বইমেলার চেনা চেনা যত অচেনা

১৬৯ পঠিত ... ১৭:৪৬, মার্চ ১২, ২০২২

Boimela

তিরিশতম বসন্তে এসে জীবনে প্রথমবার বইমেলায় গিয়েছিলাম গত মঙ্গলবার। বইমেলায় যাওয়ার সময় আমার গায়ে ছিলো একটি টিশার্ট, একটি আর্মি প্যান্ট এবং পায়ে ছিলো বাথরুমের জুতা।

বাথরুমের জুতা কেন পরেছিলাম সেটা বলা দরকার।

ঢাকায় গিয়েছিলাম একটা ট্রেনিং-এ। সরকারী ট্রেনিং সেন্টারের বাথরুমে এই জুতাজোড়া ছিলো। এই সেন্টারটি তৈরি হয়েছিলো বিএনপি আমলে। উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

আমার ধারণা, এই জুতা জোড়াও সেইসময় কেনা হয়েছিলো। এরপর এসেছে সেনাসমর্থিত সরকার, জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেছে তিনটা, ইরাক যুদ্ধ থেমে গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ লেগে গেছে, কিন্ত জুতাজোড়া হয়তো আর বদলানো হয়নি।

যাই হোক, এই বেশেই গুগলে সার্চ দিলাম 'বাংলা একাডেমি' লিখে। ম্যাপ দেখে অনেকদূর হেঁটে আসার পর খেয়াল করলাম, আমার পায়ে তো প্রাগৈতিহাসিক কালের জুতা! একবার ভাবলাম, ফেলে দেই। কিন্তু পরে আর সাহস পেলাম না। সরকারী প্রতিষ্ঠানের জুতা আর নিজে করি সরকারী চাকরী। এই জুতা খোয়া গেলে দেখা যাবে নোটিশ চলে এসেছে - 'তিন কর্মদিবসের মধ্যে আপনাকে কারণ ও জুতা দর্শানোর নির্দেশ দেয়া হলো। অন্যথায় বিভাগীয় ব্যবস্থা...'

এমনিতেই দুর্গম এলাকায় পোস্টিং। শুভাকাঙ্খীরা বলেন, ফেসবুকে ফটর ফটর করায়ই নাকি আমাকে এই পোস্টিং দেয়া হয়েছে। তাই জুতা হারিয়ে আর বিপদে পড়তে চাইনা।

এই জুতা নিয়ে চলে গেলাম বাংলা একাডেমিতে। গেইটে দেখলাম, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ কঠিন। তারপরেও সবাই বেশ সহজে ঢুকে যাচ্ছে। আমিও সহজ সরল ভঙ্গিতে ঢুকে যেতে শুরু করলাম। এক পুলিশ ভাই আমাকে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক করলেন। তারপর বললেন, 'যান।'

আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে হঠাৎ ডাক, 'এই যে, আবার একটু আসেন তো...'

পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, পুলিশের বড় অফিসার আমাকে ডাকছেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বুঝা গেলো, আমাকে অবলীলায় ভিতরে যেতে দেয়ায় জুনিয়র পুলিশ সদস্যের উপর তিনি বেশ বিরক্ত।

আমার গলা শুকিয়ে গেলো। তবে কি তারা বুঝে ফেলেছেন, আমি সরকারী বাথরুমের জুতা পরে চলে এসেছি! উনার হাতে যে মেটাল ডিটেক্টর ওটাতে কি জুতাও ধরা পড়ে!

আমি আবার গেলাম। তারা আমাকে আবার চেক করলেন ভাল করে। তারপর ছেড়ে দিলেন।

আমি কনফিউজড অবস্থায় মেলায় প্রবেশ করলাম। আমাকে এত গভীরভাবে চেক করার কারণটা কী?

উত্তর পেতে বেশিক্ষণ লাগলো না।

আমি আসলে ভুল ড্রেসে চলে এসেছি। মেলায় সব ছেলে এসেছে পাঞ্জাবী পরে, মেয়েরা এসেছে বেগুনী শাড়ি পরে আর আমি কিনা এসেছি এই অদ্ভুত পোশাকে! টিশার্ট, চার-পাঁচটা পকেটওয়ালা আর্মিপ্যান্ট আর বাথরুমের জুতা! বইমেলার এই ভিড়েও আমাকে আলাদা করা যাচ্ছে।

নিরাপত্তারক্ষীরা যে আমাকে ঢুকতে দিয়েছেন, এটাই তো আমার বিশাল ভাগ্য!

যাই হোক, এই অবস্থাতেই হাঁটা শুরু করলাম।

এক যায়গায় দেখলাম, নারীদের জটলা। উঁকি দিয়ে দেখলাম, জটলার মধ্যখানে প্রিয় লেখক ও কবি আখতারুজ্জামান আজাদ। তাঁকে ঘিরে রাখা নারীদের চোখে অসামান্য মুগ্ধতা, প্রিয় কবির সান্নিধ্যে আসার আনন্দ!

আমি ভেবেছিলাম, আখতারুজ্জামান আজাদ হয়তো আমাকে চিনবেন না। তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো আরো প্রায় ১০ বছর আগে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, 'আরে! রাজি যে!'

আমি আনন্দিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বাধ সাধলো লেখককে ঘিরে থাকা নারী ভক্তদের অগ্নিদৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে একটু আগেও ছিলো রাশি রাশি মুগ্ধতা সে দৃষ্টিতে এখন প্রচন্ড বিরক্তি। তাঁরা ভেবেই পাচ্ছেন না, যে কবি সুন্দরের পূজারী যার কলম থেকে ঝরে অপার্থিব সব পংক্তিমালা, তাঁর কীভাবে এরকম বাথরুমের জুতাওয়ালা বন্ধু থাকতে পারে!

কবির চোখেও দ্বিধা। এই বসন্ত বিকেলের কত অংশ নারীদের দিবেন, কত অংশ রাজিকে দিবেন! প্রবল মানসিক দ্বন্দ্ব পেরিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত রাজির জন্য এক কাপ ধোয়া ওঠা কফি বরাদ্দ করলেন।

আরেকটু এগিয়ে দেখা পেলাম আল নাহিয়ান ভাই-এর। ভাই আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। তার চমকানোর কারণ সম্ভবত দুইটা - ১. তিনি ভাবেননি এভাবে বইমেলায় তার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে, ২. তিনি ভাবেননি ফেসবুকে ফটর ফটর করা আলিম আল রাজির প্যান্ট, জুতার এই দূরবস্থা!

প্রাথমিক চমক কাটিয়ে তিনি আমাকে বেশ কিছু মোটিভেশনাল স্পিচ দিলেন। উৎসাহ দিয়ে বললেন, 'বই লেখেন। দারুন হবে। আপনি বই লিখলে অনেক আগেই ফাটায়া ফেলতেন।'

কথায় ইঙ্গিতটা স্পষ্ট - 'ব্যাটা, বই লেখলে দুই পয়সা কামাইতে পারতি। এই জুতা পইরা ঘুরতে হইতো না।'

মেলায় আরো কিছুক্ষণ ঘুরলাম। আমার তীব্র সন্দেহ, আরো বেশ ক'জন মানুষ আমাকে চিনেছেন। তাঁদের চোখের চাহনী দেখেই বুঝেছি। কিন্তু জুতার অবস্থা দেখে তাঁরা কেউ কাছে এসে জিজ্ঞেস করার সাহস পাননি।

ঘড়িতে তখন রাত আটটা।

আমার প্রথম বইমেলাগমন কি তাহলে কফি আর উৎসাহপানেই শেষ হয়ে যাবে!

না, শেষ হচ্ছেনা। আসল ঘটনা এখনও বাকি।

হঠাৎ দেখি মেলা প্রাঙ্গণের এক কোনায় ঝাকড়া চুলের বাবরী দোলানো একজন মানুষ। খুব বেশিক্ষণ লাগলো না, চিনে ফেললাম। কিন্তু এই মানুষটার আমাকে চেনার কথা না।

'চেনার কথা না' বললেই তো হয় না! বিষয়টা নিশ্চিত হতে হবে।

আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম উনার দিকে।

ঘিরে রাখা ভক্তদের ডিঙ্গিয়ে উনার কাছে পৌছালাম।

পেশাগত জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে আইসিইউতে। এই কারণে আমাকে নানান পরিস্থিতিতে নানান ধরণের টোন-এ কথা বলতে হয়। আমি কণ্ঠে এক কৃষ্ণগহ্বর পরিমান রহস্য ঘনিভূত করে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেমন আছেন?'

আমার কন্ঠ এবং চোখের রহস্য তিনি এই ভিড়েও এড়িয়ে যেতে পারলেন না। মুখ তুলে বলতে বাধ্য হলেন, 'ভালো...'

তাঁর চোখে জিজ্ঞাসা। নিজের মাস্ক খুলে পরোক্ষভাবে বুঝাতে চাইলেন, আমিও যেন মাস্ক খুলি।

জানতাম, চিনবেন না, তাও খুললাম।

তিনি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, 'আপনার পরিচয়...?'

ঠিক এটাই আমি চাচ্ছিলাম।

মুচকী হাসি দিলাম উত্তরে।

আমি নিশ্চিত, এত রহস্যময় হাসি দেখা যায়নি ভিঞ্চির মোনালিসায়, ফ্রান্স হল'এর লাফিং ক্যাভালিয়ারে, মেসিনা'র পোট্রেইট অফ অ্যান আননোন ম্যান'এ।

আমি পরিচয় না দিয়েই চলে আসলাম। পরিচয় দেয়ার আমার কিছু নেইও। তাও, এই যে তার মুখে পরিচয়ের প্রশ্ন শুনলাম, এটাই তো আমার প্রথম বইমেলা গমনের বিশাল অর্জন!

এমন অর্জন ক'জনের হয়!

ধীর কদমে বাংলা একাডেমি চত্বর ত্যাগ করলাম।

পায়ে তখন বাথরুমের জুতা।

মাথার মধ্যে নিশ্চিন্তি, উনি আমাকে চিনেন না।

১৬৯ পঠিত ... ১৭:৪৬, মার্চ ১২, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top