সম্রাট শাহজাহানের দরবার। বিশ্ববিখ্যাত ময়ুর সিংহাসনে স্মিতমুখে বসে আছেন বাদশাহ। মাথায় তাঁর কোহিনুর খচিত রাজমুকুট। আপনি দরবারে কিছুটা লজ্জিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
লজ্জা পাবার অবশ্য কারণ আছে। বাংলাদেশ থেকে সম্রাট শাহজাহানের আতিথেয়তা গ্রহণ করার জন্য যাচ্ছেন। আর সবাই যা নেয়, আপনিও তাই নিয়ে গেলেন- মীনাবাজারের অর্গানিক মিষ্টি, প্রাণের ম্যাংগো বার।
ওখানে গিয়ে দেখলেন সম্রাটের মাসিক হাট- যেটার নামও মীনাবাজার; সেটা শুরু হয়েছে। তাতে কেনাকাটা করতে হারেমের অন্তঃপুরবাসিনীরা স্রোতের মতো নেমে এসেছে। এমন কোন জিনিস নেই যেটা সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী মিলে বিভিন্ন দোকানীর সাথে দরদাম করছেন, কৌতুক করছেন, তারপর তাদেরকে হতভম্ব করে শতগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনে ফেলছেন। এহেন মীনাবাজারের উদ্যোক্তাকে আপনার বাঙাল মীনাবাজারের মিষ্টি উপহার দিতে গেলে তো একটু লজ্জা লাগারই কথা!
আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, কেননা দরবার বসেছে দেওয়ান-ই-আমে। এখানে বাদশাহ ছাড়া আর সবার দাঁড়িয়ে থাকারই নিয়ম। উপরেই দেখা যাচ্ছে পাতলা পর্দার চিক। কে জানে তার ভেতর থেকেই হয়তোবা রাজ্য পরিচালনা আগ্রহ নিয়ে দেখছেন মুমতাজ মহল।
বাদশাহ হাততালি দিয়ে মীর বাকাওলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। মীর বাকাওল হলেন বংশ পরম্পরায় মুঘল বাদশাহদের সিদ্দীকা কবীর। বাদশাহ ফরমান জারি করলেন- বাঙ্গাল অতিথি আগমন উপলক্ষ্যে আজকে শাহী মেহমানদারী হবে। অতি স্বত্তর তিনি মেহমানখানায় যেতে আগ্রহী।
আপনি জানেন, একবার বাদশাহের শাহী মেহমানদারীর ফরমান জারী হওয়া মানে এক এলাহি কারবার। ঘণ্টাখানেক সময়ের মাঝে শ'দুয়েক লোকের জন্য প্রায় একশটারও বেশি পদের ডিশ সাপ্লাই দিতে হবে বাদশাহি কিচেনকে। অবশ্য আপনি এটাও জানেন যে বাদশাহী হেঁশেল আপনার মধ্যবিত্ত বাঙালীর মাঝারী ফ্রিজ নয়। এই ধরনের আয়োজনের জন্য সেখানে সার্বক্ষনিক বাঁধা দুম্বা, ছাগল, উট, রাজস্থানী ময়ূর।
কিছুক্ষণ রাজকার্য চালানোর পর সম্রাট বললেন- অতিথিকে দাঁড় করিয়ে রাখা আমার কওমের বৈশিষ্ট্য নয়। মেহমানঘরে যাওয়া যাক।
বাদশাহ উঠে দাঁড়ালেন। মেহমান হিসেবে আপনার স্থান হলো বাদশাহের সাথেই। অন্যরা আপনার পিছু পিছু...
রওনা দিয়েই অবশ্য বাদশাহ মেহমান খানায় ঢুকে গেলেন না। নাম ডাকা না হলে রাজপুরুষদের হঠাৎ কোথাও ঢুকে পড়া মানায় না। আপনি ছাপোষা বাঙালী। আপনার আর কী? আগে আগেই ঢুকে গেলেন মেহমান ঘরে...
বিরাট ঘর মোমবাতির ঝাড়ের আলোয় উজ্জ্বল, এখানে ওখানে পিদিমদানের উপর জ্বলছে পিদিম। দেয়ালের কোনায় খাটানো জ্বলন্ত মশাল। সে সব বাতি ঠিকমত জ্বলছে কিনা তা দেখাশোনায় ব্যস্ত যিনি তিনি হলেন চেরাগখানার দারোগা, সারা প্রাসাদ আলোকিত রাখার দায়িত্ব এঁরই উপর ন্যস্ত।
শ্বেতপাথরের বিরাট ঘরে পাতা দুর্মূল্য পারস্যদেশীয় কার্পেট, দরজা জানালায় মখমলের উপর সুক্ষ্ণ কাজ করা দামি পর্দা । কার্পেটের উপর এবার পাতা হলো নরম তুলার তৈরি কারুকাজ করা জাজিম। তার উপর মসলিনের সাদা চাদর। এই চাদরের উপর মীর সাহেব আর তোষকখানার দারোগার তদারকিতে পাতা হচ্ছে সোনার সুতার কাজ করা রেশমের আরেক চাদর, বাদশাহি দস্তরখান। এরই উপর একপাশে বসবেন বাদশাহ, তাই সেদিকে দেয়া হয়েছে মখমলে মোড়া ঢাউস সাইজের বালিশ। খেতে খেতে বাদশাহ যদি হেলান দেন! মেহমান হিসেবে আপনার জন্যও ঢাউস বালিশ। বাকীরা খাদ্য গ্রহণ করবেন শুধু, হেলান দেয়ার অধিকার তাঁদের নেই...
ইতোমধ্যে ব্যস্ততা চূড়ান্ত পর্যায়ে। খাপখোলা তলোয়ার হাতে সেনারা ঘেরাটোপে রেখে কী যেন বাকসো মতোন নিয়ে আসলো। কী এটা? পর্দাঘেরা পালকী? তবে কি রুপসী শ্রেষ্ঠা মুমতাজ মহল আপনাকে দেখা দেবেন? এতোই সৌভাগ্য আপনার?
পেছনে দেখা গেলো পাহারা দেয়া আরেকটা বাকসো। তার পিছে আরেকটা। এতোগুলো মুমতাজ মহল তো আর সম্ভব নয়!
ঘেরাটোপ খোলা হলো। তা থেকে বেরুলো হরেক পদের খাবার! সম্রাটের খাবারে যেন কেউ বিষ মেশানোর সুযোগ না পায়, তাই এই বাড়তি সতর্কতা! খাবারের সিন্দুক থেকে ফর্দ দেখে খাবার নামিয়ে দস্তরখানে রাখছে একান্ত বিশ্বস্ত খোজা প্রহরীরা সব যখন একেবারে রেডি তখন অনেক গুণবাচক শব্দ উচ্চারণ করে নকিব হাঁক দিলেন- বাদশা হা...জি...র...
সবাই একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পরে বাদশাহকে কুর্নিশ করলো। সবার দেখাদেখি আপনিও!
হতে পারেন তিনি তামাম হিন্দুস্তানের বাদশাহ, কিন্তু এখানে তো তিনি মেজবান! স্ব্য়ং তাতার বংশের খানদান! আর আপনি মেহমান। কাজেই বিনীতভাবে বাদশাহ আপনাকে বললেন- দয়া করে নুনরুটি গ্রহণ করুন। আপনি ঝুঁকে মাথা নাড়লেন। বাদশাহ উচ্চগলায় বললেন- বিসমিল্লাহ!
সবাই খাদ্যগ্রহণ শুরু করলো।
প্রত্যেকটা পদ সামনে আসছে আর মীর বাকাওল শেষ বারের মত খাবার চেখে, বাদশাহকে আর আপনাকে পরিচিত করাচ্ছেন প্রতিটা পদের সাথে । বাদশাহের সামনে দেয়া হয়েছে হালকা সবুজ রঙের পাথরের বর্তন। এর নাম পাই জহর। এটি একইসাথে বিষের প্রতিষেধক ও নির্ণায়ক। বিষ মেশানো খাবার এইপাত্রে রাখলে বিষ নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে, আর তার সাথে সাথে পাত্রের রঙ হয়ে উঠবে গাঢ় নীল!
বাদশাহ আকবরের অতি প্রিয় খাবার ছিলো একশো তিন রকমের ডাল মিশিয়ে একটা ক্বাথ, সাথে হালকা ঘিয়ে ভাজা টাটকা লুচি। ঐতিহ্য বজায় রাখতে শাহজাহানও রাজকীয় ভোজ এটা দিয়েই শুরু করেন। সাথে তিনি যোগ করেছেন কোরমা। নানা ধরনের কোরমা তাঁর ভীষন প্রিয়! তার জন্য কোরমা তৈরিতে যে ব্যয় হয় তা একজন ধনী লোকের এক মাসের বাজার খরচের সমান! কাজেই ভোজসভায় উপস্থিত থাকা ধনী লোকেরা মহা উৎসাহে চেটেপুটে খাবেন তাতে আর সন্দেহ কী?
রয়েছে কয়েক রকমের রুটি। শিরমাল রুটি, চাপাতি রুটি, নানরুটি, বোগদাদি রুটি, আফগানী রুটি, প্যাঁচ পরোটা, কাকচা, কুলিচা, নানখাতাই। খোসকা পোলাও, কাশ্মিরী পোলাও, বিহারী ঘি-ভাত। যাদের সহজ-পাচ্য খাদ্যে রুচি তাঁদের জন্য রয়েছে অতি লম্বাটে চালের জড়ানো ভাত, প্রথম দেখায় আপনার যাকে ম্যাগি নুডলস বলে ভ্রম হবে।
রয়েছে শিক কাবাব, হাড্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামি ও টিকা কাবাব, ঝলসানো বনমোরগ, কিসমিসের রসে ভেজানো ঘিয়ে ভাজা মোলায়েম পাখির মাংস। পাখির মাঝে রয়েছে হরিয়াল, পাহাড়ি তিতির, বিশেষ শ্রেণির ময়ূর। কচি বাছুরের গ্লাসি। মাটন রেজালা। আস্ত ভেড়ার রোস্ট। লবণ দেয়া হরিণের মাংস, মুচমুচে করে ভাজা ঊটের ছোট ছোট টুকরো বিশেষ।
শেষ পাতে আফগানদের বিশেষ প্রিয় খারবুজা, তরমুজ এবং ভারতবর্ষীয় আম। শরবত এবং কড়াপাকের সন্দেশ। খাবার শেষে পান। এরপর হাতে লাগানো হলো বাদশাহী আতর। আতর হলো খাবার শেষ হবার চিহ্ন।
আমাদের মুঘল সাম্রাজ্য পরিদর্শন এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু এমন মানস ভ্রমণ থেকে ফিরিয়ে এনে আগেও অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে! অতএব, কী দরকার...
হাজার বছর আপনি মুঘল বাদশাহের মেহমান হিসেবে থেকে গেলেন। বাদশাহী ভোজের শাহী ফরমান আপনার জন্য নিত্য জারী হতে লাগলো। মুহুর্মুহু সুখে আপনি কাতরপ্রায়, আর আপনার এহেন সৌভাগ্যে আমরা বাকীরা সবাই ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরোমরো...
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন