কিছু দিন আগে এই বঙ্গভঙ্গের ভোট-রঙ্গের সময় ব্যাঙের ছাতার মত হঠাৎ-গজাইয়া-উঠা কত না জনহিতৈষী ও সমাজসেবীদের দেখা পাইয়াছিলাম! তাঁহাদের দেখা পাইয়াছিলাম বাড়ির দেওয়ালের গায়ে,খবরের কাগজে, হ্যান্ডবিলে,সভা-সমিতিতে, পথে-ঝুলানো চাটাইয়ের গায়ে, এবং মিথ্যা বলিব না, ভোট ভিক্ষার আশায় অধমের বাড়ির দরজায়।
তাঁহাদের কথা আজও ভুলি নাই। বিশেষ করিয়া যখন জানি তাঁহারা অনেকেই শুধু কথা দিয়া তৈয়ারি, তখন তাঁহাদের কথা সহজে ভোলা সম্ভবপর নহে!তাঁহাদের মত আলাদা,পথ আলাদা কিন্তু আকাঙ্ক্ষা এক - আমাদের ভাল করিবার আকাঙ্ক্ষা, আমাদের মাথায় দুঃখ-তাপহরা ছাতা ধরার আকাঙ্ক্ষা। আমাদের উন্নতির নানরূপ লোভনীয় ফিরিস্তি চোখের সামনে ধরিয়া ভোট-প্রার্থীরা বলিলেন, এই সব চাও?
ভোট দাও।
আমরা বহু প্রকার পরোপকার ও সৎকার, মানে সৎকার্য করিতে পারি, যদি গদি পাই।
কিন্তু এই ভূলোকে কুলোকের অভাব নাই। লোকের নিন্দা করিতে তাহাদের জিব লকলক করিয়া উঠে। আর কাহারও প্রশংসা করিতে গেলে তাহাদের বুক ধকধক করে বোধ করি। তাহারা হাসিল এবং গান বাঁধিল-
বাণী এবং বিবৃতিতে
পয়সা তো আর হয় না দিতে
মুখেতে তাই ফোটে যেন খৈ!
বিশ্বাসীরা ভোলে কথায়
চড়ে গিয়ে গাছের মাথায়
শেষে দেখে নিচেতে নেই মৈ!
এবং গদ্য করিয়া বলিল, তোমরা সত্যই বলিতেছ। যদি গদি পাই অসাধ্য কিছুই নাই। অর্থাৎ তখন তোমরা সব করিতেই পার। এমন কি আমাদের কলা দেখাইতেও ছাড় না।
কিন্তু আমরা বলি, গদি পাইলেই কি লোককে ভূতে পায়! গদিয়ান লোক কি সত্যই অদ্ভুত! তাহারা কি ছলাকলা ও কাঁচ-কলা দেখাইতে অভ্যস্ত? গদি বুঝি মানুষকে এমনি করিয়াই অমানুষ করিয়া তোলে। গদির যদি এতই ক্ষমতা, অর্থাৎ মানুষ গদিতে চড়িলেই যদি অমানুষ হইয়া যায়, তবে তো অমানুষরা গদি-চাপা পড়িলে মানুষ হইতে পারে! তবে কি গদিতে না চড়িয়া গদি-চাপা পড়াই বাঞ্ছনীয়?-জটিল প্রশ্ন গুলি মাথার মধ্যে যেন জট পাকাইয়া যাইতেছে।
অতএব শেষ সূত্র ধরিয়াই জট খুলিতে বসি মানুষকে গদি-চাপা পড়িতে তো দেখিতেছি আমরা। গাড়ি চাপা পড়িয়া মানুষ মরিয়া বাঁচে, কিন্তু গদি চাপা পড়িয়া মানুষ বাঁচিয়া মরিতেছে। অভাবে অমানুষ মানুষ হওয়া দূরে থাকুক মানুষ ক্রমেই অমানুষ হইতেছে । আমার কথা বিশ্বাস হইতেছে না? বেশ তো কাছাকাছি রুসো-মেসো আছে। জিজ্ঞাসা করিও সঠিক জবাব দিবে। খবরদার পৃথিবীর উল্টো পিঠের শ্যামল খুড়োর কাছে ওসব কথা জিজ্ঞাসা করিও না যেন; এমন সব উল্টাও ফাঁকা কথা বলিয়া দিবে যে, সব তোমার গুলাইয়া যাইবে। লোকটা গোলা লোক, দেখিলেই ‘গুল’ দিয়া বুদ্ধি গোলমাল করিয়া দেয়।
হ্যাঁ, যা বলিতেছিলাম ।
গদি যদি মানষের উপরে বা নীচে থাকিয়াও মানুষকে অমানুষ করিতে পারে অর্থাৎ মানুষকে বিলাতি খানার ন্যায় স্যান্ডুইচড এবং দেশী ফলারের চিড়ে চ্যাপ্টায় পরিণত করিতে পারে, তবে মানিতেই হইবে, গদির ক্ষমতা মানুষের অপেক্ষাও বেশি।
মানুষ কি দিয়া তৈয়ারি ঠিক জানি না । তবে, গদি তো কি দিয়া তৈয়ারি জানা আছে! ছোবড়া, তুলা বা স্প্রিঙের গদি কে না দেখিয়াছে! শুধু দেখিয়াছি কেন, আমরা অনেকেই অনেক জায়গায় অনেক রকম গদিতে বসিয়াছি, শুইয়াছিও!
লিষ্টি দিব? কেন, বড়লোক বন্ধুর বাড়ির ড্রইংরুমে গিয়া চেস্টারফিল্ড সোফার স্প্রিঙের গদিতে বসিয়া তাহার বোনের নরম হাতের গরম চা পান করিয়াছি তো? (আর তুমিও পান কর নাই কি!) কিংবা বন্ধুর বিবাহে বরযাত্রী হইয়া তাহার সহযাত্রী হিসাবে সাজানো দামি মোটর গাড়ির মোলায়েম গদিতে কি বসি নাই? অথবা ট্রেনের থার্ডক্লাসের টিকিট কাটিয়া তাড়াতাড়ি ইন্টার ক্লাসের ছোবড়ার গদিতেও তো বসিয়াছি (মানে,অনেকেই বসিয়াছে); আবার ট্রামের ভিড়ে দাঁড়াইয়া থাকিলেও কখনো কখনো তাহার শক্ত রেক্সিন মোড়া গদিতে বসিবার সৌভাগ্যও হইয়াছে। আর শুইয়াছি ফুলশয্যার রাত্রে শ্বশুর মহাশয়ের দেওয়া তুলার গদিতে, তাঁহারি দেওয়া সালঙ্কারা কন্যাকে লইয়া। (অবশ্য, আরও অনেকেই।)
অর্থাৎ এই যে আমরা, এত রকম জায়গায় এত রকম গদিতে এতদিন শুইয়া বাসিয়া কাটাইলাম; কিন্তু কই আমাদের তো অতি বড় শত্রুও বলিতে পারিবে না ( অবশ্য, পিছনে কেহ বলে কি না জানি না) যে আমরা অমানুষ হইয়া গিয়াছি বা মনুষ্যত্ব হারাইয়াছি।
খুব আনন্দ না? ভাবিতেছ, ভারি শক্ত লোক তুমি, তাই গদি তোমাকে কাবু করিতে পারে নাই। তবে আসল কথাটাই বলি। মনুষ্যত্ব হারাইবার গদি ওগুলি নহে। অমানুষকর গদি ছোবড়া, তুলা বা স্প্রিংলেস,অথচ আরামদায়ক, মানাদায়ক, অর্থ-দায়ক এবং পরচক্ষু-কষ্ট- দায়ক? এক কথায়, এখানে গদি মানে ‘গদি’ নহে-পদোন্নতি বা পদবৃদ্ধি।
পদবৃদ্ধিই বটে! মুরুব্বির শ্রীপদে তৈলমর্দন করিতে করিতেই তো নিজের পদবৃদ্ধি অর্থাৎ ‘গদি’-প্রাপ্তি। আবার এই গদি-প্রাপ্তি বা পদবৃদ্ধি হইলেই অনেকে আচার-ব্যবহারে চতুষ্পদ জন্তবিশেষের সহিত তুলনীয় হয়। আরও দেখা যায়, এই পদবৃদ্ধি বা ‘আচ্ছা, তোমার নহে, রামের বা শ্যামের'- গোদা-পা ধরিতেও কুন্ঠিত হয় নাই, সে এখন ‘গদি’ পাইয়া নিজেই গোদ বা ‘পায়া-ভারী’ রোগে এমনি ভুগিতেছে যে, পরে রাম বা শ্যাম তাহার বাড়ি যাইলে, দোতলা হইতেই নামিয়া আসিতে পারে না।
অনেক ঔষধের দোকানে অনেকেই হয়তো বিজ্ঞাপন দেখিয়াছেন: দোকানের দরজার দুই পাশে দুইটি সাইনবোর্ডের একটিতে একটি রোগা লোকের ছবি ও তাহার লেখা- অমুক সালসা সেবনের পূর্বাবস্থা, এবং আর একটিতে একটি স্বাস্থ্যবান লোকের চেহারা আঁকা ও তলায় লেখা-সেই সালসা সেবনের পরের অবস্থা। সালসা সেবনে মানুষের ঐরূপ অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হয় কি না জানি না, তবে মানুষ গদি পাইবার পূর্বের ও পরের অবস্থা সত্যই লক্ষ্য করিবার।
বিশ্বাস না হয় লোকে গদি পাইবার পূর্বে ও পরে, কী কিরে তাহার একটি চমকপ্রদ ফিরিস্তি দিলেই সংশয় মিটিয়া যাইবে।
লোকে গদি পাইবার পূর্বেঃ
(১) বেশি কথা বলে, লোক জড়ো করিয়া।
(২) বেশি কাজ করে, লোক দেখাইয়া।
(৩) চাঁদা দিতে থাকে, না চাহিলেও।
(৪) পরের দুঃখে কাঁদে অযথা।
(৫) নিজের দুঃখে হাসে স্বেচ্ছায় ।
(৬) ঘন ঘন জুতা কেনে তলা ক্ষয় বলিয়া।
(৭) ছাতি কেনে তোমার আমার জন্য।
(৮) মণ-মণ তেল কেনে পরের চরকার জন্য।
(৯) সদর- দরজা খোলা রাখে সর্বদা।
(১০) অন্যের অন্যায় দেখিলে গরম হয়।
(১১) দেখা করিতে গেলেই চা-টা খাওয়ায়।
(১২) ‘যদি গদি পাই, কী করি’ জানাইতে থাকে।
এবং লোক গদি পাইবার পরে:
(১) শুধু বাণী ও বিবৃতি দিতে থাকে।
(২) নানারকম উদ্ভট পরিকল্পনা করে।
(৩) হরদম চাঁদা চাহিতে থাকে।
(৪) পরের দুঃখে হাসে বা কাশে।
(৫) নিজের দুঃখে উত্তেজিত হইয়া পড়ে।
(৬) এক জোড়া জুতা একাধিক বছরেও ছিঁড়িতে পারে না। বরং বাড়ি বা অফিসের মেঝের কার্পেটে ও গাড়িতে পাপোশে জুতার তলা শুধু পলিশ হইতে থাকে। কিংবা আরও ঘন ঘন জুতো কিনিতে হয়, পায়ের গোদ বাড়িয়া ক্রমেই ‘পায়া-ভারী’ হইতে থাকে বলিয়া।
(৭) হ্যাট বা ক্যাপ কেনে নিজের মাথার জন্য।
(৮) নিজের মাথায় ও পায়ে ঘন ঘন সাবান মাখে। কারণ তখন অন্যে তাহার তেলামাথা ও পা হরদম তৈলাক্ত করিতে থাকে।
(৯) শুধু সদর দরজা কেন, নবদ্বার তখন বন্ধ রাখে ও কড়া পাহারার বন্দোবস্ত করে।
(১০) কাহাকেও মুখ দেখাইতে চাহে না, এবং দেখাইলে ভেংচি কাটে বা চাঁটি মারিতে উদ্যত হয়।
(১১) ন্যায় -অন্যায় জ্ঞানশূন্য হইয়া কাদার মত নরম বা নরম মুড়ির মত মিয়াইয়া থাকে।
(১২) ‘যদি গদি ছাড়ি তবে সব রসাতলে যাইবে’ বলিয়া ভয় দেখাইতে থাকে। এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কেহ তাহার পা ধরিয়া গদি হইতে টানিয়া নামাইতে গেলে গদি আঁকড়াইয়া ধরিয়া পরিত্রাহি চিৎকার করিতে থাকে।
আরও গদি-মাহাত্ম্য প্রচার করিবার আমার ইচ্ছা ছিল। এবং ইচ্ছা ছিল আমি যদি গদি পাই, কি কি করি তাহার একটা বিস্তৃত ফিরিস্তি দিবার। কিন্তু সে সময় হঠাৎ বুধুয়া চাকরটা আমার ঘরে আসিয়াই সব গোলমাল করিয়া দিল। সে আসিয়াছে বলিয়া নয়, সে আমার হাতে যে লেফাফাখানি দিল তাহাই সব গুলাইয়া দিল। লেফাফাখানির ভিতরকার চিঠি আমার বুক দুলাইয়া দিল আনন্দে-মহানন্দে। সে চিঠি আমার কর্মস্থল হইতে আসিয়াছিল: you are promoted to...আর যেন পড়িতে পারিলাম না। মাসখানেকর ছুটিতে ছিলাম। সেই ফাঁকে আমার অফিসের মুরুব্বি পরলোকের পথে যাত্রা করিয়া তাহার পরিত্যক্ত গদি পাইবার পথ আমার জন্য সুগম করিয়া গিয়াছেন। তাই কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে ঐ চিঠি।
গদি যখন পাইয়াছি তখন ‘যদি গদি পাই’ কথাটি অনর্থক। তাই লিখিয়াছিলাম, তাহা মুচড়াইয়া জানালা দিয়া ফেলিয়া দিলাম রাস্তায়। পরে এক হাতে চিঠি ও অন্য হাতে প্রায় খেলা কাছা চাপিয়া ধরিয়া ছুটিলাম গৃহিণীর খোঁজে। গৃহিণীও আসিতেছিলেন গরম চায়ের কাপ হাতে করিয়া। মাঝপথে হঠাৎ দেখা হইতেই কোন রকম ব্রেক কষিলাম। গৃহিণীও কষিলেন। কাজেই কলিশন হইতে বাঁচিলাম বটে; তবে খানিকটা চা ছলকাইয়া পড়িল।
গৃহিণী যথারীতি মুখঝমটা দিলেন, বলি, ব্যাপারটা কি? অমন হস্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছিলে কেন? কাছা তো দেখছি মাটিতে লুটোচ্ছে!
অপ্রস্তত হইয়া বাঁপা দিয়া কাছটিকে কয়েকটা ঝাপটা মারিয়াও চিঠিসুদ্ধ হাতে ধরিতে না পারিয়া বলিলাম, যাক গে কাছা। তোমার কাছে যাচ্ছিলাম একটা সুখবর দিতে।
গৃহিণী মুখে হাসি। কী সুখবর?
হাসিয়া বলিলাম, আমার উপরওয়ালার গদি এখন আমার। বল, তোমার কী চাই?
গৃহিণী একগাল হাসিয়া বলিলেন, বেশ একখানা ‘মনে রেখো’ শাড়ি দিয়ো। নতুন উঠেছে।
শুধু ‘মনে রেখো’ শাড়ি কেন, মনের আনন্দে মনে করিয়া করিয়া আরও অনেক জিনিস তাঁহাকে আনিয়া দিয়াছি।
গদি পাইয়াছি যে!
কিন্তু সম্পাদক মহাশয়, কিছু মনে করিবেন না, আমার এই অসম্পূর্ণ বাজে লেখাটি আপনি কি মনে করিয়া রাস্তা হইতে কুড়াইয়া আনিয়া আপনার সুপ্রচলিত পত্রিকায় পত্রস্থ করিলেন? নিশ্চয়ই আমাকে অপ্রস্তত করিবার জন্য ! আমি গদি পাইয়াছি, অমনই লোকের চক্ষু করকর করিয়া উঠিল! সাধ করিয়া কি বলিয়াছি, গদি চক্ষু-পীড়াদায়ক!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন