টিকটক ও আমার ব্যর্থ প্রেম

৩৩৭ পঠিত ... ১৭:০৫, মে ২৮, ২০২২

Tiktok-o-bertho-prem

লেখা: সাহেদুল হাসান

 

আমার প্রেমিকার নাম নবনী। অবশ্য এটা তার নিজের রাখা নাম। আসল নাম নাজিরা খাতুন। আজকের যুগে ওসব নাম চলে না। তার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে মোটামুটি একটা সাত খণ্ডের উপন্যাস লেখা যাবে। অন্য একদিন সে সব বলবো ।

এমনিতেই সে একজন আদর্শ প্রেমিকা। প্রায়ই রেস্টুরেন্টের বিল শেয়ার করে, আমাকে এটা ওটা কিনে দেয়, রিকশায় ঘুরতে গেলে ফাঁকা রাস্তা পেলে চুমুও খায়। তবে একটাই সমস্যা, ও সেলিব্রিটি ঘরের সন্তান আর আমি নন সেলিব্রিটি ঘরের। ওদের টিকটক অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ ফলোয়ার্স, আর আমার তো অ্যাকাউন্টই ভেরিফাই হয় না। ওর বাবা আমাদের এই সম্পর্ক কোনদিনই মেনে নেবে না। এ নিয়ে নবনীও অনেক টেনশন করে। এইতো সেদিন রেস্টুরেন্টে চিকেন বল খেতে খেতে টেনশনে কান্না চলে এলো ওর। আমি চোখের জল মুছে দিতে যাচ্ছিলাম, ও রেগে গিয়ে আমার হাত সরিয়ে দিলো। তারপর চোখের জল না মুছেই মোবাইল বের করে টিকটকে ভিডিও করতে শুরু করলো। কান্না করার সময় নবনীকে ভীষণ মায়াবতী লাগে। আমি চিকেন বল গিলতে গিলতে ওকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম একটা মানুষ কী করে এত সুন্দর হয়। নবনী ভিডিও শেষ করে চোখের জল মুছে মুচকি হেসে বললো, ‘এই রেস্টুরেন্টের লাইটিংটা চমৎকার, ভিডিও ভালো আসে বুঝলে।‘ আমি কিছু না বুঝেই বললাম, ‘হুঁ!’  

নববী চিকেন বল মুখে ঢুকিয়ে বললো, ‘তোমাকে কতবার বললাম একটু পরিশ্রম করো, সেলিব্রিটি হওয়ার চেষ্টা করো, তুমি তো কিছুই শুনতে চাও না।‘   

আমি প্রায়ই নবনীকে নিয়ে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে এলোমেলো ভাবে কিছুক্ষণ হাঁটি। নবনী আমার হাত ধরে থাকে, আমি উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিড়বিড় করে হেলাল হাফিজের দু-একটা কবিতা বলি। এভাবে আমাদের দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। তারপর একদিন নবনী কাঁদো কাঁদো হয়ে জানালো তার বাবা নাকি তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমি যেন দ্রুত তার বাবার সাথে দেখা করে আমাদের ব্যাপারে কথা বলি। আমি এসব শুনে মনে মনে বললাম, খাইছে আমারে, i have been eaten..  নবনীর বাবা প্রচণ্ড রাগী এবং অহংকারী মানুষ। আমাকে অপমান করে বিদায় করে দেবে। কপাল খারাপ হলে পিছে লাথিও দিতে পারে। তারপরও আমি রবিবার সকালে অনেক সাহস করে নবনীর বাবার অফিসে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন। তবে তাকে যতটা রাগী ভেবেছিলাম, ততটা রাগী নন ভদ্রলোক। তিনি সব কথা মন দিয়ে শুনলেন তারপর শান্ত গলায় আমাকে বললেন, ‘দেখো যদি আমি নবনীর বিয়ে তোমার সাথে দিয়েও দেই, তুমি কি তাকে সুখে রাখতে পারবে? আমার মেয়ের টিকটকে দেড় মিলিয়ন ফলোয়ার্স আর তোমার কোন একাউন্টই নেই। এই সমাজ কি তোমাদের সুখে থাকতে দেবে? তাই সবার ভালোর জন্যই বলছি নবনীকে ভুলে যাও।‘

আমি চুপসে যাওয়া ফুটবলের মত হয়ে বললাম, ‘আমি নবনীকে ছাড়া বাঁচবো না, নবনীও বাঁচবে না।‘

নবনীর বাবা এবার মুচকি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে তোমাকে একটা সুযোগ দেয়া হলো। তোমার হাতে এক মাস সময় আছে, টিকটকে ফিফটি K ফলোয়ার্স বানিয়ে দেখাও, আমি নবনীকে তোমার হাতে তুলে দেবো।‘

আমি ওখান থেকে বেরিয়ে হাতিরঝিলে গিয়ে বসলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে লাগলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার সেলিব্রিটি হয়েই ছাড়বো। এই সমাজকে দেখিয়ে ছাড়বো আমি কি জিনিস। এবার শুরু হবে আমার যুদ্ধ, আর এ যুদ্ধে আমার পাশে আছে নবনী।

পরদিন নবনী আমার সাথে দেখা করতে এলো। সাথে একটা বড় ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এলো অনেক কসমেটিকস, ট্রাইপড, সেলফি লাইটসহ আরও অনেক কিছু। নবনী খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ‘আজ খুবই ছোট একটা শট হবে। তোমাকে টারজান সাজিয়ে দেবো। তুমি খালি আ..উঊঊউ.. বলে চিৎকার দেবে, ব্যাস।‘ নবনী আমাকে সাজিয়ে দিলো। আমি দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছি, নিজেকে একটা কাকতাড়ুয়া মনে হচ্ছে। আমি আধা ন্যাংটা অবস্থায় মোবাইলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর নবনীর ইশারামত দিলাম এক চিক্কুর। নবনী বেশ খুশি হয়ে বললো, ‘চমৎকার হয়েছে বাবু।‘

রাতের বেলা আমি আমার প্রথম টিকটক ভিডিও আপ্লোড দিলাম। কিন্তু কোন ভিউ নেই। একটু পর পর চেক করে দেখছিলাম, একই অবস্থা। শেষে ঘণ্টাদুয়েক পর এক ছেলে কমেন্ট করেছে। সে লিখেছে, ‘হালারপুত তোরে টারজান না পুরাই বান্দরের মত লাগতাছে…’

আমার মেজাজ গেলো বিগড়ে। পরদিন নবনী আমাকে বললো, ‘আজ তোমাকে টিকটকে সেলিব্রিটি হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায়টা বলে দেবো।‘ নবনী ছাত্রদের বোঝানোর মত করে হাত নাড়িয়ে বলতে লাগলো, ‘দেখো মানুষ দুঃখ বিলাসী হতে ভালোবাসে। দুঃখ জিনিসটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আসক্তি আছে যা সবাইকে আকর্ষণ করে। তোমাকে দুঃখ বিলাসী হতে হবে। টিকটকে সেলিব্রিটি হতে হলে তোমাকে অনেক কাঁদতে হবে। দিনে রাতে কেঁদে কেঁদে সেসবের ভিডিও করে আপ্লোড দিতে হবে। তাহলেই দেখবে কাজ হয়ে যাবে।‘

নবনীর বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আমি অভিভূত। আমি দাড়িয়ে দু’ হাতে তালি দিয়ে নবনীর প্রশংসা করলাম। নবনী মুচকি হেসে বললো, ‘থাক আর তালি দিয়ে কাজ নেই। এসো এখন একটা কান্না করার ভিডিও বানাই।‘

নবনী মোবাইলে ভিডিও অপশন চালু করেই আমাকে বললো, ‘কান্না করো..’  

এবার আমি পড়লাম বিপদে। কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে কিভাবে কাঁদবো বুঝতে পারছি না। নবনী বললো, ‘জীবনের সবচেয়ে কষ্টের কোন ঘটনা মনে করো, দেখবে কান্না চলে এসেছে।‘  

আশ্চর্য বিষয় হলো, আমি অনেক চেষ্টা করেও কোন কষ্টের ঘটনা মনে করতে পারছি না। ক্লাস সিক্সে একবার টাইগার স্যারের হাতে খুব মার খেয়েছিলাম; কিন্তু সেই ঘটনা কষ্টের কিনা বুঝতে পারছি না। উলটো মনে করে আরো হাসি পাচ্ছে আমার। নবনী অনেক চেষ্টা করেও আমাকে কান্না করাতে না পেরে স্পেশাল ট্রিটমেন্টে গেলো।

আমি স্পেশাল ট্রিটমেন্ট বিষয়টা ঠিক বুঝতে না পেরে নবনীর কাছে জানতে চাইলাম। সে ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি দিয়ে বললো, ‘কোন উপায়েই কান্না না আসলে চিমটি দিয়ে কান্না বের করতে হয়। নাও তুমি রেডি হও, আমি চিমটি দিচ্ছি।‘

আমি ভদ্রছেলের মত রেডী হলাম, আর সাথে সাথেই নবনী আমার ডান হাতের কনুইয়ের ওপর আলতো করে একটা চিমটি দিলো। আমি আসমান জমিন ফাটিয়ে, 'ওরে মারে.. গেছি রে..' বলে এক চিক্কুর দিলাম।  

ব্যথায় বেহুঁশ হবার মত অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পর তাকিয়ে দেখি নবনীর লম্বা ধারালো নখের আঁচড়ে আমার হাতের চামড়া উঠে রক্তারক্তি অবস্থা। আর নবনী একটু দূরে দাঁড়িয়ে রাগে গজগজ করছে। তারপর আমার কাছে এসে চোখ বড় করে বললো, ‘তুমি একটা ভোদাই; তুমি কোনদিনও টিকটক সেলিব্রিটি হতে পারবে না। আজকের পর থেকে আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না।‘

নবনী চলে যাওয়ার পর আমিও বাড়ীর দিকে হাঁটা দিলাম। ঘরে ঢুকতেই আম্মা হাতের অবস্থা দেখে চিৎকার করে বললেন, ‘তোর হাতে কী হয়েছে খোকা?’

আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, ‘কুত্তা কামড় দিয়েছে আম্মা।‘

আম্মা ডাক্তারকে খবর দিলেন। ডাক্তার সব দেখে শুনে আমার নাভীতে সাতটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বলে গেলেন, ‘এক মাস আমি যেন ঘর থেকে বাইরে না যাই।‘

আজ এক মাস পর আমি বাইরে এলাম। হাতিরঝিলে বসে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো ওপরের দিকে ছেড়ে দিচ্ছি। খুব আলসে লাগছে নয়তো একটু হাঁটা যেতো। আজ নবনীর বিয়ে। তার বাবার বিজনেস পার্টনারের ছেলে স্যান্ডির সাথে। শুনেছি সেও নাকি বিরাট টিকটক সেলিব্রিটি। ওরা নিশ্চয়ই অনেক সুখী হবে। নিজেকে ভীষণ মাথামোটা, গর্ধব আর অকর্মন্য মনে হচ্ছে। আমাকে দিয়ে আসলেই কিচ্ছু হবে না…

 

৩৩৭ পঠিত ... ১৭:০৫, মে ২৮, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top