ট্রেনে উঠলে মানুষ উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকায়। দৃষ্টি তার পাখা মেলে গ্রামের পুকুরের দিকে, কিম্বা চেয়ে থাকে রাখাল ছেলের দূরের মাঠে গরুর পাল নিয়ে যাওয়ার দিকে।
ছোটবেলায় আমার দৃষ্টি থাকতো একদম এর উলটো। ভেতরের দিকে!!
এতো সময় কোথায় আমার?? গণ্ডায় গণ্ডায় ফেরীওয়ালা জাদুকরী সব খাবার নিয়ে চলে যাবে পাশ দিয়ে- ঐ জিনিস মিস করা সম্ভব?? আহ্লাদ নাকি??
এমনিতে আব্বাকে আমরা বাঘের মতো ভয় পেতাম। কথার কথা না, খেয়াল আছে চিড়িয়াখানায় গিয়ে একবার আব্বার ধমক খেয়ে দিশেহারা হয়ে ছিটকে প্রায় খাঁচার বাঘের উপর পড়তে গিয়েছিলাম! মাঝখানে বাউন্ডারি থাকায় রক্ষা!!
এহেন আমার আব্বা এইসব জার্নির সময় পুরো অন্য মানুষ। ফুরফুরা মেজাজের। এই সময় যা চাওয়া যেতো কোনকিছুতেই আব্বার মানা নেই! মাঝেমধ্যেই আফসোস হতো ট্রেনে কেন আস্ত খাসীর রোস্ট পাওয়া যায় না! থাকলে হয়তো আব্বা ওটাও কিনে দিতেন!!
অবশ্য যা দিতেন সেগুলিও বা রোস্টের চেয়ে কম কী? ট্রেন থেমে থাকা অবস্থায় শুরু হতো বানানা চুইংগাম আর চুইং জিঞ্জার দিয়ে! আহা!! ব্যানানা চুইংগাম!! আমার আস্ত কলা খাবার সময়ও বানানা চুইংগামের কথা মনে পড়ে চোখে জল আসে!!
থেমে থাকা অবস্থাতেই আসতো পেপারওয়ালা। আব্বা নিতেন দৈনিক কাগজ, আম্মা ম্যাগাজিন কোন একটা, আমি একটু বেশি শিক্ষিত। দুইটা ম্যাগাজিন নিতাম- ক্রীড়ালোক আর উন্মাদ!! মাঝখানে ফুটবল লীগে মোহামেডানকে হারিয়ে আবাহনী পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ক্রীড়ালোক কেনার আগ্রহে ভাটা পড়েছিলো। সেই আগ্রহ আর ফিরে আসেনি!!
টঙ্গী পেরুনোর আগেই চিপসওয়ালা হাজির!! মুখের চুইংগাম থু করে ফেলে আমি ততোক্ষণে চিপসে কামড় দেবার জন্য তৈরী!! সেই চিপসও আবার দুই রকমের হতে হবে। আঙ্গুলে ভরে আংটি বানিয়ে রিং চিপস বা বম্বে স্টিকস, সেই সাথে চিকেন চিপসের ছদ্মবেশে সাদা আলুর চিপস। শেষেরটা মুরুব্বী মহলেও বেশ গ্রহণযোগ্য ছিলো।
মাঝের টাইমে তিলের খাজা আসতো, কেক আসতো, পেটিস আসতো, রুমালওয়ালা আসতো। কোন স্টেশনে ট্রেন থামলে উঠতো কলাওয়ালা আর পানির কলসি হাতে আমার বয়সী ছোট ছোট বাচ্চা। কী মজার মনে হতো ওদের জীবন!! পরীক্ষা নাই, স্যারের হাতে কানমলা নাই, বার্ষিক পরীক্ষার পরে আব্বার কাছে রিপোর্ট কার্ড সাইন করানোর ভয় নাই!!
ঐ সময়ে মিনারেল পানির চল ছিলো না, সচেতন যারা তারা বাসার থেকে বোতলে পানি নিয়ে আসতেন। বোতলই বা ততো পাবে কই? তখন কোকের বড় বোতলও ছিলো কাঁচের।
সকাল এগারোটার দিকে ট্রেনে উঠতো চানাচুরওয়ালা। ১ বা ২ টাকার চানাচুর তারা বারো রকমের মশলা, পেঁয়াজ-মরিচ-সর্ষের তেল দিয়ে এমন একটা তালে তালে ঝাঁকানো দিতো, সেই তাল কেবল এখন আর্মি স্টেডিয়ামের কনসার্টে ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলায় শুনতে পাই!!
এরপর ট্রেনের সাদা উর্দি পরা সার্ভিসম্যানরা প্লেট হাতে ঘোরাঘুরি শুরু করতেন। আমাদের মনে হতো হাতে তাঁরা বেহেশতের টুকরা নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। আব্বার চোখের ইশারায় সেটা আমার হাতের নাগালে চলে আসতো!!
সেই বেহেশতি সওগাতে থাকতো তেলতেলা বোম্বাই টোস্ট, সাদা পেপারে জড়ানো কাটলেট। একটু কুঁচানো সালাদ। টমেটোর ঘন সস! আমি আকুল হয়ে কাটলেটে কামড় দিতাম। সসে গুঁতো দিয়ে মুখে গুঁজতাম বোম্বাই টোস্ট!!
ঢেকুর তোলার আগেই ওভালটিন চা!! দুধ-চা, রং-চা, কফি বাদ দিয়ে এই পরিমাণ ওভালটিন প্রীতি আমার আর কোথাও দেখার সৌভাগ্য হয়নি!
ট্রেনেই একবার আমি বিশাল রকমের একটা আবিষ্কার করে ফেললাম। এই যে আমি সারাক্ষণ ভেতরের দিকে তাকিয়ে থাকি খাবার-দাবারের আশায়, অথচ ট্রেনে আস্ত একটা বগিই থাকা খানাপিনার জন্য!! আমার চোখে তখন পানি। খালি খাওয়ার জন্যই একটা রুম? যখন ইচ্ছা তখন খাওয়া?? কত সৌভাগ্যবান এই কামরার লোকেরা...
এক ভদ্রলোককে খেয়াল করলাম। কাঁচাপাকা চুল। উদাস দৃষ্টিতে ক্যান্টিনের চেয়ারে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতে ওভালটিন চায়ের কাপ। তাকাবেই তো বাইরে! খাবার ঘরেই বসে থাকলে আর টেনশন কী??
ওকি?? আমি যতোক্ষণে পেটিস, কাটলেট সাবড়ে দিলাম- ততোক্ষণে উনি কিনা বড়জোর দুটা চুমুক দিয়েছেন!! আমার আফসোস হলো- এম্মা... লোকটা খেতেই পারে না। কী দুর্ভাগ্য...
মাস কয়েক আগে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে একসময় বুফে কারে এলাম। এখন আর টাকা দেয়ার জন্য আব্বার মুখের দিকে তাকাতে হয় না। নিজেরই পকেট আছে। কিন্তু নিজের জন্য খরচ করতে আর ইচ্ছে হয় কই??
চা নিলাম একটা। চুমুক দিতে দিতে বাইরে দ্রুত চলে যাওয়া গাছপালা দেখছি। হঠাৎ চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে চমকে উঠলাম। কখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে!!
আমার মনে পড়লো ছোটবেলায় দেখা ঐ কাঁচাপাকা চুলের লোকটার কথা। ছোটবেলায় যাকে দেখে আফসোস করেছিলাম; এখন সেই লোকটার মতোই হয়ে বসে আছি!!
হায়রে বড়বেলা... তুমি এতো তাড়াতাড়ি দৌড়ে দৌড়ে লাফিয়ে আসো কেন বাপু?? দৌড়ে চলে গিয়ে আমার ছোটবেলাটা ফিরিয়ে দিতে পারো না?? ঠিক হুঁইসেল দিতে দিতে ছুটে চলা এই ট্রেনটার মতোন??
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন