একটি মেসেজ সংক্রান্ত জটিলতায় যেভাবে সাংবাদিক জেলে চলে গেলেন

১৪০৬ পঠিত ... ২০:৪২, জুন ০৪, ২০২০

অলংকরণ: মুবতাসিম আলভী

ওরা বেড়াতে যাচ্ছে কলকাতা। স্বামী-স্ত্রী। কাওসার হাবিব (৩৫), তার স্ত্রী তামান্না (৩২)। তারা রথও দেখবে, কলাও বেচবে। কাওসারের পেটের এক কোণে চিনচিনে ব্যথা। সে ডাক্তার দেখাবে। তামান্না বলেছে, কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় হোটেল নিতে। সে একটু কেনাকাটা করবে। আর তার শখ—এক. সে নন্দনে নাটক দেখবে, মঞ্চনাটক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি দেখবে জোড়াসাঁকোয়। আর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে খাবে পানি ফুচকা।

বিমানে যাচ্ছে তারা। ঢাকায় এয়ারপোর্টে তাদের নামিয়ে দিয়েছে তাদের ড্রাইভার কাদের। বিমান যথাসময়ে ছেড়েছে। আধঘণ্টার মধ্যেই তারা চলে এল কলকাতা বিমানবন্দর। কলকাতাঅলারা এত সুন্দর বিমানবন্দর বানিয়েছে! আমাদের শেখা উচিত। কাওসার বিড়বিড় করতে লাগল। সে আজকেই একটা স্ট্যাটাস লিখবে, ‘কেউ কি আমাদের বিমানমন্ত্রীকে বলবেন, এয়ারপোর্টের বাথরুমগুলো যেন পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হয়। একজন মানুষ বাথরুম থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ঢুকে পড়ে বাথরুম পরিষ্কার করে।’

তারা অপেক্ষা করছে বেল্টে লাগেজের জন্য।

তামান্না বলল, মোবাইলে ওয়াই-ফাই কাজ করছে।

সে তার বড় আপাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে লিখল—

‘পৌঁছে গেছি। স্যুটকেস নেই।’

একটু পরে বড় আপা রিপ্লাই দিলেন, ‘কারটা নেই?’

তিনি ভেবেছেন, স্যুটকেস হারিয়ে গেছে। কার স্যুটকেস হারিয়ে গেছে—তিনি জানতে চান।

তামান্না তখন নিজের স্যুটকেস আসছে কি আসছে না, অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। বেল্টে যেসব স্যুটকেস ঘুরছে, তার সবগুলোর রংই কালো। দূর থেকে দেখে বোঝা যায় না যে কোনটা তাদের। তামান্না মনে মনে বলল, এর পর থেকে ক্যাটক্যাটে কমলা রঙের স্যুটকেস নিয়ে বিমানে চড়ব। তাহলে সবার থেকে আলাদা দেখাবে আমাদের স্যুটকেস।

বড় আপা মেসেঞ্জারে তাকিয়ে আছেন। তামান্না জবাব দিচ্ছে না। তিনি এবার মেসেজ পাঠালেন কাওসারকে। ‘কারটা নেই?’

মেসেজ দেখে কাওসার চমকে উঠল। কার নেই? তার এত শখের গাড়ি। এখনো ব্যাংক লোন শোধ হয়নি। কার কি হারিয়ে গেছে। ড্রাইভার কাদের তাদের নামিয়ে দিয়ে কি গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়নি?

বড় আপাকে মেসেজ পাঠাল কাওসার, ‘কখন থেকে নেই?’

বড় আপা বিরক্ত। কখন থেকে নেই মানে। এটা তো কাওসার আর তার বউ জানবে।

তিনি মেসেজ পাঠালেন, ‘তোমরাই তা ভালো জানো।’

কাওসারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গাড়ি নেই—এটা কি তামান্নাকে বলা উচিত? বললেই তো সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।

না, বলার দরকার নেই। পরিস্থিতি সে একা সামলাবে।

সে বড় আপাকে মেসেজ পাঠাল, ‘কাদের বাড়ি ফেরেনি?’

বড় আপা ভাবলেন, কাদের কথা আবার লিখল কাওসার। তিনি নিজেই লিখলেন, ‘কাদের বাড়ি?’

কাওসার লিখল, ‘আমাদের বাড়ি।’

‘তোমাদের বাড়ি কী হয়েছে?’

বাড়ির আবার কী হলো? কাওসারের মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। একটু আগে শোনে গাড়ি নেই, এখন কি বাড়িতেও কিছু হয়েছে? চুরি নাকি ডাকাতি? নাকি আগুন লেগেছে।

সে লিখল, ‘বড় আপা, আমি কিছুই বুঝছি না। আমাদের গাড়ির কী হয়েছে, আমাদের বাড়ির কী হয়েছে, ভালোভাবে লিখুন।’

একটু পরে তামান্না আর্তনাদ করে উঠল নিজের মোবাইল ফোন দেখে—

: অ্যাই, বড় আপা লিখেছেন, আমাদের নাকি গাড়ি হারিয়ে গেছে।—বলল তামান্না।

কাওসার একা একা পরিস্থিতি সামলাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারল না। তামান্না সবই জেনে গেল।

সে মেসেঞ্জারে কল করল ধানমন্ডি থানার ওসিকে। ওসি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রুমমেট।

ফোন ধরল ওসি। কাওসার বলল, নাজিম ভাই, স্লামালেকুম। আমি কাওসার। আপনার রুমমেট কাওসার। কলকাতা বেড়াতে এসেছি। দেখেন তো আমার গাড়ির ড্রাইভার নাকি গাড়ি নিয়ে ফেরেনি। ওকে তো প্রায় চার ঘণ্টা আগে ছেড়ে দিয়েছি। কই গেল গাড়ি নিয়ে।

: তোমার ড্রাইভারের নাম কী? মোবাইল নম্বর আছে। আপাতত সেটাই পাঠাও। আর পারলে গাড়ির নম্বর পাঠিয়ে দাও।

: গাড়ির নম্বর তো মুখস্থ নেই।

কাওসার ওসি সাহেবকে মেসেজ লিখল, ‘কাদের ড্রাইভার, ফোন নম্বর...।’

একটু পরে ওসি সাহেব মেসেজ পাঠালেন, ‘কাদের ড্রাইভার? তোমার গাড়ির না?’

কাওসার কিছুই বুঝছে না। নাজিম ভাই আবার কী লিখলেন।

একটু পরে কাওসারের বড় ভাই সারোয়ার মেসেজ পাঠালেন, ‘tor gadir ki hoyese?

gadi নাকি নাই!’

কাওসার জবাব দিল।

সারোয়ার ভাইয়ের পরিচিত এক সাংবাদিক আছেন। অনলাইন সাংবাদিক। সারোয়ার ভাই তাঁকে মেসেজ পাঠালেন, Kawsarer gadi nei.

সেই সাংবাদিক সেটা পড়লেন, কাওসারের গদি নাই।

কাওসার নামে এক মন্ত্রী আছেন। সাংবাদিক ভাবলেন, কাওসার সাহেব আর মন্ত্রী নেই। তিনি মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন।

সাংবাদিক সাহেব বড় বড় হরফে অনলাইনে খবর প্রকাশ করলেন, কাওসার সাহেবের মন্ত্রিত্ব শেষ।

মন্ত্রী কাওসার সাহেব সেই খবর পড়ে ঘামতে লাগলেন, কথা কি সত্য? তাঁর কি মন্ত্রিত্ব থাকছে না? তিনি এখানে-ওখানে খোঁজ নিলেন। একটা ছোট দলের নেতা তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্যে মন্ত্রী হয়েছেন। মন্ত্রিত্ব, যৌবন, লিচু—সবই ক্ষণস্থায়ী। আজ আছে, কাল নেই। কচুপাতার পানির মতো সদা টলটলায়মান। তিনি এখানে-ওখানে খোঁজ নিলেন। তাঁর মন্ত্রিত্ব নেই—এই ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতে পারলেন না। ফলে তাঁর বুকের বল ফিরে পেতে লাগলেন মন্ত্রী। তিনি তাঁর এপিএসকে ডেকে বললেন, এই সাংবাদিকটা কে? ওর বিরুদ্ধে মামলা করে দাও। মামলা করবে ৫৭ ধারায়। ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। আমি ফাঁদ দেখিয়ে ছাড়ব। আমার নাম কাওসার হোসেন।

এপিএস ৫৭ ধারায় মামলা করে দিলেন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।

সেই সাংবাদিককে ঝড়ের বেগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল।

এদিকে ধানমন্ডি থানার পুলিশ ফোন দিল কাদের ড্রাইভারকে—

: এই মিয়া, তুই কই?

: কেডা? খবরদার আমারে তুই-তোকারি করবেন না।

: আরে বেডা, তুই কই?

: আরে বেডি, তুই কই?

: হারামজাদা তোরে আগে পায়া লই। রিমান্ডে নিমু।

: আমারে ডিমান্ড দেখাইয়েন না। আমি কাওসার স্যারের ড্রাইভার।

ধানমন্ডি থানা থমকে গেল। কোন কাওসার? মন্ত্রী কাওসার না তো।

কাদেরের কাছে সবাই ফোন করছেন—বড় আপা, সারোয়ার সাহেব।

: কাদের, তুমি কই?

: আমি আমার বাড়ি।—কাদের বলল।

: গাড়ি কই?

: গাড়ি স্যারের ফ্ল্যাটে।

: আসো তুমি ফ্ল্যাটে।

বড় আপা, সারোয়ার ভাই ছুটে গেলেন কাওসারদের ফ্ল্যাটে। গাড়ি রীতিমতো শোভা পাচ্ছে তাঁদের পার্কিং লটে। কাদের বলল, কী সমস্যা কন তো?

একটু পরে একটা পুলিশ ভ্যান এসে হাজির—

: কাদের কে?

: আমি।

: ওই বেটা চল থানায়।

কাদের এখন ধানমন্ডি থানায়। অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক সাহেবও ধানমন্ডি থানায়। কাদেরকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হলেন বড় আপা। থানার ওসি নাজিম ছিলেন কাওসারের রুমমেট। বড় আপাকে তিনি চিনতে পারলেন। গাড়ি যথাস্থানে আছে শুনে কাদেরকে ছেড়ে দিল পুলিশ।

কিন্তু অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিককে তো ছাড়া যাবে না। মন্ত্রী মামলা করেছেন ৫৭ ধারায়। জামিন অযোগ্য ধারা।

বড় আপা মেসেজ পাঠালেন কাওসার আর তামান্নাকে। গাড়ি আছে গ্যারেজে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে।

তারা একটা সিমকার্ড কিনল। ফোন করল বড় আপাকে—

: কী হয়েছে?

: কিছু হয়নি। কোত্থেকে যে তোমরা খবর পেলে গাড়ি চুরি হয়ে গেছে।

: আপনিই তো বললেন।

: আমি কখন বললাম?

: আপনি মেসেঞ্জারে লিখলেন না, কারটা নেই?

ওহ, ওহ! আমি তো লিখেছি, কার স্যুটকেস নেই।

তামান্না বলল, আর আমি লিখেছিলাম, স্যুটকেস নেই, সুটকেস নিই। মানে স্যুটকেস গ্রহণ করি।

বড় আপা হাসতে লাগলেন।

শুনে কাওসার আর তামান্না হাঁফ ছাড়ল।

এবার একটু কলকাতা শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। যা ঝামেলা গেল।

উফ্ফ।

বড় আপা বললেন, শোনো, কাদের ড্রাইভার কী করেছে?

: কী করেছে।

কাওসারের নাম লিখে রেখেছে, cow sir।

ফোন স্পিকারে দেওয়া। তামান্না খিকখিক করে হাসছে। কাওসার বলল, এটা কোনো হাসির কথা হলো। এই রকম বিকটভাবে হাসছ কেন?

তামান্না বলল, না না, এটা মোটেও হাসির ব্যাপার না। এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার।

: শোনো, আমি ঠিক করেছি নন্দনে তোমাকে নিয়ে যাব না --কাওসার বলল।

: প্লিজ, প্লিজ। আমার একটা স্বপ্ন, নন্দনে মঞ্চনাটক দেখব। এই যে আমি হাসছি না। দেখো দেখো, আমি কী গম্ভীর!--বলেই ফিক করে হেসে দিল তামান্না।

ওদিকে সাংবাদিক সাহেব থানাহাজত থেকে জেলখানায় নীত হলেন।

১৪০৬ পঠিত ... ২০:৪২, জুন ০৪, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top