দাশুর খ্যাপামি

৪১২ পঠিত ... ১৮:০৬, জানুয়ারি ২০, ২০২২

Dashur-khyapami

স্কুলের ছুটির দিন। স্কুলের পরেই ছাত্র-সমিতির অধিবেশন হবে, তাতে ছেলেরা মিলে অভিনয় করবে। দাশুর ভারি ইচ্ছে ছিল সে-ও একটা কিছু অভিনয় করে। একে-ওকে দিয়ে সে অনেক সুপারিশও করিয়েছিল, কিন্তু আমরা সবাই কোমর বেঁধে বললাম, সে কিছুতেই হবে না। সেইতো গতবার যখন আমাদের অভিনয় হয়েছিল তাতে দাশু সেনাপতি সেজেছিল; সেবার সে অভিনয়টা একেবারে মাটি করে দিয়েছিল। যখন ত্রিচূড়ের গুপ্তচর সেনাপতির সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে বলল, “সাহস থাকিলে তবে খোল তলোয়ার!”—দাশুর তখন “তবে আয় সম্মুখ সমরে” ব’লে তখনি তলোয়ার খুলবার কথা। কিন্তু দাশুটা আনাড়ির মতো টানাটানি করতে গিয়ে তলোয়ার তো খুলতে পারলই না, মাঝ থেকে ঘাবড়ে গিয়ে কথাগুলোও বলতে ভুলে গেল। তাই দেখে গুপ্তচর আবার “খোল তলোয়ার” ব’লে হুঙ্কার দিয়ে উঠল। দাশুটা এমনি বোকা, সে অমনি “দাঁড়া, দেখছিস না বক্‌লস্ আটকিয়ে গেছে” ব’লে চেঁচিয়ে তাকে এক ধমক দিয়ে উঠল। ভাগ্যিস আমি তাড়াতাড়ি তলোয়ারটা খুলে দিলাম তা না হলে ঐখানেই অভিনয় বন্ধ হয়ে যেত। তারপর শেষের দিকে রাজা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, “কিবা চাহ পুরস্কার কহ সেনাপতি,” তখন দাশুর বলবার কথা ছিল “নিত্যকাল থাকে যেন রাজপদে মতি,” কিন্তু দাশুটা তা না ব’লে, তার পরের আর একটা লাইন আরম্ভ করেই, হঠাৎ জিভ কেটে “ঐ যাঃ! ভুলে গেছিলাম” ব’লে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। আমি কটমট করে তাকাতে, সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক লাইনটা আরম্ভ করল।

       তাই এবারে তার নাম হতেই আমরা জোর করে ব’লে উঠলাম, “না, সে কিছুতেই হবে না।” বিশু বলল, “দাশু এক্‌টিং করবে? তাহলেই চিত্তির!” ট্যাঁপা বলল, “তার চাইতে ভজু মালিকে ডেকে আনলেই হয়!” দাশু বেচারা প্রথমে খুব মিনতি করল, তারপর চটে উঠল, তারপর কেমন মুষড়ে গিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল। যে কয়দিন আমাদের তালিম চলছিল, দাশু রোজ এসে চুপটি করে হলের এক কোনায় বসে বসে আমদের অভিনয় শুনত। ছুটির কয়েকদিন আগে থেকে দেখি, ফোর্থ ক্লাশের ছোট গণশার সঙ্গে দাশুর ভারি ভাব হয়ে গেছে। গনশা ছেলেমানুষ, কিন্তু সে চমৎকার আবৃত্তি করতে পারে—তাই তাকে দেবদূতের ‘পার্ট’ দেওয়া হয়েছে। দাশু রোজ তাকে নানারকম খাওয়া এনে খাওয়ায়, রঙিন পেনসিল আর ছবির বই এনে দেয়, আর বলে যে ছুটির দিন তাকে একটা ফুটবল কিনে দেবে। হঠাৎ গণশার উপর দাশুর এতখানি টান হবার কোনো কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না। কেবল দেখতে পেলাম, গণশাটা খেলনা আর খাবার পেয়ে ভুলে ‘দাশুদা’র একজন পরম ভক্ত হয়ে উঠতে লাগল।

       ছুটির দিনে আমরা যখন অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারা গেল। আড়াইটা বাজতে না বাজতেই দেখা গেল, দাশুভায়া সাজঘরে ঢুকে পোশাক পরতে আরম্ভ করেছে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে? তুই এখানে কি করছিস?” দাশু বলল, “বাঃ, পোশাক পরব না?” আমি বললাম, “পোশাক পরবি কিরে? তুই তো আর এক্‌টিং করবি না।” দাশু বলল, “বা, খুব তো খবর রাখ। আজকে দেবদূত সাজবে কে জানো না?” শুনে হঠাৎ আমাদের মনে কেমন একটা খটকা লাগল, আমি বললাম, “কেন গণ্‌শার কি হল?” দাশু বলল, “কি হয়েছে তা গণ্‌শাকে জিজ্ঞেস করলেই পার?” তখন চেয়ে দেখি সবাই এসেছে, কেবল গণশাই আসেনি। অমনি রামপদ, বিশু আর আমি ছুটে বেরোলাম গণশার খোঁজে।

       সারাটি ইস্কুল খুঁজে, শেষটায় টিফিনঘরের পিছনে হতভাগাকে খুঁজে পাওয়া গেল। সে আমাদের দেখেই পালাবার চেষ্টা করছিল কিন্তু আমরা তাকে চটপট গ্রেপ্তার করে টেনে নিয়ে চললাম। গণ্‌শা কাঁদতে লাগল, “না আমি কক্ষনো এক্‌টিং করব না, তাহলে, দাশুদা আমায় ফুটবল দেবে না।” আমরা তবু তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় অঙ্কের মাস্টার হরিবাবু সেখানে এসে উপস্থিত। তিনি আমাদের দেখেই ভয়ঙ্কর চোখ লাল করে ধমক দিয়ে উঠলেন, “তিন-তিনটে ধাড়ি ছেলে মিলে ঐ কচি ছেলেটার পিছনে লেগেছিস? তোদের লজ্জাও করে না?” ব’লেই আমাকে আর বিশুকে এক একটি চড় মেরে আর রামপদর কান ম’লে দিয়ে হন্‌হন্ করে চলে গেলেন।

       এই সুযোগে হাতছাড়া হয়ে গণেশচন্দ্র আবার চম্পট দিল। আমরাও অপমানটা হজম করে ফিরে এলাম। এসে দেখি, দাশুর সঙ্গে রাখালের মহা ঝগড়া লেগে গেছে। রাখাল বলছে, “তোকে আজ কিছুতেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হবে না।” দাশু বলছে, “বেশ তো, তাহলে আর কেউ দেবদূত সাজুক, আমি রাজা কিম্বা মন্ত্রী সাজি। পাঁচ-ছটা পার্ট আমার মুখস্ত হয়ে আছে।” এমন সময় আমরা এসে খবর দিলাম যে, গণশাকে কিছুতেই রাজী করানো গেল না। তখন অনেক তর্কবিতর্ক আর ঝগড়াঝাঁটির পর স্থির হল যে, দাশুকে আর ঘাঁটিয়ে দরকার নেই, তাকেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হোক। শুনে দাশু খুব খুশী হল আর আমাদের শাসিয়ে রাখল যে, “আবার যদি তোরা গোলমাল করিস, তাহলে কিন্তু গতবারের মতো সব ভণ্ডুল করে দেব।”

       তারপর অভিনয় আরম্ভ হল। প্রথম দৃশ্যে দাশু কিছু গোলমাল করেনি, খালি স্টেজের সামনে একবার পানের পিক্ ফেলেছিল। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে এসে সে একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করল। এক জায়গায় তার খালি বলবার কথা—“দেবতা বিমুখ হলে মানুষে কি পারে?” কিন্তু সে এই কথাটুকুর আগে কোত্থেকে আরও চার-পাঁচ লাইন জুড়ে দিল! আমি তাই নিয়ে আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু দাশু বলল, “তোমরা যে লম্বা বক্তৃতা কর সে বেলা দোষ হয় না, আমি দুটো কথা বেশি বললেই যত দোষ!” এও সহ্য করা যেত, কিন্তু শেষ দৃশ্যের সময় তার মোটেই আসবার কথা নয়, তা জেনেও সে স্টেজে আসবার জন্য জেদ ধরে বসল। আমরা অনেক কষ্টে অনেক তোয়াজ করে তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, শেষ দৃশ্যে দেবদূত আসতেই পারে না, কারণ তার আগের দৃশ্যেই আছে যে দেবদূত বিদায় নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। শেষ দৃশ্যেও আছে যে মন্ত্রী রাজাকে সংবাদ দিচ্ছেন যে, দেবদূত মহারাজকে আশীর্বাদ করে স্বর্গপুরীতে প্রস্থান করেছেন। দাশু অগত্যা তার জেদ ছাড়ল বটে, কিন্তু বেশ বোঝা গেল সে মনে মনে একটুও খুশি হয়নি।

       শেষ দৃশ্যের অভিনয় আরম্ভ হল। প্রথম খানিকটা অভিনয়ের পর মন্ত্রী এসে সভায় হাজির হবেন। এ কথা সে কথার পর তিনি রাজাকে সংবাদ দিলেন, “বারবার মহারাজে আশীষ করিয়া, দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে।” বলতেই হঠাৎ কোত্থেকে “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” ব’লে এক গাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত। হঠাৎ এ রকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কি রকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম—অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার যোগাড় হয়ে এল। তাই দেখে দাশু সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, “বলে যাও কি বলিতেছিলে।” তাতে মন্ত্রী আরও কেমন ঘাবড়িয়ে গেল। রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, দাশুকে কি যেন বলবার জন্যে যেই একটু এগিয়ে গেছে, অমনি দাশু “চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা”—বলে এক চাঁটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল। ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা—“এ রাজ্যতে নাহি রবে হিংসা অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র্য যাতনা” ইত্যাদি—নিজেই গড়গড় করে ব’লে গিয়ে, “যাও সবে নিজ নিজ কাজে” ব’লে অভিনয় শেষ করে দিল। আমরা কি করব বুঝতে না পেরে সব বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ওদিকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল আর ঝুপ্ করে পর্দাও নেমে গেল।

       আমরা সব রেগে-মেগে লাল হয়ে দাশুকে তেড়ে ধরে বললাম, “হতভাগা, দ্যাখ্ দেখি সব মাটি করলি, অর্ধেক কথাই বলা হল না।” দাশু বলল, “বা, তোমরা কেউ কিছু বলছ না দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি যা মনে ছিল সেইগুলো বলে দিলাম। তা না হলে তো আরো সব মাটি হয়ে যেত।” আমি বললাম, “তুই কেন মাঝখানে এসে গোল বাধিয়ে দিলি? তাইতো সব ঘুলিয়ে গেল।” দাশু বলল, “রাখাল কেন বলেছিল যে আমায় জোর করে আটকিয়ে রাখবে? তা ছাড়া তোমরা কেন আমায় গোড়া থেকে নিতে চাচ্ছিলে না আর ঠাট্টা করছিলে? আর রামপদ কেন বারবার আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিল?” রামপদ বলল, “ওকে ধরে ঘা দুচার লাগিয়ে দে।”

       দাশু বলল, “লাগাও না, দেখবে আমি এক্ষুনি চেঁচিয়ে সকলকে হাজির করি কিনা?”

৪১২ পঠিত ... ১৮:০৬, জানুয়ারি ২০, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top