নাজমুস সাকিবকে মেইল করার পরপরই এমএমএস করে জানিয়ে দিয়েছি যে, মেইলটা যাতে দ্রুত চেক করে। ইম্পর্টেন্ট খুব।
কিন্তু তাও যখন করেনি, তখন নিতান্তই বাধ্য হয়ে ফোন দিয়ে দেখলাম ফোনটা অফ। দেরি না করে প্রথমে রিকশা, তারপর বাস, তারপর নৌকা, তারপর আবার ভ্যান নিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে জানলাম, তারা গত মাসেই এই বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। নতুন ঠিকানা গেন্ডারিয়া। কিন্তু তারা ঠিকানা জানে না।
চলে গেলাম গেন্ডারিয়া। কিন্তু এতো বড় গেন্ডারিয়া আমি নাজমুস সাকিবকে পাই কই আর তাকে কীভাবে জানাই যে, মেইলটা যাতে চেক করে। খুব ইম্পর্টেন্ট।
টানা দুইদিন খোঁজার পর নাজমুস সাকিবকে না পেলেও এলাকার কমিশনারকে পেলাম। তাকে সব সমস্যা খুলে বলতেই তিনি একটা সমাধান ধরিয়ে দিলেন। তাই আমি রিকশা নিয়ে সমস্ত গেন্ডারিয়ায় মাইকিং করলাম, জনাব নাজমুস সাকিব আপনি যেখানেই থাকেন না কেনো অতিসত্বর আমার মেইলটি চেক করেন। খুব ইম্পর্টেন্ট।
কিন্তু তাতেও সে চেক করেনি। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়ে থানায় গেলাম। থানা থেকে বিশাল কসরত করে ঠিকানা জোগাড় করে যখন তাদের বাসায় গেলাম, তখন জানতে পারলাম নাজমুস সাকিব তিনদিন হয়ে বাড়ি ফেরে না। তার মা কাঁদছে, বোন অসুস্থ, বাবা বাজারে যায় না, তাই ঘরে বাজার হয়নি। এমন শোকে তারা কেউ রান্নাবান্না করার অবস্থাতেও নাই। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। প্রথমে বোনের কপালে জল পট্টি দিয়ে তারপর গেলাম বাজার করতে। বাজার করলেই তো আর হচ্ছে না। এতোগুলা মানুষের রান্নাবান্না সব একাই করলাম।
সকলে মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নাজমুস সাকিবের বাবার সাথে গেলাম পত্রিকা অফিসে হারানো বিজ্ঞপ্তি দিতে। আংকেলের অগোচোরে চালাকি করে বিজ্ঞপ্তিতে নিজের দুইটা লাইন ঢুকিয়ে দিয়েছি।
পরদিন পত্রিকাতে ছাপা হলো,
নাজমুস সাকিব তুমি যেখানে থাকো না কেনো ফিরে আসে। তোমার জন্য তোমার মা না খেয়ে আছে, তোমার বোন শয্যশায়ী, তোমার ছোট ভাই মোবাইল টিপছে না। তোমার সব কথা মেনে নেয়া হবে। তুমি ফিরে আসো আর মেইলটা চেক করো, খুব ইর্ম্পোটেন্ট।
কিন্তু এরপরও নাজমুস সাকিব হারামজাদাটা মেইল চেক করে নাই। তাই আমি আবার গেন্ডারিয়া গেলাম। গিয়ে দেখলাম নাজমুস সাকিবের বাসায় পুলিশ। এতোদিনেও ফিরে না আসাতে পরিবার মামলা করেছে। আর বাড়ির আশেপাশে সন্দেহজনক ঘুরাঘুরির এবং এলাকাবাসীর সাক্ষ্য অনুযায়ী পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে হাজতে নিয়ে আসছে। সব খুলে বলার পরও তারা বিশ্বাস করেনি।
উল্টা জিজ্ঞেস করেছে, ‘বল ই-মেইলের ভেতরে কী ছিলো। সত্যি করে বল।‘
-জ্বি একটা অ্যাটাচমেন্ট।
আমার কথা শুনে সবাই সবার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, ‘অ্যাটাচমেন্ট?’
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা হাবিলদার এতোক্ষণে কথা বলে উঠলো, স্যার আমার মনে হয় এলএসডি।
হঠাৎ করে বড় পুলিশ ক্ষেপে গেলেন, হারামজাদা। মেইলেও ড্রাগ চোরাচালন করস?
তবে আপনারা ভাবছেন পুলিশকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারবো না? পুলিশ আমাকে মেরেছে ঠিকই তবে পা ধরে বুঝানোর পর ঠিকই বিশ্বাস করেছে। বিশ্বাস করে দ্রুত তারা একটা টিম তৈরি করে একজনকে দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে এবং জানিয়েছে, যে করে হোক নাজমুস সাকিবকে খুঁজে বের করে তাকে মেইল করতে বলা হবে। কারণ এইটার সাথে পুলিশ প্রশাসনের সম্মান জড়িত।
তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও পুলিশ কোনো সুরাহা করতে পারলো না তখন আমি আবার গেন্ডারিয়া চলে গেলাম। গিয়ে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানালাম, নাজমুস সাকিব নাকি প্রায় রাতের বেলা আসে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতো। তাদের অনেকের ধারনা আমি মেইল চেক করতে বলবো দেখেই নাজমুস সাকিব পালিয়ে আছে। তাকে ধরার জন্য আমিও রাতে বাড়ির আশেপাশে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাত তিনটার সময় পুলিশ আমাকে আবার ধরে নিয়ে গিয়ে পেটালো তাদের ভুল বুঝানোর জন্য। পরে জানতে পারলাম আমার নামে কিডন্যাপিং এর মামলা হয়েছে।
মামলা কোর্টে উঠেছে। আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার বিরুদ্ধে শুধু কিডন্যাপের অভিযোগ তা নয়। খাবারে বিষ মিশিয়ে পুরো পরিবারকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগও আনা হয়েছে। মামলা করেছে নাজমুস সাকিবের বাবা।
বাদী পক্ষের উকিল জিজ্ঞেস করলো, ‘বলুন, সত্য স্বীকার করুন যে আপনি নাজমুস সাকিবকে কিডন্যাপ করেছেন আর তার পরিবারকে খাবারে বিষ মিষিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। স্বীকার করুন।‘
‘হারামজাদাটা কই এখন?’
‘এই যে দেখলেন, আমার আর কিছু বলার নাই মাননীয় আদালত।‘
আমার উকিল অনেক চেষ্টা করেও পারলেন না, আমার সাত বছরের জেল হয়ে গেলো। কিন্তু আমি জেল থেকেই নাজমুস সাকিবের বাসার ঠিকানায় চিঠি লিখতে থাকলাম, ভাই মেইলটা একটু চেক কইরা নিয়েন। খুব ইম্পর্টেন্ট। কিন্তু সেটারও কোনো উত্তর আসে নাই।
ফলে আমার আর কিছুই করার রইলো না। সাত বছর পর আমার মুক্তি হলো। আমার স্ত্রী সন্তানরা জেলের গেইটে দাঁড়ানো। বড় ছেলে নাকি এবার এসএসসি দিয়েছে। স্ত্রীকে কিছু না বলে ছেলেকে নিয়ে রওনা দিলাম শেখেরটেকের দিকে। কারণ নাজমুস সাকিবরা এখন শেখেরটেক থাকে। শেখেরটেক গিয়ে দেখলাম নাজমুস সাকিব লুঙ্গি পরে এলাকার দোকানে চা খাচ্ছে। আমাকে দেখেই লুঙ্গি কাছা মেরে দিলো দৌড়, আমিও পেছনে পেছনে দৌড় দিলাম। নাজমুস সাকিব দৌড়াচ্ছে, নাজমুস সাকিবের পেছনে আমিও দৌড়াচ্ছি আর আমার পেছনে আমার ছেলে। আদাবর মোড় থেকে ভেতরে ঢুকে যাওয়ার আগেই আমি চিৎকার করে বললাম, ‘ভাই, মেইলটা চেক কইরেন। খুব ইম্পর্টেন্ট।’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন