এমন বৃহস্পতিবারও জীবনে আসে!

৬৯৯ পঠিত ... ১৮:০৬, ডিসেম্বর ০২, ২০২১

Brihospotibar

১.

আজকে বৃহস্পতিবারটা অন্যান্য বৃহস্পতিবারের মতো নয়। অফিসে কাজের চাপ থাকায় বাসায় ফিরতে ফিরতে এগারোটা। তখন আমি থাকি বন্ধুর ফ্ল্যাটে।  তিন বেডরুমে বিশাল ফ্ল্যাট, থাকি আমি একা। মাঝে মাঝে অবশ্য বন্ধুর ছোট ভাই আসে, এক আধদিন থেকে চলে যায়। আমাদের খুব একটা দেখা হয় না যদিও।

তো যা বলছিলাম বৃহস্পতিবার। বাসায় ফিরে এক রাশ দুঃখ পেয়ে বসলো, এমন একটা বৃহস্পতিবারে বাসায় একা একা শুকনো মুখে বসে আছি ভাবতেই লজ্জা লাগলো। মানুষ জানলে কী ভাববে! তাই দ্রুত ফ্রিজ খুললাম, মোটামুটি মরুভূমি। একটা উট ছেড়ে দিলে হাঁটতো।  কিছু কাঁচা মরিচকে ক্যান্সারের রোগীর মতো শুকিয়ে থাকতে দেখা গেলো, কয়েকটা ডিম আছে, অর্ধেক ফুলকপি আর অর্ধেক খাওয়া একটা এক লিটার একটা কোকের বোতল।  এক ধরনের খুশির সন্দেহ নিয়ে ঢাকনা খুলে গন্ধ শুঁকলাম। না কোকই! বৃহস্পতিবার যেন আরো মুষড়ে পড়লো। তবুও হতাশ হওয়া যাবে না ভেবে দ্রুত ইউটিউব দেখে ঝালঝাল ফুলকপির বড়া বানিয়ে ফেললাম।

ফুল কপির বড়াগুলো প্লেটে সুন্দর করে সাজালাম, কাঁচের গ্লাসে এক গ্লাস কোক নিলাম। খেতে খেতে সিনেমা দেখছি।  সিনেমার নাম নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান।  মূলত এক শিকারী দুই মিলিয়ন ডলারের একটা ব্যাগ পায়, যেটা ড্রাগ ডিলাররা ফেলে গেছে।  কিন্তু ব্যাগ পেয়েই শিকারীর আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়নি, বরং কলা নিয়ে টানাটানি অবস্থা। তার পিছু নিয়েছে ভয়ংকর এক সাইকোপ্যাথ কিলার। কথা কম বলে, কেমন করে জানি তাকায়। তাকালে কলিজাটা শুকিয়ে যায়। সিনেমা শুরুর মিনিট বিশেকের মধ্যে আমি ভয়ে সব ফুলকপি খেয়ে ফেলছি।  সাইকোপ্যাথটার আচরণ ভয়ের পাশাপাশি মেজাজ খারাপও লাগছে। আমার বিকাশে যদি দুই মিলিয়ন ডলার থাকতো তবে এখনই তাকে সেন্ড মানি করে দিতাম। কিন্তু আমার কী ওতো সামর্থ্য আছে? মহান বৃহস্পতিবারে বাসী কোক আর ফুলকপি খাওয়া লোকের দুই হাজার টাকা নিয়েই ভাবা উচিত না, দুই মিলিয়ন তো অনেক!

যাকগে সিনেমাটা এক সময় শেষ হলো, এরমধ্যে প্রায় আড়াইটা বেজে গেছে।  ঘুমে চোখ যাই যাই করছে।  আমি সব ঘর, কিচেন এমনকি বাথরুমে গিয়ে লাইট বন্ধ করলাম কিংবা চেক করলাম লাইট ফ্যান বা পানির কল খোলা নাকি ।  এমনতি যে এসব ব্যাপারে আমি খুব সচেতন তা না। কিন্তু যেদিন সচেতন হই সেদিন পারলে প্রতিবেশির লাইট ফ্যানও বন্ধ করে আসি।  সাথে সিনেমা দেখার একটা প্রভাব স্বরুপ ঘরের মেইন দরজা বন্ধ আছে কিনা সেইটাও চেক করলাম। সিনেমাতে যেভাবে দরজা ভেঙ্গেটেঙ্গে চলে আসে তাতে চেক না করে উপায়ও নেই। কিন্তু আমার কাছে কেনো কেউ দরজা ভেঙ্গে আসবে? আমি তো কারো দুই মিলিয়ন ডলারের ব্যাগ নিয়ে নিই নাই। 

যাই এতো চিন্তা করলে হবে না, বৃহস্পতিবার যদি আরামের ঘুম না হয় তবে সারা সপ্তাহ সেটার ঘানি টানতে হয়। ফলে সকল দুশ্চিন্তাকে বাদ দিয়ে ঘুমাতে গেলাম।

২.

ঘুমের মধ্যেই, মনে হলো একটা বাতাস বয়ে গেলো আমার বিছানার পাশ দিয়ে। তখনো ঘুম পুরোপুরি কাটেনি। ব্রেন কেবল একটু সজাগ।  প্রথমে ভাবলাম হয়তো ঘুমের মধ্যে এসব হচ্ছে সিনেমা দেখার প্রভাবে। কিন্তু বাতাসটা আমি আরেকবার টের পেলাম। কেউ একজন পাশ দিয়ে চলে গেলে যেমন বাতাস পাওয়া যায় তেমন একটা বাতাস। ভেতরে চমকে উঠলাম, চোখটা খুলে অন্ধকারে বোঝার চেষ্টা করলাম কী হচ্ছে।  সুনশান নীরব, ফ্যানের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।  ভাবলাম ভুল ভেবেছি, যখনই চোখ বন্ধ করতে যাবো তখনই দেখলাম দরজার নিচে দিয়ে একটা ছায়া যেন সরে গেলো!

আরে দরজার বাইরে আলো জ্বলছে। আমি তো সব নিভিয়েই ঘুমালাম। তাহলে? ভুত জ্বিন নাকি? এই ভেবে দ্রুত বালিশের কাছে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখি সিগারেট নেই। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে প্যাকেটে সিগারেট ছিলো একটা বা দুইটা।  আমার মনে পড়ে গেলো বছরখানেক আগের একটা ঘটনা। এই ফ্ল্যাটটা তখন একদম ফাঁকা ছিলো।  আমি তখন এর কাছাকাছি আরেকটা বিল্ডিং এ থাকি। এক সন্ধ্যায় বন্ধু ফোন দিয়ে ওই ফ্ল্যাটে যাইতে বললো। কী যেন জরুরী ব্যাপার ঘটেছে।

আমি গিয়ে দেখলাম বাসার ভেতরে সব এলোমেলো। সোফা ঘরের মাঝখানে আনা, কম্পিউটার টেবিল টেনে দরজার সামনে রাখা। ওয়্যারড্রোবের ভেতরের সব জিনিসপত্র ফ্লোরে ছড়ানো ছিটানো। এস্ট্রে তে প্রচুর সিগারেটের ফিল্টার। দুইটা ফিল্টারে আবার লিপস্টিকের দাগ লাগানো। যে বা যারা ঢুকেছে তারা ব্যলকনির গ্রীল কেটে ঢুকেছে।  হয়তো আরেকটা প্যারাসাইট। সেই রহস্য আমরা আর কখনোই উদ্ধার করতে পারিনি।

ঘটনাটা মনে পড়ায় ভাবলাম সেরকম কিছু কিনা। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখলাম ডাইনিং রুমের বাতি জ্বলছে। আমার ভেতরের সোলাইমান সুখন আমাকে অনুপ্রেরনা দিচ্ছে, সামনে গিয়ে পরিস্থিতি দেখার, ‘আরে যাও, দেখো, দেখতে হবে। ছোট বেলায় আমরাও এমন ভয় পেতাম . .অনেক স্ট্রাগল হতো, তবুও থামিনি . . ‘

সেই সাহসে ড্রয়িং রুমে দেখলাম।  কেউ নাই, কেবল বাতিটা জ্বালানো। দ্রুত মেইন দরজা দেখলাম, যেমন লক করা ছিলো তেমনই আছে। দরজা খুলে সিঁড়িতে উঁকি দিলাম।  না কেউ নাই।  রান্নাঘরে গেলাম, কেউ নাই। কমন স্পেসের বাথরুমে গেলাম, সেখানেও কেউ নাই! বুঝলাম না। বাইরে একটা কুকুর ঘেউঘেউ করে ডাকছে। তার ডাক কেমন অপ্রকৃতিস্থ, আমার দাদী বলতো, ‘খারাপ আত্মার উপস্থিতি পাইলে কুত্তা এমন কইরা ডাকে’। কিন্তু আমার মনে হয় শুধু কুত্তা না খারাপ আত্মার উপস্থিতি টের পেলে ঘড়িও শব্দ করে বেশি। দেয়ালে যে ঘড়িটা আছে এতোদিন সেইটা খেয়ালই করি নাই। এখন দেখিও সে কুকুরের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকটিক করছে।

এসব ডাকটাক পাত্তা না দিয়ে বুকে ফু দিয়ে, ড্রয়িং রুমের পাশের রুমটার দরজা খুলে ফেললাম। এই রুমে একটা টেবিল ছাড়া কিছুই নেই। দেখলাম ধবধবে ফাঁকা ঘর। দ্রুত ব্যলকনিতে গেলাম। এই ব্যলকনির গ্রীল কেটেই আগেরবার চোর তার বউ অথবা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হানিমুনে এসেছিলো। সেখানেও কোনো চিহ্ন নেই।  তাহলে লাইটটা জ্বালালো কে?

ঠিক তখনই শেষ প্রান্তের রুমের দিকে চোখ গেলো। যেমন দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম তেমনই আছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দরজার নিচে দিয়ে বাতির আলো আসছে। কী করবো খুঁজে পাচ্ছি না, দাঁড়িয়ে আছি হতভম্বের মতো। ঘড়ি দেখলাম, প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। মানে আমি আসলে বেশি ঘুমাইনি। সকাল হতে তখনো দুই থেকে তিনঘণ্টা বাকি। এই রাতটা আমার যাবে কিভাবে? একবার ভাবলাম সে রুমের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিবো নাকি? নাকি লাঠিসোটা নিয়ে বীরদর্পে দরজা খুলবো? আমি যেতে চাচ্ছি না, তাও যেতে হচ্ছে। লাঠি না পেয়ে হাতে বিছানা ঝাড় দেয়ার ঝাড়ু নিলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যতোগুলো সুরা মনে পড়ে সবগুলো পড়লাম, তারপর হেইয়ো বলে দরজাটা খুলে ফেললাম...  

কিন্তু ভেতরে কেউ নাই। টেলিভিশন চলছে খুব মৃদু ভলিউমে। বিছানা পরীক্ষা করে দেখলাম, এক কোণে ভেজা। হাত দিয়ে দেখলাম ভালো পরিমাণ ভেজা। বাথরুম থেকে পানির শব্দ পেলাম। কে কে বলে বাথরুমের দরজা খুলে দেখি সেখানেও কেউ নেই। তবে পুরো বাথরুম ভেজা।  ফ্ল্যাশের কো কো শব্দ তখনো শেষ হয়নি। মানে একটু আগে কেউ বাথরুমটা ইউজ করেছে। আমি এক ধরনের শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি তিনটা বত্রিশ! রাতটা যাবে কী করে? আমি এ কিসের মধ্যে পড়লাম। ঠিক তখনই চোখে পড়লো ব্যালকনির দরজায়। দরজাটা ভেড়ানো তবে ছিটকিনি লাগানো নেই অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে দরজায় ছিটকিনি দিয়েছিলাম।

মাথা ঠান্ড করে স্থির হলাম, শব্দ পাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো শব্দ নেই। বিদঘুটে কম দামী কোনো সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আমি সিউর আগেরবার যারা এসেছিলো তারাই। গলা শক্ত করে জোরে চিৎকার করলাম, ‘কে? কে ওইখানে?’

ধপাস করে দরজাটা খুলে গেলো, ‘ভাই আমি, আমি তামজিদ।' 

সে বন্ধুর ছোট ভাই। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো, ‘তুমি আসবা এইটা আমাকে জানাবা না?’

তার সিগারেট প্রায় শেষ, শেষ টান দিয়েই বললো, ‘আগেরবার রাত তিনটায় ফোন দিছিলাম, আপনি বলছিলেন, আর কখনো যদি বাসায় আসবা টাইপ ছোটখাটো ধরনের কাজে ফোন দিয়া ঘুম ভাঙ্গাও আমি তোমার ইয়ে ভেঙ্গে দিবো।  এজন্য ভয়ে ফোন দিই নাই। আর চাবি তো ছিলোই আমার কাছে।‘

‘বলছিলাম নাকি? যাক, অসুবিধা নাই। সিগারেট আছে?’

- না ভাই।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি মিয়া আমাকে ভয় পাইয়ে দিছিলা। যাই ঘুমাই’ এই বলে যখন চলে যাবো তখন সে আবার ডাকলো, ভাই।

- কী?

- একটা কথা বলবো মাইন্ড করবেন না বলেন?

- মাইন্ড করবো না বলো।

- আপনার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিছি। আপনি যাতে না জেগে যান, একদম নিঃশব্দ আপনার রুমে গেছি, গিয়ে নিয়া আসছি। আপনি তো জাগেন নাই, ভালো করছি না ভাই?

- খুব ভালো করছো।

- থ্যাংকিউ ভাই।

কিন্তু আমার একটু সন্দেহ হলো, জিজ্ঞেস করলাম, ‘একটাই নিছো’?

সে একটা ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বললো, না ভাই দুইটা। একটা নিছিলাম। পরে ভাবলাম ঘুমন্ত মানুষ সিগারেট দিয়ে কী করবেন?’

 

৬৯৯ পঠিত ... ১৮:০৬, ডিসেম্বর ০২, ২০২১

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top