v
কী করে শরীর গরম রাখা যায়, সেই এক সমস্যা। গ্রীষ্মকালের কথা নয়, শীতের দিনের কথাই আমি বলছি।
যখন শীতকাল জাঁকিয়ে আসে, সারা রাত হিম পড়ে, সব সময়েই হাড়-কনকনানো বেধড়ক ঠাণ্ডা- কী করে শরীর গরম রাখা যায় এ-সমস্যা সেই সময়েরই। এবং এই বিষয়ে, বিষয়টিতেও অনেকের চেয়েই আমি যে একটু বেশিই জানি, আমার স্বভাব-সুলভ বিনয় সত্ত্বেও সেকথা জানাতে বাধ্য হচ্ছি।
অবশ্যি ইচ্ছে করলে আমি একেবারে গোড়া থেকে, রক্ত থেকেই শুরু করতে পারতাম। না, রক্তপাত নয়, রক্তারক্তির কান্ড নয় কোনো, কেবল আমাদের রক্তের ভেতরকার লোহিত কণিকারা কোনগুলি, তাদের সংখ্যা কত, স্বভাবত কী তারা এবং কার্যকারিতাই বা কোথায় - শরীর গরম রাখার পক্ষে এদের কোনও উপযোগিতা আছে কি না- সেইসব নিয়েও শুরু করা যায়। তা ছাড়া, মিষ্টি জিনিসই বা আমাদের কী কাজে লাগে, চিনির সঙ্গেই বা দৈহিক উত্তাপের কী যোগাযোগ, তা নিয়েও আরম্ভ করা যেতে পারে।
কিন্তু তা আমি করব না। কারণ, তাহলে নিজেকে আর আমি থামাতে পারব না।
প্রথমেই আমাদের কতগুলি বদ্ধমূল কুসংস্কার রয়েছে, সেগুলি দূর করে ফেলা উচিৎ। আমাদের ধারণা যে, ঘরের দরজা-জানলা চেপে বন্ধ করে রাখলেই ঠান্ডার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। মোটেই তা নয়। নির্মল বাতাস সেবন করতে না পারলে গরম থেকেই বা কী লাভ ? খুব খুঁটিয়ে ভেবে দেখলে, আসলে তা গরম থাকাই নয়। চিরকালের মতই ঠাণ্ডা হবার পথ পরিষ্কার করাই বলতে গেলে। ধরো, চোদ্দ বাই চোদ্দ ফুট একটা ঘর, তার সব দরজা-জানলা যদি চেপে বন্ধ করে দাও একটুও ফুটো বা ফাঁক না রেখে, তার ফল কী হবে ? খানিক বাদেই সে-ঘরের বাতাসে থাকবে খালি নাইট্রোজেন- কিংবা হাইড্রোজেনও থাকতে পারে- সঠিক আমি বলতে পারব না। তবে অক্সিজেন যে একেবারেই নয়, সে কথা জোর গলাতেই বলতে পারি।
অতএব সত্যি সত্যিই যদি গরম থাকতে চাও, স্বাস্থ্য সম্মত উপায়দের লঙ্ঘন না করেই, তাহলে দরজা জানলা সব অবাধে মুক্ত করো। আগাপাশতলা ফাঁক করে দাও ওদের। এধার-ওধার দু-ধারেই। ঢুকুক ঠাণ্ডা হিম, ছুটুক হিমেল হাওয়া- একধার দিয়ে ঢুকে আরেক ধার দিয়ে বেরিয়ে যাবে; ভয় কীসের?
শীতকালের দিনে গরম পোশাক পরাও আরেক হাস্যকর বদভ্যাস। বিচক্ষণ ব্যক্তিমাত্রই জানেন, গরম থাকবার জন্যে গায়ে গুচ্ছের কাপড় জড়ানো কোনও কাজের কথাই নয়। এতে কি সত্যি সত্যিই আমরা গরম থাকি ? উঁহু ! ও তো গরম থাকার ছলনা মাত্র। আসল উষ্ণতা আসে রক্তের চলাচল থেকে, সেইদিকেই আমাদের লক্ষ্য দেওয়া দরকার।
নিজের দেহে উষ্ণতা সঞ্চার করতে হলে নিজের দেহের অভ্যন্তর থেকেই তা লাভ করাই যথার্থ লাভ। সেইজন্যেই রক্তের চালচলনকে দ্রুতগামী করা চাই আর তার জন্য দরকার হচ্ছে ব্যায়ামের।
কী কী ব্যায়াম করা যেতে পারে তার একটা ফিরিস্তি আমি এখানে দিচ্ছি-
ক) শীতকালের দিনে, খুব সকালে উঠেই- এই ভোর পাঁচটা নাগাদ- সর্ব প্রথমেই ভর্তি এক গেলাস ঠাণ্ডা জল। তার মধ্যে বরফের কুচি ফেলে খেতে পারলে আরও ভালো।
খ) তারপর লম্বা এক হাঁটন দাও - পাক্কা দশ মাইলের। একটা হাফ প্যান্ট আর আধখানা ঢিলে শার্ট গায়ে দিয়ে। দশ মাইলের আগে থামবার কোনও কথা নেই, তবে ইচ্ছে করলে মাঝে মাঝে ছুট লাগাতেও পারো।
গ) তারপর ফিরেই এক গ্লাস ঠাণ্ডা ঘোলের শরবত - বরফ তার মধ্যে রয়েইছে। এই হলো গিয়ে ব্রেকফাস্ট। তারপর খোলা মাঠে গিয়ে, খোলা গায়ে, শিশির-বিস্তীর্ণ ঘেসো জমির উপর আধঘন্টাটাক, আর কিছু না, খালি ডিগবাজি খাও। অল্পক্ষণেই দেখবে সর্বশরীর যথেষ্ট পরিমাণে উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
ঘ) তারপরের কাজ হচ্ছে কুস্তির আখড়ায় গিয়ে ঢুঁ মারা। একজন পেশাদার কুস্তীগিরের চটকানো, ঘুঁষি, র্যাঁদা, তার দ্বারা দলিত মলিত হওয়া কী যে আরামদায়ক! কুস্তির মত উপাদেয় ব্যায়ামই আর নেই। কুস্তির ধাক্কায় যদি একেবারেই ঠাণ্ডা মেরে না যাও, তাহলে কুস্তি সেরে তুমি নবজীবন লাভ করেছ বলেই তোমার সন্দেহ হবে।
গরম থাকার আরো অনেক চমৎকার চমৎকার উপায় তোমাদের আমি বাতলাতে পারি, কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই, স্বাস্থ্যমূলক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের তাবৎ বই রয়েছে আমার পাশের ঘরে। সেখানে যাবার একটু অসুবিধে আছে। ওই ঘরের জানলাগুলোর তিনটে খড়খড়ি ভাঙা। তার ভেতর দিয়ে হুড়মুড় করে যা হাড়-জমানো বাতাস -বাব্বা ! ভাবতেই আমি ভিরমি খাচ্ছি।
আর যা সর্দি লেগেছে ভাই, কী বলব ! হাঁচতে হাঁচতেই আমার প্রাণটা গেলো। আমার হাঁচির আবার অদ্ভুত ধরণ; আরম্ভ হলে আর থামতেই চায় না, চলছে তো চলছেই, একটানা ধাপা-মেলের মতন একনাগাড়ে।
আমি নিজে ঠান্ডায় কাতর বলে তো তোমাদের উপদেশ দিতে বাধা নেই ! পৃথিবীর উপকার তো করতেই হয় ! প্রাণ দিয়েই করতে হয়। তবে কিনা, আপনি বাঁচলে তারপরে পৃথিবী। আমায় খুব পিড়াপীড়ি করলেও, ওরে বাবা, ভাঙা-খড়খড়িওলা পাশের ঘরে কিছুতেই আমি পা বাড়াব না।
ব্যায়ামের কথা বলছ? ব্যায়াম করব কি, এপাশ ওপাশ করাই আমার পক্ষে অস্থির কান্ড। ব্যায়াম আর ব্যারাম আমার কাছে এখন অভিন্ন বানান।
গায়ে শোয়েটার এঁটে, বিছানায় শুয়ে, কোটরে কোটরে, বালাপোশ জড়িয়ে, তার উপরে আলোয়ান মুড়ে - সবার উপরে লেপের প্রলেপ তো রয়েছেই - শীতে কাঁপতে কাঁপতে তোমাদের জন্যে এই প্রবন্ধটা লিখছি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন