২২১বি, বেকার স্ট্রিটের দোতলার আবছা আলোর ঘরটায় মিনিট বিশেক ধরে বসে আছেন মিসেস এলি আর্থারটন। কিছুক্ষণ আগে মিসেস হাডসন তাকে এক কাপ চা আর কিছু বিস্কিট দিয়ে গেছেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি দেখলেন, সামনের টেবিলে মিস্টার শার্লক হোমসের ল্যাপটপ রাখা। ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটি ওয়েবসাইট খোলা আছে, সেটাই তাকিয়ে দেখছিলেন তিনি। ভাবলেন, নিশ্চয়ই কোনো ক্রাইম বেজড ওয়েবসাইট হবে। নামটা ভালো করে খেয়াল করলেন, 'eআরকি ডটকম'! নামটা দেখতেই তার মুখটা আরও নীরস হয়ে গেল।
ঠিক এমন সময় নিজের কোটটির ডান হাতায় হাত ঢুকাতে ঢুকাতে প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন শার্লক হোমস। মুখে তার সেই বিখ্যাত চুরুট। ঢুকেই বললেন, 'দুঃখিত দেরির জন্য। আপনি কি eআরকির সঙ্গে পরিচিত? দেখছিলেন মনে হচ্ছে... দারুণ একটা সাইট!'
মিস আর্থারটন বললেন, ‘জি না, ক্রাইম সম্পর্কে আমার আগ্রহ নেই। খুব বেশি সিরিয়াস ব্যাপার এগুলো, ওগুলো আপনাদের কাজ।'
শার্লক হোমস একটু বিব্রত হয়ে বললেন, ‘ইয়ে, ওটা ক্রাইম রিলেটেড কিছু না, হিউমার স্যাটায়ার এসব আর কি... ইয়ে, আচ্ছা যাই হোক, আপনার সমস্যার কথা বলুন।' বলতে বলতে শার্লক তার সোফায় গিয়ে বসলেন।
মিসেস আর্থারটন কোনো ভূমিকা না দিয়েই বলতে শুরু করলেন, গত মাসের বিশ তারিখ আমাদের বিয়ের অ্যানিভার্সারি ছিল। রিজেন্ট স্ট্রিটে আমাদের বাড়িতে থাকি শুধু আমি, আমার স্বামী ডেভ, আর আমার এক ছেলে রড।...’
শার্লক থামালেন আর্থারটনকে, ‘এক মিনিট, ছেলের নাম কী বললেন? রড?
‘জি, রড!’
‘দারুণ তো, আচ্ছা, আপনার ছেলের স্ত্রীর কথাটা ভেবেছেন একবারও? অন্য মেয়েরা যাই পাক, সে পাবে একটা রড, হাহাহা!’
মিস আর্থারটন গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলেন। শার্লক আবারও বিব্রত হয়ে বললেন, ‘ও, সরি, ইদানিং eআরকি ডটকম একটু বেশি পড়া হচ্ছে আর কি, প্রভাবটা কাটাতে পারছি না, ইয়ে, ক্যারি অন...’
মিস আর্থারটন ক্যারি অন করলেন, 'রড গেছে তার বন্ধুর বাড়িতে এক পার্টিতে। সন্ধ্যায় ডেভ একগোছা ফুল হাতে বাড়িতে ফিরল। আমি হেসে ফুলগুলো হাতে নিচ্ছি, ও তখন আমাকে বলে, ‘শোনো, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। কিন্তু এখানে না, ছাদে গিয়ে দেখবে। চলো আমার সঙ্গে।’ এটা আসলে ওর অভ্যাস। প্রতি অ্যানিভার্সারিতেই ও আমার জন্য কোনো না কোনো সারপ্রাইজ গিফট নিয়ে আসে। যাই হোক, ও তার দু’হাত দিয়ে আমার দু’চোখ বন্ধ করে আমাকে ছাদে নিয়ে গেল। তারপর আমাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে বলল, ‘শোনো, আমি সারপ্রাইজটা বের করছি, চোখ খুলবে না কিন্তু। আচ্ছা?’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা।’ তারপর ও তার হাত সরিয়ে নিল আমার চোখের ওপর থেকে। আমি চোখ বন্ধ করেই থাকলাম। সারপ্রাইজটা কী, সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে একটু আমোদিত হচ্ছিলাম। ও এর আগে কোনোবার আংটি, কোনোবার কোথাও ঘুরতে যাবার প্লেনের টিকিট, কোনোবার নতুন গাড়ির চাবি, আরও কত কী যে দিয়েছে!
এভাবে প্রায় মিনিট খানেক পার হয়ে গেল। আমি অপেক্ষা করছি তো করছিই, আর ভাবছি কি এমন সারপ্রাইজ, যা বের করতে এত সময় লাগছে! আমি একটু বিরক্তির স্বরেই বললাম, ‘ডেভ, কী হল, এতক্ষণ লাগে নাকি?’ কিন্তু কোনো উত্তর নেই। কয়েক সেকেন্ড গেল। আমি আবার বললাম, ‘ডেভ, কোথায় গেলে তুমি? কথা বলছ না কেন?’ কোনো উত্তর নেই। এভাবে চলে গেল আরও কিছুক্ষণ। আমি অধৈর্য্য হয়ে চোখ খুলে ঘুরে দাঁড়ালাম। ডেভ নেই কোথাও। ভাবলাম ও বোধ হয় নিচে গেছে সারপ্রাইজটা আনতে। আমি নিচে নেমে দেখি বাড়ির কোনো ঘরেই নেই। বাথরুমেও না। বাইরে বের হলাম, গ্যারেজে গাড়ি যেভাবে পার্ক করা ছিল, ওভাবেই আছে। তার ফোনও বাড়িতে নেই, কিন্তু বন্ধ। অফিস থেকে ফিরেই সে ওয়ালেটটা ওয়ারড্রোবের উপর রেখেছিল, সেটাও ওভাবেই আছে। আমি সব পরিচিত জায়গায় ফোন করলাম, ও কোথাও যায়নি। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি অস্থির হয়ে ছটফট করছিলাম বাসায়। রড বাড়িতে ফিরে আমাকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল। আমাদের গেটে আর বাড়ির চারিদিকেই সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। ডেভ বাড়িতে আসার সময় থেকে শুরু করে আসার আগ পর্যন্ত টানা দুই ঘণ্টার ভিডিও চেক করল রড, কিন্তু না, ডেভ বাড়ি থেকে বেরও হয়নি। আরও ঘণ্টাখানেক পরে আমার মা এলো, ভাই এলো। থানায় গিয়ে জিডি করলাম। তারপর এই এক মাস কেটে গেছে, এখনও কেউ ওর কোনো খোঁজ বের করতে পারল না। শেষে আমার অফিসের এক কলিগ আপনার কথা জানাল। আপনি প্লিজ আমার স্বামীকে খুঁজে বার করুন। আপনার যত টাকা চাই, আমি দেব।'
শার্লক হোমস স্বভাবসুলভ চোখ বন্ধ করে দু’হাত প্রার্থনার মতো এক করে আর দুই তর্জনী একটা আরেকটার সঙ্গে বাজাতে বাজাতে সব শুনছিলেন, আর ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করছিলেন। মিসেস আর্থারটনের কথা শেষ হওয়ার পর চোখ খুলে বললেন, 'উনার কোনো কিছু ব্যাপারে আসক্তি ছিল?'
মিসেস আর্থারটন বললেন, 'আসক্তি কিনা জানি না। কিন্তু ক্রিকেট খেলা দেখার বড় নেশা ছিল। যেখানেই যেই ক্রিকেট ম্যাচ হতো, টিকিট কিনে স্টেডিয়ামে গিয়েই খেলা দেখতেন...'
'ইন্টারেস্টিং।' বলতে বলতে দাঁড়িয়ে পড়লেন শার্লক-
'আপনার কেসটা হাতে নিতে খুব ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু নিখোঁজ ব্যক্তি খুঁজে বের করতে অনেক সময়... মাসের পর মাস লেগে যায়, এদিকে আমারও খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। আপনার কেসটা নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে খোঁজাখুঁজির এই কাজটা আমার চেয়েও ভালো পারে, এমন একজনের খোঁজ আপনাকে আমি দিচ্ছি...'।
চুরুটে একটা টান দিতে দিতে শার্লক তার প্যান্টের সামনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওয়ালেটটা বের করলেন। সেই ওয়ালেট থেকে একটা কালো রঙের কার্ড বের করে মিসেস আর্থারটনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, 'এই যে ধরুন, উনার কার্ড। উনি বাংলাদেশে চলমান ক্রিকেট লিগ বিপিএলের ক্যামেরাম্যান। খোঁজাখুঁজিতে ওনার চেয়ে ভালো আর কাউকে পাবেন না। এত এত মানুষের ভিড়ে স্টেডিয়ামের কোথায় কোন সুন্দরী মেয়ে বসে আছে, এইটা যে ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখেই খুঁজে বের করতে পারে, তার জন্য একজন লোককে খুঁজে বের করা কোনো ব্যাপারই না! আপনি বরং উনার সঙ্গেই যোগাযোগ করুন।'
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন