'এই যে ব্রাদার, গো*ডা একটু সরাবেন প্লিজ!'
পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া ব্যক্তির কথা শুনে কাদের সাহেব ধাক্কার মতো খেলেন। এ কেমন ভাষা! লোকটা জানে না সে কে? ডাক দিয়ে ধমক দিয়ে বলবে নাকি? আবার নিজেকে সংযত করলেন। বেশি কথা বলা ঠিক হবে না, দেশের পরিস্থিতি খারাপ। তিনি বরং একটু সামনে এগিয়ে দাঁড়ালেন। এইবার খেঁকিয়ে উঠলো সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক, 'কিরে ভাই, গায়ের উপরে উইঠা বইবেন। চোখ কী বাসায় থুইয়া আইছেন?'
এবারো কাদের সাহেব ভীষণ অপমানিতবোধ করলেন। কিন্তু কিছু বলার সাহস পেলেন না। তার সমস্ত রাগ গিয়ে ভর করলো স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের উপর। এই কুলাঙ্গারদের জন্যই আজ তার এই দশা! তাদের দাবি মেনেই রুল জারি করা হয়েছে জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত একদিন গণপরিবহনে চড়তে হবে। ওবায়দুল কাদেরের ভাগ্যে পড়েছে মঙ্গলবার। তাই মঙ্গলবার আসলেই তাঁর গা কেঁপে জ্বর আসে, পেটে মোচড় দেয়, ঘনঘন টয়লেট পায়। আজ সকালেও মন্ত্রণালয়ে ফোন দিয়ে বলেছেন, আমার ভীষণ পেট ব্যথা। আমি আজ আসতে পারবো না। আসলেও পাবলিক বাসে পারবো না।
ওপাশ থেকে উত্তর দেয়া হয়েছে, স্যার শুনেছি মোড়ে মোড়ে স্কুল ড্রেস পরে ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাস চেক করবে...বাকিটা স্যার আপনার বিবেচনা!
-পেট ব্যথা করছিলো। এইমাত্র মনে হয় কমে গেছে। আসবো আমি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাদের সাহেব পেছনে তাকিয়ে দেখলেন একটা সিট খালি হয়েছে। তাঁর চোখ চকচক করে উঠলো। দ্রুত যেতে হবে, লাইফটা একটা রেস। সামনে দাঁড়ানো লোকটা এখনো টের পায়নি। তিনি দুই তিনজনে ঠেলে যেই সিটের কাছাকাছি গেলেন তার আগেই একটা ছোকরা এসে সিটটায় বসে গেলো। ছেলেটাকে চেনেন তিনি, নাম সালমান মুক্তাদারী। দেখেই রাগ উঠলো। এই ছেলেকে স্বপ্নে দেখলেও তার রাগ উঠে। চোখ মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করলে, 'তুমি কী জনপ্রতিনিধি?'
-আমি ইউটিউব প্রতিনিধি। প্রাঙ্ক ভিডিও বানাই। আই হ্যাভ লটস অব ফ্যান।
-বাচ্চারা শুধু জনপ্রতিনিধিদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যেতে বলেছে তোমাদের না। তুমি উঠছো কেন?
-ইউ নো স্যার, আমার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার কতো? আমারো একটা ভ্যালু আছে। শিশুরা লাইকজ মি। তাই আমিও আপনাদের মতো উইকে একবার পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠি আর লাইভ করি। (লাইভে গিয়ে) হ্যালো গাইজ!
-বাবা সালমান, ভালোয় ভালোয় উঠে যাও। নইলে সামনের চেকপোস্টে স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চা উঠবে। ধরা পড়লে কী করবে মনে আছে তো?
উঠতে উঠতে সালমান বলে, 'যাচ্ছি, তবে যাচ্ছি না। তবে স্যার আমার মনে হয় বাচ্চারা মোড়ে মোড়ে থাকবে না। আমার ধারণা ওরা আপনার সাথে প্র্যাঙ্ক করেছে! এই কিডসরা খুব দুষ্টু!'
কাদের সাহেব সালমানের কথায় পাত্তা না দিয়ে সিটে বসেই দেখলেন পাশে হাফপ্যান্ট পরে একটা স্কুলের বাচ্চা উদাস হয়ে বসে আছে। তিনি যেন বাচ্চাটাকে দেখেননি এমন ভাব করে আবার বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে সালমানকে খুঁজতে লাগলেন। সালমান দূর থেকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছে, 'প্র্যাঙ্ক স্যার! প্র্যাঙ্ক! ওই যে ক্যামেরা।'
২.
ঘন্টাখানেক হয়েছে গাড়ি নড়ে না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অবস্থা কাহিল। এর আগেও কয়েকবার বাসে উঠেছেন। তবে সেটা তো ছিল ফটোশ্যুটের সেটআপ। পাশের লোকটার গা থেকে ভকভক করে ঘামের গন্ধ আসছে। থানায় ফোন দিয়ে লোকটাকে ধরে নিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এমন কিছু করা যাবে না। একজন মন্ত্রী আছে বাসে, অথচ কারো কোনো বিকার নেই। পাশে দাঁড়ানো লোকটা তাকে বললো, 'বুঝলেন ভাই ভিআইপি যাইতেছে। হারাম*দাগুলা যাওনের সময় একবার লাগায়, আহনের সময় একবার লাগায়...জ্যাম!'
কাদের সাহেব কিছু বললেন না, কেবল মাথা নাড়লেন। তবে লোকটা থামার নয়। সে বলেই যাচ্ছে, 'বুঝলেন মিয়া ভাই, হালার পুতগুলারে যদি একবার হাতের কাছে পাইতাম ছাল-বাকল কিচ্ছু রাখতাম না। কী বলেন। রাখা ঠিক?'
-জ্বি! জ্বি ঠিক না।
-আপনে যাইবেন কই?
-গুলিস্তান।
-মিয়া ভাইরে পরিচিত মনে হইতেছে। কই জানি দেখছি, কই জানি দেখছি। ভাইজান মনে হয় এই বাসে নিয়মিত যাতায়াত করেন। এর লিগা চিনা লাগতেছে। তা ভাইজান কোন দুকানে কাম করেন?
কাদের সাহেব কিছু বলেন না, একটু সরে দাঁড়ালেন। সেখানে হ্যাংলা পাতলা, খোচা খোচা সাদা দাড়িযুক্ত এক ভদ্রলোক পাশে দাঁড়ানো আরেক যাত্রীকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। তিনি তাদের আলোচনায় মন দিলেন কী বলে শোনার জন্য। কিছুই বুঝতে পারলেন না। কালো মতন ভদ্রলোককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হইছে ভাই?'
লোকটা খুব উত্তেজিত হয়ে বললো, আরে ভাই বললাম আমার তিনটা মিটিং আছে। বললাম আমি একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি একটু বামে চাইপা দাঁড়ান। ইটস মাই রিকোয়েস্ট। লোকটা সরলো না। কেমন বেয়াদব দেখছেন!
-আমি মন্ত্রী সেটাই শুনলো না। তা তুমি এইখানে কেনো?
-বাচ্চারা আমাকে বলেছে প্রতিদিন বাসে উঠে জনপ্রতিনিধিদের মোটিভেশনাল স্পিচ দিতে। তারা নাকি পাবলিক বাসে যাতায়াত করতে করতে জীবনের উপর আশা হারিয়ে ফেলেছে, ডিপ্রেসনে ভুগছে। এই আমাকে দেখেন স্যার, আমি একদিন কী করতাম? এই সেদিনের কথা শোনেন, বললাম আমি ফেসবুক সেলিব্রেটি আমার গাড়ি যেতে দাও। দিলো না? এতে কী আমি হেরে গেছি? আমার সব শেষ হয়ে গেছে? নাহ! আমি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এখন আমার স্যালারি কতো জানেন, সিক্স ডিজিট! ইউ নো এইটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে?
কাদের সাহেব কথা শুনলেন না। তার মন খারাপ হচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি খুব বাজে। প্রধানমন্ত্রীকে বলে স্কুল-কলেজ আজীবনের জন্য বন্ধ করে দিতে পারলে ভালো হতো। তার আগে শাজাহান ভাইকে বলে বাস বন্ধ করে দিতে হবে। তিনি চুপচাপ পেছনের চলে এলেন একেবারে। সেখানে একটা সিট খালি আছে।
৩.
এতক্ষণে কাদের সাহেবের মন কিছুটা ভালো। বাসে একটা সিট পেলে যে এতো ভালো লাগে এটা তিনি আগে বুঝেননি। তার উপর পাশের সিটে বসেছেন মন্ত্রী শাজাহান খান। লোকটা সারাদিন হাসে। তার নাম হওয়া উচিত ছিলো হাসাজাহান খান। কাদের সাহেব শাহজাহান খানের পেটে গুতো দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী শাজাহান ভাই, হাসতাছেন ক্যান?'
-হাসতেছি অর্থমন্ত্রী মুহিত ভাইয়ের কথা চিন্তা কইরা।
-উনি কী করছে?
-হা হা হা হা!
-আরে ভাই হাসেন কেনো? মুহিত ভাই কী করছে?
-হা হাহাহা আর বইলেন না। বেচারা।
-কী করছে উনি?
-আমরা না হয় উত্তরা থেকে গুলিস্তান যাইতেছি। উনিতো যাবে যাত্রাবাড়ি থেকে মিরপুর। বুঝেন, মিরপুর। হা হা হা হা হা।
দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়লেন। বাসে একটা আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হলেও এক ভদ্রলোক ঘুম ভেঙ্গে বিশাল সাইজের একটা ধমক দিয়ে বসলেন, 'ওই মিয়া আস্তে হাসেন। এইটা আপনার প্রোটোকলের গাড়ি পাইছেন নি? পাবলিক বাস। বাসায় গিয়া হাইসেন।'
শাজাহান সাহেব বিশাল অবাক হয়ে বললেন, 'সামান্য হেসেছি এতেই এতো রাগ। ভারতে প্রতিদিন বাসে সবাই কতো জোরে জোরে হাসে জানেন? সেখানে হাসি নিয়ে এতো আলোচনা হয় না।'
কথা শেষ করার আগে বাসের বাকি সবাই হইচই করে উঠলো। কিন্তু শাজাহান খান চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি আবার বললেন, একটু না হয় হাসি। তাতেই এতো সমস্যা। তাহলে হাসবোই না।
পাশে বসা ওবায়দুল কাদেরও একমত পোষণ করলেন, 'জ্বি, আমরা হাসবো না।'
তখনই ওবায়দুল কাদেরের ফোন বেজে উঠলো। মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ফোন দিয়েছেন।
-হ্যালো তোফায়েল ভাই।
ওপাশ থেকে তোফায়েল আহমেদ খুব তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করলেন, 'কাদের, তোমার কাছে কী পাঠাও এর প্রোমো কোড আছে? আমারে ওরা কোনো প্রোমো দেয় না!'
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন