জাদুর কার্পেট থেকে আপনি আর দৈত্য দেশে দেশে ঈদের খানাদানা যেমন দেখলেন

৬৭১ পঠিত ... ১৮:০৯, মে ২৪, ২০২০

অলংকরণ: তাইসির 

ভয়ংকর রাগ উঠলে মাঝেমধ্যে যে নিজেকেই লাথি মারতে ইচ্ছা করে, আপনি এখন সেই অবস্থায় আছেন!

আপনি যে একটু বোকাসোকা কিসিমের- সেটা আপনি নিজেও জানেন, কিন্তু তাই বলে এত বড় বেকুবী করার লোক তো আপনি না!

ইফতার-টিফতার সেরে তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলেছেন কি তোলেন নি; এরইমধ্যে খবর চলে এসেছে যে চাঁদ দেখা গেছে! কালকে ঈদ! ঈদের খুশিতে আপনি খুশি হতে যাবেন, তখনই বজ্রপাত হবার মতো মনে পড়েছে যে ঈদের অতি অবশ্য কাজ সেমাই খাওয়ার জন্য দুধটাই এখনও আপনার কেনা হয়নি! এই লকডাউনে দুধের দোকান খোলা আছে কিনা কে জানে?  

মুখের ওপর মাস্ক আর হাতে গ্লাভস জড়িয়ে উদাস মুখে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছেন দুধ কেনার জন্য!

কিন্তু একী! বাজারে তো আপনি একা নন! আপনার মতো হাজারে হাজারে বেকুব বাজারে থলে হাতে ঘোরাঘুরি করছে। আর সুযোগ পেয়ে দোকানদার দুধের দাম ঐ আকাশের চাঁদের কাছাকাছি তুলে রেখেছে। আপনি মনে মনে হিসাব করে দেখলেন, দুই লিটার দুধের দামে মোটামুটি হালকা দেখতে পাওয়া চাঁদে একবার ঘুরে আসা সম্ভব! আর কোয়ারেন্টিন? সে জিনিস গেছে! করোনাভাইরাসের আজকে পোয়াবারো।

কাজেই এমন বেকুবীর জন্য নিজেকে লাথি দেয়ার ইচ্ছে হওয়াটা খুব দোষের কিছু না! সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। নিজেকে লাথি মেরে ফেলা ব্যাপারটা খুব সহজ কিছু না। বার কয়েক চেষ্টা করে আপনি ব্যর্থ হলেন, তারপর রাগের চোটে সামনে পড়ে থাকা রাস্তার পাশের একটা পুরানো প্রদীপের ওপর গায়ের ঝাল ঝেড়ে একটা লাথি কষালেন!

হঠাৎ কী হলো আপনি বুঝতে পারলেন না, প্রদীপ থেকে হুশহুশ ধোঁয়া বেরোতে শুরু করলো। আপনি মনে মনে ভাবলেন- খেয়েছে! পড়ে থাকা গ্রেনেড-টেনেডে আবার লাথি দিয়ে ফেললাম নাকি!

ততোক্ষণে ঘটে গেছে আরেক কাণ্ড। আপনার হাজার বার পড়া আলিফ-লায়লার মতো ঠিক অবিকল সবুজ রঙের একটা দৈত্য বেরিয়ে এসেছে প্রদীপ থেকে। মাথায় তার শরীরের মতোই সবুজ রঙের শিং! চোখে গাঢ় করে সুরমা দেয়া!

আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দৈত্য বললো- হুকুম করুন মালিক! কী চাই?

ঐযে বললাম, আপনি একটু বেকুব কিসিমের আছেন? কোথায় ঈদের আগে ডুপ্লেক্স বাড়ি, প্রাডো গাড়ী, সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের হুকুম দিয়ে দৈত্যকে তটস্থ করে ফেলবেন; আপনি কিনা বললেন- ইয়ে দৈত্য, আমার দুই লিটার দুধ চাই। সেমাই বানিয়ে খাবো!

দৈত্য হতাশ গলায় গা মুচড়ে বললো- ও মালিক। আপনার হাতের ব্যাগের ভিতরে তাকিয়ে দেখুন, দুই লিটারের মিল্ক ভিটার প্যাকেট চলে গেছে।

আপনি খুশি হয়ে বললেন- থ্যাঙ্কিউ!

দৈত্য ইতস্তত করে বললো- তবে মালিক চাইলে আপনি কিন্তু আরও কিছু চাইতে পারেন। এই পর্যন্ত আমাকে যতোজনই ঘষা দিয়ে প্রদীপ থেকে বের করেছেন, একেবারে কমে কেউই আমাকে ছেড়ে দেননি!

আপনি খুশি হয়ে বললেন- তাহলে তোমার জাদুর কার্পেটে আমাকে চড়িয়ে দেখাবে? আলাদিনকে যেভাবে দেখিয়েছিলে?

বলামাত্রই আপনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন উড়ন্ত কার্পেটে আধশোয়া বস্থায়। আপনার সামনে সোনার বাটিতে আখরোট, তরমুজ। রুপার পানপাত্রে ঝাঁজালো ফান্টা! আর সামনে হাতজোড় করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে দশসই শরীরের দৈত্য!

আপনি ততোক্ষণে গিয়ারে চলে এসেছেন। দৈট্যকে হুকুম দিলেন- চলো দৈত্য। আমি দিন-দুনিয়ার মানুষ ঈদ কিভাবে করে দেখতে চাই। তবে, লকডাউনের ঈদ না। করোনা ছাড়া ঈদ দেখাও। 

দৈত্য বললো- জো হুকুম জাঁহাপনা। চলুন তাহলে...

 

২.
আপনি যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। চোখের সামনে কলকাতার হাওড়া ব্রিজ পেরুলেন, আগ্রার তাজমহল পেরুলেন, দিল্লীর কুতুবমিনার পেরুলেন... এরপর আরও আরও অনেক দূর যাবার পর দৈত্যকে বললেন- আরে আরে রাখো রাখো এখানে...

দৈত্যের খানিকটা ঝিমানো মতোন এসেছিলো। টকটকে লাল চোখ খুলে বললো- কী হুজুর?

আপনি সবিষ্ময়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন- এইখানে এতগুলো লোক দুই হাতে ডিম ভর্তি করে গম্ভীর মুখে কোথায় যাচ্ছে?

দৈত্য তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে হেসে বললো- হুজুর, এটা আফগানিস্তান। ঈদের দিনে তারা এই ডিম ভাঙা খেলা খেলে। চলুন দেখি।

কার্পেট থেকে নেমে একটা পার্কে এসে দাঁড়ালেন। দৈত্য আপনাকে জানিয়ে দিয়েছে যে আফগানিস্তানের ঈদ উৎসব পার্ক নির্ভর। রাজ্যের লোক পার্কে এসে জড়ো হয়েছে। প্রায় সবার হাতেই কয়েকটা করে ডিম। সিদ্ধ ডিম! আপনি ভাবলেন, হয়তো সবাই এখন খোসা ছাড়িয়ে ডিম খাওয়া শুরু করবে।

ওমা! কোথথেকে কে একজন বাজখাঁই গলায় একটা চিৎকার দিলো, অমনি সবাই একজন আরেকজনের ডিমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো! আপনি অবাক হয়ে দেখছেন, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই ডিম ভাঙার মহাযজ্ঞে নেমে পড়েছে, ডিম সই করে মারছে আরেকজনের মুখে! এটাই আফগানদের ঈদের 'ডিম-যুদ্ধ' খেলা!

এক দশাসই আফগান আপনার দিকে কোথা থেকে যেন তেড়ে এলো, আপনি 'দৈত্য গো...' বলে একলাফে কার্পেটে উঠে বসলেন। কার্পেট আবার এগিয়ে চললো আপন গতিতে।

 

৩.
কিছুক্ষণ পরেই কার্পেট আবার নামা শুরু করলো। আপনি জিজ্ঞেস করলেন- ব্যাপার কী দৈত্য?

দৈত্য বললো- হুজুর, যে হারে আপনি আখরোট, খোবানী সাবাড় করে চলেছেন, তাতে আমার প্রদীপের স্টকেও টান পড়েছে! ইরান থেকে চলুন আবার রিফিল করে নেই।

আপনি কার্পেটে করে নেমে এলেন ইরান দেশে। ঈদুল ফিতরের ইরান। চারদিকে খুশির আবহ। কিন্তু একী? এ যে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের কোরবানীর ঈদ!! বাড়িতে বাড়িতে রক্তের নহর বয়ে যাচ্ছে! জবাই হচ্ছে অসংখ্য ঊট-দুম্বা-গরু-খাসী! ব্যাপারটা কী?

দৈত্য ততোক্ষণে রসালো খরমুজের প্যাকেট নিয়ে ফেরত এসেছে। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো- ইরানীরা এমনই হুজুর। গরীব-দুখীদের বিলাবে, নিজেরাও একটু চাখবে- তাই এইদিনে একটু গরু-ছাগল কাটাকাটি হয় আরকি...

কী হুজুগে দেশরে বাবা, রোজার ঈদে কোথায় একটু আতর মেখে পাঞ্জাবী গায়ে ঘুরবে, তা না করে মাংসের কারবার... বিড়বিড় করতে করতে আপনি আবার উঠে বসলেন কার্পেটের ওপর।

এবার কিন্তু কার্পেট গতি ধরলো দক্ষিণের। আপনার চোখের সামনেই জর্ডান পেরুলো, তারপর সুয়েজ খালের কানাগলিটা পেরিয়েই চোখে পড়লো পিরামিড! মিশরের পিরামিড!!

মিশরীয়রা ঈদের নামাজ পড়েছে একটু আগেই। এখন তাদের মূল উৎসব হলো নাইলকে ঘিরে! নীল নদ!!

তাতে উৎসবের রঙে রাঙানো নৌকায় শত শত মাছ ধরা হচ্ছে। নৌকায় জাল তোলা হলে তীরে উৎসাহে ফেটে পড়ছে ছেলে-বুড়ো সবাই। অন্যদিকে, মেয়েরা সব বাড়িতে ব্যস্ত মাছের কাঁটা বাছায়। অন্যান্য সময় মাংস মিশরীয়দের খুব প্রিয় খাবার হলেও, ঈদের দুপুরে তাদের টেবিলে চাই মাছের কালিয়া, মাছের কোপ্তা, মাছের কাবাব! সাথে রুটির সাথে বড় মাছের কলিজা!

এতোক্ষণে আপনার মনে পড়লো, এই রে... বাসায় দুধ না নিয়ে গেলে সেমাই রান্না হবে কিভাবে? দৈত্যকে বললেন- চলো হে। একটু ঐদিকে ইন্দোনেশিয়াটা একপাক ঘুরে ফেরত যাই।

দৈত্য মাথা চুলকে বললো- এতো থাকতে ইন্দোনেশিয়ায় কী হুজুর?

আপনি বললেন- আরে! সবচেয়ে বেশি মুসলমানের দেশে ঈদটা কিভাবে করে একটু দেখে আসা দরকার না?

দৈত্য ছোটালো তার কার্পেট রথ। সাত সমূদ্র তেরো নদী পেরিয়ে নামলো ইন্দোনেশিয়ার বুকে। ঈদের তখন দুপুর। সবাই খেতে বসেছে। আপনাকে দেখে দাওয়াতও করলো কয়েকজন। আপনি বসলেন। তারা জিজ্ঞেস করলো- কী দিয়ে শুরু করবেন হে অতিথি?

আপনি মাত্রই মিশর থেকে এসেছেন। কাজেই সে অভিজ্ঞতা থেকে বললেন- মাছের কাবাব?

ইন্দোনেশীয় মেজবান চোখ কপালে তুলে বললেন- কী?

আপনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন- তাহলে মাছের কালিয়া?

মেজবান কটমট তাকিয়ে বললেন- তবে রে...

আপনি নাচার হয়ে বললেন- একটু মাছের কলিজা ভাজা!!

এইবার খন্তাটা হাতে নিয়ে ইন্দোনেশীয় মেজবান তেড়ে এলেন- কোথথেকে এসেছে ব্যাটা মিসিকীন...

আপনি লাফ দিয়ে কার্পেটে উঠে দৈত্যকে আঁকড়ে ধরলেন। দৈত্য সবেগে কার্পেট চালিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো- হুজুর, ইন্দোনেশীয়ায় ঈদের দেশে মাছ খেতে চাওয়ায় মানে গৃহকর্তাকে অপমান করা। আপনার গায়ে যে হাত তোলেনি আপনার ভাগ্য।

আপনি বললেন- যথেষ্ট হয়েছে। এবার বাড়ি চলো।

দৈত্য বললো- এক মিনিট হুজুর। আপনি ইন্দোনেশীয়র কাছে তাড়া খেয়ে একগাদা কাঁদা জুতায় মেখে কার্পেটে এসে লাফিয়ে উঠেছেন। আমরা একটু কার্পেটটা মুছে নেবো।

আপনি বললেন- আচ্ছা, মুছে নাও। কোথায় এলাম এটা?

দৈত্য হাতজোড় করে বললো- হুজুর, এটা মায়ানমার।

আপনি নামতেই একদল লোক পরিষ্কার বাংলায় চিৎকার করতে করতে আপনার দিকে ছুটে এলো। কী বলছে তারা? 'ঈদ নেই...' 'ঈদ নেই...'

আপনি অবাক হয়ে দেখলেন, ঈদ নেই বলতে বলতেই তারা আপনার সাথে কোলাকুলি করলো। দৈত্য ততোক্ষনে কার্পেট ধুয়ে ফেরত এসেছে। আপনার কানে কানে বললো- ঈদ নেই মানে ওদের ভাষায় ঈদ মোবারক।

তারপর আবার কানে কানে বললো- অবস্থা সুবিধের নয় হুজুর। চলুন মানে মানে উড়াল দেই...

আপনি অবাক হয়ে বললেন- কী হয়েছে আবার?

দৈত্য বললো- এই দেশে তেমন কোন ইসলামী সংস্থা নেই যারা চাঁদ দেখার কথা জাতীয়ভাবে ঘোষণা করবে। তাই প্রতিবার চাঁদ দেখা নিয়ে গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি হয়। একেক গোষ্ঠী একেকদিনে ঈদ পালন করে। তেমন গ্যাঞ্জাম আসার আগেই চলুন ফেরত যাই।

আপনি বললেন- চলো তাহলে...

 

৪.
কিছুক্ষণ পরেই আপনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন আবার সেই লকডাউনে স্তব্ধ, শাটারে টক টক টক তিন টোকার শব্দ হওয়া আপনার বাসার পাশের বাজারে। হাতে দুধের প্যাকেট নিয়ে আপনার তখন খুশির সীমা নেই। দৈত্যকে বললেন- তবে যাই বলো না কেন দৈত্য, সকালের নাশতায় বেহেশতি সেমাই খাওয়ার সাথে আসলে আর কোন দেশের ঈদের তুলনা নেই।

দৈত্য মাথা চুলকে বললো- হুজুর, ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি?

আপনি বললেন- তোমার মুখ আবার ছোট কোথায় হে? দৈত্যর মতোই তো মুখ! আচ্ছা বলে ফেলো।

দৈত্য বললো- বলছিলাম কি, ঈদ আসলে কোনটাই খারাপ নয়। আপনি এভাবে উৎসব করে অভ্যস্ত দেখে আপনার কাছে এটা সেরা। আবার আফগানদের জিজ্ঞেস করে দেখুন- ডিম ভাঙার চেয়ে সেরা ঈদ উৎসব আর কিছু হতেই পারে না!

আপনি মাথা নাড়লেন। দৈত্য'র কথা আপাতত খুশির চোটে মাথায় ঢুকছে না। আগামীকাল সেমাই খাবার স্বপ্নে বিভোর আপনি দুধের প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসার পথে পা বাড়িয়েছেন, কোথথেকে যেন টিভির গানের আওয়াজ ভেসে আসছে-

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ… 

৬৭১ পঠিত ... ১৮:০৯, মে ২৪, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top