলো। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাচ্ছি। ট্রেনের সাথে কথাবার্তা শেষ করা উচিৎ।
‘তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো,’ আমতা আমতা করে বললাম।
ট্রেনের কণ্ঠ আবার ভারী হয়ে এলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘তুমি প্লিজ মানুষকে বোঝাতে পারবে যে আমরা দুর্ঘটনা ঘটাই না?
‘চেষ্টা করবো’
‘গেইটম্যানদেরও এখানে কোনো দোষ নেই’
‘ঠিক আছে’,বলে আমি দৌড়ে চলে এলাম। নিজেকে নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। আমি নেশা করেছি নাকি নেশা আমাকে করেছে তা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।
ঘুম ভাঙার পর ফেসবুক স্ক্রল করতে করতেই দেখি রেলমন্ত্রীর বক্তব্য,'ট্রেন ধাক্কা দেয় না, অন্যরা এসে ধাক্কা খায়...!’
মনে মনে বললাম, ‘আব্বা...!’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন