স্কন্ধ হইতে ঝুলান ব্যাগ—বুঝি বা ভিক্ষার ঝুলি—কে একজন আসিয়া আমাকে সালাম করিল। আমার পথের ধারে ঘর হওয়ায় মুশকিলে পড়িয়াছি। দৈনিক কত ভিক্ষুক যে আসিয়া আমাকে বিরক্ত করে তাহার সংখ্যা নাই। এজন্য আমি ভিক্ষুকের উপর বড় চটা—আমি তাহাকে ভয় করি।
আমি তাড়াতাড়ি বৈঠকখানায় উঠিয়া বারান্দায় বসিলাম। ভিক্ষুকও আমার সম্মুখে আসিয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল। তাহার দিকে তাকাইলে কিম্বা তাহার সহিত কথা কহিলে পাছে ভিক্ষুক প্রশ্রয় পায়, এই জন্য আমি দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিলাম।
ভিক্ষুক তবু যায় না। তখন কামরার ভিতর ঢুকিয়া দ্বারে খিল আঁটিয়া বসিয়া রহিলাম।
কতক্ষণ পরে জানালার ফাঁক দিয়া দেখি, সে তখনও স্থিরভাবে হাত পাতিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
তাহাকে তাড়াই কি প্রকারে? আজ মুখ ফিরাইয়া থাকিয়া ঘরে খিল লাগাইয়া অনেক ভিক্ষুককে তাড়াইয়াছি। আমি মনে করিয়াছিলাম, এই নিয়ম সকল ক্ষেত্রেই কাজ করিবে। কিন্তু এখানে অকৃতকার্য হইলাম, করি কি!
আমি ত বড় বে-অকুফ। একটা পয়সা দিলেই যে ভিক্ষুক চলিয়া যায়, এ বুদ্ধিটা আমার মাথায় গজায় নাই। আমার চাকরকে ইশারা করিয়া ডাকিয়া তাহাকে কানে কানে ভিক্ষুককে একটা পয়সা দিতে বলিলাম। ভিক্ষুক পয়সা লইল না। আনি না, দুআনি না, সিকি না, আধুলি না, টাকাও না, উপায় কী?
তখন আমি নিজেই বাহিরে আসিয়া তাহাকে উপহাসচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমাকে সোনার মোহর দিতে হবে নাকি?
ভিক্ষুক অম্লান বদনে উত্তর করিল, সাহেব, আমি অর্থের ভিখারী নহি। ইনি ত তবে দুনিয়ার ফকির নহেন—নিশ্চয় দীনের ফকির—আমাকে ছলিতে আসিয়াছেন। ধন্য আমি যে আমার প্রতি ইহার কৃপাদৃষ্টি পড়িয়াছে।
ভক্তিভরে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কি চান?
তিনি উত্তর করিলেন, ভোট।
আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কে? তিনি উত্তর করিলেন, আমি ক্যান্ডিডেট।
তখন আমার মনে পড়িল যে আমি একজন ভোটার।
[একরামুদ্দীন (১৮৭২-১৯৪০) কথাসাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক।]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন