তুতেন খামেনের শেষকৃত্যে উপস্থিত না হতে পেরে যে খাবারগুলো মিস করেছেন

৩০১৬ পঠিত ... ১৪:১৫, জুন ১৯, ২০২০

অলংকরণ: তাইসির

খ্রিস্টের জন্মের ১৩২৩ বছরের আগের ঘটনা। মিশরের পশ্চিম থিবেস।

আপনি বেরিয়েছেন মানস ভ্রমনে। রাজকীয় শেষকৃত্যে যোগ দিতে। ঐ যে নেলসন ম্যান্ডেলার শেষকৃত্যে যোগ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা অন্য নারীর সাথে হেসে হেসে কথা বলায় ফাস্ট লেডি মিশেলের কাছে ধাতানি খেয়েছিলেন, সেরকমই এক বাদশাহী শেষকৃত্য।

মাঝেমধ্যেই লু হাওয়া মুখে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে। সে জন্য সবার পরনেই আলখাল্লা, সঠিক সময়ে নাক-মুখ চাপা দিয়ে আগুনের হলকা থেকে বাঁচার জন্য। অবশ্য আপনি এখন দাঁড়ানো রাজার বাগানে। একটু পূবেই কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলেছে নীল নদ, মিশরীয়দের কলিজার টুকরা নাইল!

বাগানের মাঝখানে জটলা। রাষ্ট্রের সব গন্যমান্য ব্যক্তিরা অটল গাম্ভীর্য্যে দাঁড়িয়ে। থমথমে মুখগুলোতে কোন অভিব্যক্তি নেই। একটু দূরে শামিয়ানা টাঙানো ছায়ার নিচে অন্তঃপুরের মহিলারা। সেখান থেকে মাঝেমধ্যে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হাজার হোক, মায়ের জাত!

জটলার বিশেষভাবে বোনা ধবধবে সাদা চাদরে শোয়ানো আছে ছেলেটার দেহ। সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ। উনিশটা বসন্তও পুরোপুরি দেখে যাবার সুযোগ হয়নি। ম্যালেরিয়ায় ভুগে শীর্ণ দেহ। বাঁ পা সামান্য বাঁকা। চারধারে কড়া পাহারা।

ছেলে বলা অবশ্য ঠিক হলো না। উনি মিশরের মহা পরাক্রমশালী ফারাও, সূর্যের দেবতার বংশধর, তুতেন খামেন! এই নশ্বর পৃথিবীর অধিবাসীদের শাসন করতে মনুষ্য গর্ভে আবির্ভূত হয়েছিলেন, দশটি বছর শাসন করে এখন তাঁর বিদায় পর্ব চলছে।

ক্রমে ক্রমেই পুরোহিতদের মন্ত্র পড়ার আওয়াজ বাড়ছে। শুধু প্রধান পুরোহিত, তিনি শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ বন্ধ, কিন্তু তাঁকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে হাজার বছরের সেই মিশরীয় জাদু তাঁর করায়ত্ত। মমি করবার জাদু!

ইতিমধ্যেই নক্রন উপত্যকার হ্রদের পাড় থেকে আনা নোনা মাটি মাখানো ফারাওয়ের দেহটাকে পরতের পর পরত সাদা কাপড়ে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। রাতের বেলা বিশেষ নলের মাধ্যমে নাকের ফুটো দিয়ে বের করে আনা হয়েছে মগজ। ধীরে ধীরে মন্ত্রপুত কাপড়ের নিচে ঢাকা পড়ে গেলো সারা শরীরটাই। তারপর সেটা মুড়িয়ে দেয়া হলো নানা রকম গয়নায়। গয়নার বহর দেখেই আপনার চোখ আকাশে উঠে গেছে। এর হাজার ভাগের একভাগ পেলেই আপনার বিয়ের গয়নার কাজটা চলে যায়! সবশেষে মুখে পরিয়ে দেয়া হলো রাজকীয় মুখোশ।

বারোটা গরুর গাড়ি প্রস্তুত। তাতে প্রথমে তোলা হলো ফারাওয়ের দেহ, তারপর একটা চৌদ্দটা বস্তা। আপনি পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক সভাসদকে জিজ্ঞেস করলেন- বস্তায় কী?

সভাসদ বললেন- এটা সেই সৌভাগ্যবান দাসদের লাশ, যারা সম্রাটের সঙ্গে শেষযাত্রায় সঙ্গী হচ্ছে।

একটু ইতস্তত করে সভাসদ আবার বললেন- মাত্রই মেরে আনা হয়েছে...

আপনি দাসদের সৌভাগ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

প্রচুর খাদ্য, গয়না এবং অন্যান্য ভোগ-বিলাসের সামগ্রী নিয়ে গরু গাড়ির বহর রওনা হয়ে গেলো। একেবারে বিশ্বস্ত ওমরাহ এবং চাকর-নফর ছাড়া আর কারো যাবার অনুমতি নেই। ওমরাহদেরও কানে কানে বলে দেয়া হয়েছে, কাজ সম্পন্ন করার পর এইসব চাকরকে যেন তাঁরা নিজ হাতে খুন করে আসেন। পিরামিডের ভেতর অতি প্যাঁচানো সড়ঙ্গের প্রবেশপথ যেন আর কেউ না জানতে পারে!

শববাহী শকট যখন দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো, প্রাচীন মিশরীয় ভেঁপু বেজে উঠলো। এ ভেঁপু হলো খাদ্য গ্রহণের সংকেত। ধরা হয়ে থাকে এটা হলো বিদায়ী সম্রাটের পক্ষ থেকে শেষ ভোজ। রাজ্যের মান্যগন্য ব্যক্তি এবং আপনার মত ভীনদেশের কয়েকজন তাতে উপস্থিত থাকেন।

বিশাল বিশাল সামিয়ানার নীচে হলুদ বর্নের কার্পেট। ঠিক কার্পেট নয়, এক ধরনের ভারী হলুদ চাদর মতোন। সবার দেখাদেখি তাতে হাঁটু মুড়ে বসলেন।

লম্বা আলখেল্লা পরা মিশরীয় সুন্দরীরা খাবারের ডালি নিয়ে এলো। আপনি মনে মনে তাদের দেহবল্লরীর প্রশংসা করলেন। পাশে থেকে আরেক ভীনদেশী মেহমান যখন আপনাকে আঙুলের খোঁচা দিয়ে বললেন- বাহ, তোফা। খোদার তৈরী কী অপূর্ব চিজ...

আপনি বুঝলেন, সৌন্দর্য্যের কেবল মনে মনে তারিফ করার উপমহাদেশীয় চল এখানে নেই। যা বলার মুখ খুলেই বলা হয়।

এলো প্রথমে বিয়ার। বিয়ার এখানে পরম আদরনীয়। ছেলে থেকে বুড়ো সবাই আগ্রহ করে বিয়ার খায়। আপনি যদি সোমরস গ্রহণে অভ্যস্ত না হন, তাহলে বাদ। আর অভ্যস্ত হলে টের পাবেন, এ বিয়ার তিতকুটে নয়, মিষ্টি স্বাদের!

বিয়ার আধা লিটারের মতো সবাই খেলে মূল খাদ্য পরিবেশন শুরু হবে। আমরা যেমন গ্লাসখানেক বোরহানী খেয়ে পোলাওয়ের দিকে হাত বাড়াই!

এবার এলো রুটি। সে রুটির কতো বাহার! আড়াই-হাতি লম্বা রুটি, পুর্নিমার চাঁদের মত গোল রুটি (সুকান্তও কি সেই ভোজসভায় গিয়েছিলেন?), ত্রিভুজের মত তিনকোনা রুটি, হাতের আঙুলের সাইজের ক্রিসপি রুটি। আছে নানা সাইজের কেক। আপনি বুঝতে পারলেন, রুটি আর কেকই তাদের স্টেপল ফুড বা প্রধান খাদ্য!

রুটির সঙ্গে এলো সবজি। মটরশুঁটি, মশুর ডালের তত্ত্ব, বিভিন্ন ধরনের বিন, রসুন আর সর্ষে দিয়ে মাখা মাখা করে লেটুসের সালাদ। আপনি চিন্তা করছেন সবজি কি শুধু শুধু খাবেন? নাকি একটু রুটি নিয়ে সবজি খাবেন? চিন্তা করতে করতেই দেখলেন মিশরীয়রা রুটির দিকে প্রথমে হাত বাড়ালেন না। লেটুসের সালাদের ওপর সবজি নেয়ে খাচ্ছে। আপনিও তাই করলেন।

দ্বিতীয় দফায় এলো মাছ। ঢাউস সাইজের মাছের রোস্ট। মাছের কালিয়া। আপনি মনে মনে হাসলেন। মাছ নিয়ে হাজার রকমের ভেলকি দেখানোর বাঙালি কায়দা তাদের জানা নেই!

কিন্তু একী? বাঙালী কায়দার শুঁটকি তারা কোথায় পেলো? হাজার পদের শুঁটকি যেন আসছে তো আসছেই! কি তাদের গন্ধ! কী তাদের স্বাদ! আপনার খেয়াল হলো, নীলের পাড়ে বসে খাবার সময় শুঁটকি না আসাটাই তো অস্বাভাবিক!

শুরু হলো মাংসের পালা। ষাঁড়ের মাংসের ঝাল ভাজি, ভেড়ার আস্ত পায়ের অনবদ্য উপস্থাপনা, পা ভাঁজ করে সেটাকে একটা কাঠি দিয়ে ত্রিভুজ করে রাখা। গরুর জিহবার ঠান্ডা স্যুপ, রাজহাঁসের ঝোল। ছোট ছোট নাম না জানা পাখির আস্ত রোস্ট, বুনো পাখির ডিমের কারি। উটের মাংসের স্টু। আপনি রুটি ছিড়ে তৃপ্তি করে হাত দিয়েই খেয়ে শেষ করলেন। ছুরি কাটার বালাই নেই!

খাবার শেষে এলো আঙুর। মধুতে চুবানো খেজুর। ফালি করে কাটা তরমুজ। আঙুরের আধিক্য দেখে আপনি টের পেলেন, আঙুর ফারমেন্ট করে অত্যুত্তম ওয়াইন বানানোর কায়দা তারা জানে না। নাহলে যে জাতি এমন আকুল হয়ে বিয়ার খায়, ওয়াইনের কদর তারা করে না এটা অবিশ্বাস্য!

খেয়ে ঢেকুর তুলছেন, এমন সময় আবার কানে এলো কান্নার আওয়াজ। হয়তো তুতেনের মা কাঁদছেন, হয়তো অন্য কেউ! আহা, এই সময়ে জন্মালে হয়তো ছেলেটা ইন্টার পরীক্ষা দিতো। হয়তো তার একটা লাজুক বান্ধবী থাকতো, যার কথা মনে হলেই মন মাঝেমাঝে উদাস হয়ে যায়...

আচানক একটা লু হাওয়া যেন আপনাকে ঝাপটা দিয়ে আবার মিশরে ফিরিয়ে আনলো। আপনি আলখাল্লা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলেন। তুতেন খামেনকে মনে মনে লম্বা একটা সালাম জানিয়ে আপনি এখন পথ ধরবেন আপনার দেশের রাস্তায়। যেখানে আরামদায়ক একটা বিছানা আপনাকে অসাধারণ একটা ঘুম উপহার দেয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

৩০১৬ পঠিত ... ১৪:১৫, জুন ১৯, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top