খাবারের নাম হালো-হালো

৮১৮ পঠিত ... ১৬:৪৭, নভেম্বর ১৩, ২০১৯

ফিলিপিন্সের ম্যানিলা শহরে একবার হালো-হালো অভিযানে বেরিয়েছিলাম। eআরকির পাঠকরা আজকে সেই অভিজ্ঞতাই শুনুন।

ছোট্ট টঙের দোকানে গিয়ে বললাম, ‘হালো-হালো দেন।’

দেন অবশ্য বললাম না, ছোট্ট কিশোরী দোকানদার, দাও বলেছি বলা যায়। হালো-হালোকে আমাদের ফালুদার ফিলিপিনো ভার্সন বলা যেতে পারে। সাগু-নুডুলসটা থাকে না কেবল।

এই হালো-হালো ফিলিপিন্সের বিভিন্ন চেইন ফুড স্টোরে খাওয়া হয়েছে। বেশ ভালোই লাগে। শরীরে পুষ্টির জন্য দুধ খাওয়া দরকার, এই অজুহাতে আমি প্রায়ই একবাটি হালো হালো নিয়ে বসে যাই। স্বাদ কেমন? সোজা উত্তর- আমাদের দেশের ভালো ফালুদার চেয়ে খারাপ, খারাপ ফালুদার চেয়ে ভালো।

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

কিন্তু চেইন ফুড স্টোরের হালো-হালো দিয়ে তো আসল স্বাদ বোঝা মুশকিল। আমাদের যেমন বার-বি-কিউ টু-নাইটে লম্বা চোঙের গ্লাসে আইসক্রিম দিয়ে অপূর্ব স্বাদের ফালুদা পরিবেশিত হয়। কিন্তু ঐ ফালুদার সাথে মাওয়া মেশানো ফালুদার আকাশ-পাতাল বেশকম। কাজেই আসল স্বাদের হালো-হালোর জন্য খুঁজে পেতে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন রাস্তার দোকানে হানা দিলাম।

আমার দু'গালে গোলাপি রঙের আভা নেই, তাতে কী, ফরেনার তো! কাজেই দোকানী মেয়েটা অনেক খদ্দেরের ব্যস্ততার মাঝেও আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলো।

বেশ বড় একটা ওয়ান টাইম গ্লাসে প্রথমে নেয়া হলো সিরাপে চুবানো কলার টুকরো। তার উপর বসানো হলো রকমারি কালারের জেলো। তার উপরে সওয়ার হলো আমের টুকরো। দেয়া হলো আমের মামাতো ভাই কাঁঠাল। হালকা কিছু নারকেলের কুঁচি। দুই রকমের সেদ্ধ করা বিন। বেগুনি রঙের উবে।

এই উবে জিনিসটা ফিলিপিন্সে খুবই জনপ্রিয়। আমার কাছেও স্বাদটা অসাধারণ লাগে। কিন্তু কী এই জিনিস, সেটা এখনও আলসেমি করে বের করা হয়নি। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করায় বললো, ‘উবে হচ্ছে গিয়ে উবে। প্লিজ আর জিজ্ঞেস কইরো না, উবে ব্যাখ্যা করার মতো ইংরেজী জ্ঞান আমার হয় নাই!’

উবের উপরে ব্রাউন সুগার। আমি হালকা আপত্তি তোলায় চিনির পরিমাণ কম দেয়া হলো।

নিচের লেয়ারের কাজ শেষ। এবার ঠাসা হলো মিহি করা বরফের কুঁচি। বেশ মোটা একপ্রস্থ। গ্লাস প্রায় মাথায় মাথায় ভরে গেছে। এরপরে ক্যান থেকে ঢালা হলো ইভাপোরেটেড মিল্ক। আমার ধারণা এটা কনডেন্সড মিল্ক। চা খায় না দেখে কনডেন্সড মিল্কের ব্যবহারটাও এরা হালো-হালোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। সবশেষে উপরে ছড়িয়ে দেয়া হলো সেদ্ধ করা ভুট্টা। আমার হালো-হালো প্রস্তুত। খা শালা এবার!!

হালো-হালো পেলেই গপাগপ মুখে পুরে ফেলার নিয়ম নেই। চাপ খেয়ে মাঝের বরফের কুঁচি এখন শক্ত হওয়া শুরু করেছে। মিনিট পাঁচেক পরে গলতে শুরু করবে। তখন একসাথে ঘুঁটা দিয়ে ঐ মণ্ড চামচে নেড়ে নেড়ে খাওয়ার নিয়ম। এইজন্যই এই দেশে হালো-হালো পরিবেশন করা হয় একেবারে মূল খাদ্য আসারও আগে। খাবার শেষ হতে হতে হালো-হালোও মুখে দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়!

আমি হালো-হালো সামনে নিয়ে পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পালা শুরু করলাম। নড়বড়ে একটা হাই-বেঞ্চ। ওখানেই রেখে দিলাম। তারপর নিয়ম-মাফিক ঘুঁটা দিয়ে মুখে দিলাম। মাশাল্লাহ! পিচ্চি বানিয়েছে বেশ! মুখে থেকে থেকেই লাগছে কলার স্বাদ, দাঁতের নিচে বাঁধছে জেলোর টুকরা, মাঝে মাঝে টের পাওয়া যাচ্ছে নরম বিনের দানা।

এই রে, হাই বেঞ্চ নড়ে কেন? ভূমিকম্প নাকি? তাকিয়ে দেখি, বছর দুয়েকের এক বিচ্ছু বাচ্চা বেঞ্চি নাড়াচ্ছে। বাচ্চার মা কটমট করে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবার খাওয়ার ঘোরে ডুবে গেলাম। প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে সবুজ রঙের জেলো, লাল রঙা আম, বাদামি কালারের বিন, সাদা আঁশের নারকেল। উবের কারণে পুরো পানীয়টার রঙ দাঁড়িয়েছে বেগুনি। এটাই হালো-হালোর আসল কালার।

আমার বুকটা হু-হু করে উঠলো। আর মাত্র অর্ধেকটা গ্লাস। চামচে পুরে হয়তো নারকেলটা কচকচ করে চাবাবো, ভুট্টা সেদ্ধ কোঁৎ করে গিলে ফেলবো। তারপর শেষ চুমুকটা দিয়ে গ্লাসটা ঢিল দিয়ে ফেলে চলে যাবো। পরের চামচ মুখে তুলতে গেলাম, হঠাৎ আমার গ্লাসটা যেন বিস্ফোরিত হলো! লাফিয়ে উঠে আমার চশমায় বাড়ি খেলো, তারপর মোবাইলের উপর অর্ধেক হালো-হালো ঢেলে বাকি অর্ধেকটা নিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলো।

কী হলো ব্যাপারটা? ঐ বাচ্চাটা দেখি ভেউ ভেউ করে কাঁদা শুরু করেছে। আমি কাহিনী টের পেলাম। বাচ্চার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে মা তাকে একটা আছাড় মেরেছে! দুনিয়ায় এতো জায়গা থাকতে সেই আছাড় মেরেছে কিনা আমার হাই বেঞ্চে! কপাল আমার!!

কোত্থেকে এক ছাগল এসে চেটে চেটে হালো-হালো খাচ্ছে। ছাগল কবে থেকে এই জিনিস খায়, আমি জানি না। যা দিনকাল, ছাগল নিয়ে বেশি কথা বলা সমীচিন না!

পাশে দিয়ে এক বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছেন। আমাকে স্বান্তনার ভঙ্গিতে উপরে আঙুল তুলে বললেন- গড ডিসাইডস!

আমি মাথা নাড়লাম। দেশে থাকলে এইটারই হয়তো বঙ্গদেশীয় অনুবাদ শুনতাম, ‘ছাগলের রিজিকে আছে, তুমি করবা কী?’
হতাশ আমি হাঁটা দিলাম। কী আছে আর দুনিয়ায়...

৮১৮ পঠিত ... ১৬:৪৭, নভেম্বর ১৩, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top