বৃহস্পতিবারে এমন হতেই পারে

৭৬৩ পঠিত ... ১৭:৪১, জানুয়ারি ০৬, ২০২২

_brihoshpotibar

১.

অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় নাজমুল। উত্তরবঙ্গের মতো শীত না পড়লেও ঢাকার এই শীতটা বেশ আকর্ষণীয়। এমন একটা শীতে শরীর গরম করলে কেমন লাগে ভাবতে ভাবতে তার হতাশ লাগে। কারণ তার হাতে অনেক কাজ। আর সব কাজ শেষ করে বের হতে গেলে বৃহস্পতিবার মাটি হয়ে যাবে।  বৃহস্পতিবার বিকালে এতো কাজ ভালো লাগে না। তাই মনে মনে সে একটা জটিল পরিকল্পনা করে।

তার উপর একটু আগে বন্ধু রাশেদ টেক্সট পাঠিয়েছে, ‘মামা হবে নাকি?’

তাই দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সে বসের রুমে গিয়ে দেখে বসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সহকর্মী শিহাব। শিহাবের চোখ কাঁদো কাঁদো। বস তাকে বসতে বলে শিহাবের সাথে কথা চালিয়ে যায়।

বস: তা কী বলছিলেন ছুটি লাগবে?

শিহাব: ঠিক ছুটি না স্যার। আমার কি অতো ছুটির দরকার হয়? একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে এই যা। দাদীকে হাসপাতালে ভর্তি করাইছে। খুব অসুস্থ।

বস: কোন হাসপাতাল?

শিহাব: ফরিদপুর সদর হাসপাতাল।

বস-: কী হয়েছে উনার?

শিহাব: অনেক কিছু স্যার। বলে শেষ করা যাবে না। মনে হয় বাঁচবে না।

এইটুকু বলার সময় শিহাবের গলাটা কেঁপে ওঠে। নাজমুল খেয়াল করে দেখে চোখও টলমল করছে। সহকর্মীর এমন চোখ টলমল করা দেখে তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সহকর্মীর টলমলে চোখে তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে এমনটি কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। ফলে সে দ্রুত নিজের পরিকল্পনা বদলায় এবং আরও শক্তিশালী করে।  কিন্তু টেনশনের বিষয় হচ্ছে শিহাবের কণ্ঠ দ্রুতই কাঁদো কাঁদো হয়ে যাচ্ছে আর সাথে সাথে বসেরও মন প্রায় গলে যাচ্ছে, আরেকটু হলে বস নিজেই হয়তো কেঁদে দেবেন। তিনি তা করলেন না। বরং নাজমুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নাজমুল সাহেব। শুনলেনই তো, শিহাব সাহেবের হাতে কিছু কাজ আছে। ওগুলো শেষ করে ফেলতে পারবেন না?’   

এমন বিপদের কথা নাজমুল রুমে প্রবেশ করেই আঁচ করতে পেরেছিলো। ফলে সেও কিছুটা কাঁচুমাচু করে বললো, ‘অন্যদিন হলে তো পারতাম স্যার। আপনি তো আমাকে চেনেনই। কাজের প্রতি স্যার আমার অন্যরকম ভালোবাসা আছে।  কিন্তু এইমাত্র জানতে পারলাম আমার বোন . .’

এইকুটু বলে নাজমুল একটু থামে, সে চেষ্টা করে তার চোখটাও যেন শিহাবের মতো টলমল করে। একটা নকল দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তার কথা শেষ করে, ‘আমার আপন বোন হাসপাতালে।’

নাজমুলের কথা শুনে আঁতকে ওঠে বস, ‘কী হয়েছে উনার?’

: হয়নি হবে।

: কী হবে?

-সেটা এখনো জানি না। ছেলেও হতে পারে, মেয়েও হতে পারে। নামও ঠিক করা আছে স্যার। তবে সমস্যা কী স্যার জানেন? খুব কমপ্লিকেটেড! যে কোনো কিছু হতে পারে।  ভাই হিসাবে তার পাশে থাকা খুব দরকার। বিষয়টা যদি দেখতেন আপনি।

নাজমুলের কথা শেষ হওয়ার পর পুরো রুমে এক ধরনের নীরবতা তৈরি হয়, মনে হয় যে কেউ একজন মারা গেছে, তারা তার স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালন করছে। দুই মিনিটের অধিক নীরবতার পর প্রথম মুখ খুললেন বস। তিনি কিছুটা কনফিউজ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন হাসপাতাল?’

: হলি ফ্যামেলি হাসপাতাল স্যার।   

আবার নীরবতা। বস একবার নাজমুলের দিকে একবার শিহাবের দিকে। শিহাব একবার নাজমুলের দিকে একবার বসের দিকে আবার নাজমুল একবার শিহাবের দিকে আরেকবার বসের দিকে তাকিয়ে সবাই যে যার মতো নির্বাক হয়ে যায়।  তবে যেহেতু বস সবার উপরে, তিনিই প্রথম মুখ খুললেন, ‘আপনাদের ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু আমার ব্যাপারটাও তো আপনাকে বুঝতে হবে’।

‘কিন্তু স্যার’ একসাথে বলে উঠলো শিহাব এবং নাজমুল। বস একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ‘দেখুন আমাকে তো আপনারা চিনেন। আপনাদেরকে দুইজনকে ছুটি দিয়ে এই কাজ শেষ করে ফেলা আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আপনাদের ভাবী . . . ‘

এই বলে বসও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। নাজমুল খুব খেয়াল করে দেখছে বসের চোখও টলমল করছে। শিহাবের দিকে তাকিয়ে দেখা গেলো সেখানেও একই ঘটনা। তার চোখও টলমলে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যার চোখ সবচে বেশি টলমল করছে সে হয়তো জিতে যাবে। একটা চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে নাজমুল চেষ্টা করে যাচ্ছে তার চোখ যাতে আরো টলমল করে। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়?

নাজমুল এবং শিহাব দুজনেই নকল শঙ্কা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাবীর কী হয়েছে স্যার? খারাপ কিছু না তো?’

‘তেমন কিছু . .’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বস। তার চোখ আগের চেয়ে টলমল করছে। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘আমার সংসারটা বোধহয় থাকবে না আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় না ফিরলে’।

এমন একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়ে তিনজনই নির্বাক হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে এই বুঝি কেউ একজন বলবে, আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখতেছি। আপনারা যান ফ্যামেলির পাশে থাকেন। কিন্তু তেমনটি কেউ বললো না বেশ কিছু সময় পার হওয়ার পরও। আর তাই প্রথমবার মুখ খুললো নাজমুল, ‘স্যার কাজটা যদি পিছিয়ে দিতেন। রবিবার সকালে এসে করে ফেলবো।‘

কিন্তু শিহাব সে পথে হাঁটলো না, ‘স্যার। থাক। আমিই করে ফেলবো। দাদীর তো বয়স হয়েছে। তিনি এমনিতেই হয়তো মারা যাবেন, হ্যাঁ মরলে দুঃখ পাবো। কিন্তু কাজ তো করতে হবে। যে কাজ আমার প্রতিবেলার খাবার জোটায়, যে কাজ আমার পরিবারের ভরণ পোষণ করে, আমি তো সে কাজকে অবহেলা করতে পারি না। আপনার যান স্যার। আমি করে ফেলবো সব কাজ। কাল শুক্রবার। দাদীর কবরে দুই টুকরা মাটি দিয়ে আসতে পারলেই আমার হবে।‘

নাজমুলের ইচ্ছা হচ্ছে লোকটাকে চিপায় নিয়ে দুই একটা দিতে। হারামজাদা এখানে বাপ্পারাজের চরিত্রে অভিনয় করতে আসছে। কিন্তু শিহাবের কথা শুনে বস উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘আমার কর্মজীবনে আপনার মতো নিষ্ঠাবান অফিসার আমি দেখি নাই শিহাব সাহেব। আপনি অনেকদূর যাবেন। ইউ এর দ্য বেস্ট।‘  

নাজমুলের রাগ আরো বাড়ে। সে জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে কি স্যার আমি যাবো? সমাধান তো হয়ে গেলো।‘

‘না নাজমুল। সমাধান হয়নি। আমরা একজনের এমন সময়ে তাকে কাজে আটকে রাখতে পারি না। এটা অন্যায়, আমরা এতোটা অমানবিক না। আর আপনার বোনের ব্যাপারটা আর আমার স্ত্রীর ব্যাপারটাও তো সিরিয়াস।’ বললেন বস।

: তাহলে?

: তাহলে আমি কাজ পিছাচ্ছি। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে যে রবিবার সকাল বারোটার মধ্যে সব কাজ শেষ করে ডেলিভারি করে দেবেন। আর এই ব্যাপারে সচেতন থাকবেন যাতে বড় স্যার কিছু না জানেন। জানলে আপনাদের জন্য আমার চাকরিটা যাবে।

মুহূর্তেই পুরো রুমে একটা সুখের বাতাস বয়ে গেলো। যদিও সবার মন খারাপ বলে কেউ সে সুখে খুশি প্রকাশ করেনি।

 

২.

নাজমুলের মন ভালো। অফিস থেকে বেরিয়েই বাইরে চোখ রাখতেই বোঝা গেলো বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা মানুষের মনে পৌঁছে গেছে। সব মানুষের মনে কেমন যেন আনন্দ। যদিও বনানীর রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। সে তার বন্ধুদের গ্রুপে গ্রুপ কল করে বলে, ‘এই রাশেদ, এই ফজল, এই শাওন আমি তো অফিস থেইকা বাইর হইয়া গেছি। এখানে তো রাস্তায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নেমে গেছে। তোরা কই?’

উল্টা দিক থেকে জানায়, তারা সবাই ইতোমধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে রাজধানীর দামী পানশালায় অবস্থান করছে এবং ইতোমধ্যে কয়েক দফা ঘটনা ঘটে গেছে। ফলে সে আর দেরি না করে দ্রুত সেখানে চলে যায় যেখানে লাল নীল আলোর নিচে গ্লাসগুলোতে ভাসছে সাদা সাদা বরফ।

কিছুক্ষণ যেতেই আসরটা জমে গেলো। বিশাল তর্ক চলছে চারিদিকে। এরমধ্যে নাজমুলের বন্ধু শাওন বললো, ‘আমার তো বৃহস্পতিবার বেশি হয়ে গেছেরে।‘

নাজমুল বললো, ‘আমারো বৃহস্পতিবার কম না। যাই একটু ইয়ে করে আসি।‘  

ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে নাজমুল নিজেকে টেনে হিঁচড়ে কোনো মতে বাথরুমের ইউরিনালের সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। প্রাকৃতিক কাজ শুরু করে পাশে তাকাতেই দেখে পাশের ইউরিনালে দাঁড়িয়ে আছে অসুস্থ দাদীর নাতী শিহাব। প্রথমে ভাবে সে ভুল দেখছে, এজন্য চোখ কচলে আবার দেখে। না শিহাবই।  একইরকম ঢুলুঢুলু শরীরে নিবিষ্ট মনে প্রাকৃতিক কর্ম সারছে!  

‘এ শিহাব ভাই আপনি এখানে?’ নাজমুলের কথা শুনে রীতিমত আঁতকে উঠে শিহাব। সে কাতর কন্ঠে বলেন, ‘অফিস থেকে বেরিয়ে ফরিদপুরের টিকেট কাটছিলাম। কিন্তু তার আগেই ফোন আসে, আমার দাদী আর নাই।‘ বলেই সামান্য কান্নাও করে শিহাব। তারপর আবার বলে, ‘তাই দুঃখ ভুলতে চলে এলাম এখানে। ভাবলাম একটু পান করলেই দুঃখ কমবে। আহারে আমার দাদীটা। এভাবে চলে গেলো।‘  

নাজমুলের হাতটা ব্যস্ত না থাকলে সে শিহাবের কাঁধে হাত রেখে অবশ্যই স্বান্তনা দিতো। কিন্তু তার হাত তো ব্যস্ত। এদিকে শিহাব কাঁদতে কাঁদতে বলে. ‘কিন্তু আপনি এখানে কেন?’

নাজমুল হাসতে হাসতে বলে, ‘আমার বোনের ফুটফুটে মেয়ে সন্তান হয়েছে। সে উপলক্ষে ভাবলাম এমন একটা খুশির ব্যাপার সেলিব্রেট না করলে কিভাবে হবে’। নাজমুলের কথা শেষ হবার আগে সেখানে রীতিমত কাঁপতে কাঁপতে তাদের বস হাজির। দুজনেই বসকে দেখে চমকে উঠে, ‘বস আপনি এখানে?’

বস প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে বলেন, ‘বলছিলাম না আমার সংসারটা মনে হয় ভেঙ্গে যাবে? আপনাদের ভাবী বাপের বাড়ি চলে গেছে রাগ করে। বউ চলে যাওয়ার দুঃখ তো আপনারা বুঝবেন না, তাই আসলাম নিজেকে শেষ করে দেয়ার জন্য।‘

বস কাঁদতে কাঁদতে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন।  নাজমুল এবং শিহাব দুজনেই বসের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে দিতে নিজেদের কথাও বলে।

তারা তিনজন বাথরুমে থেকে ফিরে যেতে  থাকে। নাজমুল বসকে বলে, কিন্তু স্যার আপনি কিন্তু ভুল বুঝবেন না। আমার বোনের বাচ্চা না হলে জীবনেও আমি অফিস ফেলে এখানে আসতাম না।

তার সাথে কথায় যোগ দেয় শিহাব, জ্বি স্যার। একদম ভুল বুঝবেন না। আমার দাদী মারা না গেলে আমিও কোনোভাবেই এখানে আসতাম না।

বস দুজনের হাত ধরে বলেন, আপনারাও কথা দেন। আমার হাত ধরে কথা দেন। এই ব্যাপারে কোনো ভুল বুঝবেন না। আমার স্ত্রী যদি চলে না যেতো তাহলে আমিও কিছুতে এখানে আসতাম না। এমনকি কেউ জোর করেও এখানে কেউ আমাকে আনতে পারতো না।

তারপর তারা তিনজন একসাথে একই টেবিলে বসে নতুন করে অর্ডার দেয় আর পান করতে করতে সিদ্ধান্ত নেয় যে এখানে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই। বৃহস্পতিবার এমন হতেই পারে। তারা আবার নতুন আলোচনায় মেতে উঠে আর তাদের চোখের বদলে পুরো শরীর টলমল করতে থাকে।

৭৬৩ পঠিত ... ১৭:৪১, জানুয়ারি ০৬, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top