এমন দিনে তাঁকে নিয়ে বলা যায়

১৩৫২ পঠিত ... ০৫:৫০, মে ০৮, ২০১৮

আজকের লেখাটা, বড় ইচ্ছে করছে যে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখি। মনে সাধ, কিন্তু বুকে ভয়, ধর্ম নিয়ে যেমন কিছু লিখতে ভয় লাগে, এই বুঝি ধর্মটা যাদের পেশা, তারা হা রে রে রে করে এগিয়ে আসে! রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কিছু লেখার কথা ভাবলে মনে জাগে সদা ভয়, এই বুঝি রবীন্দ্রনাথটাই যাদের পেশা, যারা কিনা রবীন্দ্রজীবী, তারা ধমকে দেন, 'চুপ বেটা মূর্খ! গুরুদেবের নাম মুখে নিয়েচিস, চান করে পূতপবিত্র হয়ে এয়েচিস তো আগে!'

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

(পেশা বিষয়ে কমলাকান্তের একটা উক্তি মনে পড়ল | কমলাকান্তকে আদালতে জেরা করা হচ্ছে--তোমার পেশা কী? কমলাকান্ত জবাব দিচ্ছে, আমি উকিল নাকি বেশ্যা যে আমার পেশা থাকবে?)

আমার কিন্তু এই জায়গাতেই আপত্তি, রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় কবি ছিলেন, অনেক বড় সাহিত্যিক ছিলেন, অনেক বড় মানুষ ছিলেন, এত বড় যে, তাঁর উচ্চতা ঠিক সরে তিন হাত ছিল বলে মনে হয় না, মনে হয় তাঁর নিজের হাতের মাপেই তিনি ছিলেন সাড়ে ছয় হাত, তবু তাঁকে মানুষই বলে মনে হয়, রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, কখনো মনে হয় না যে তিনি দেবতা ছিলেন।

তো তিনি যদি মানুষই হবেন, তবে তাঁকে নিয়ে লেখা যাবে না কেন! নিশ্চয়ই যাবে! কে বলছে যাবে না?

ফুল থেকে ভ্রমর নেয় মধু আর মাকড়সা নাকি নেয় বিষ। আমরা এই কলামে বরং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সেন্স অব হিউমার ছিল কিনা সেটা খুঁজবো। গবেষণা করবো। গবেষণা মানে গরু খোঁজা, গরু খোঁজা কঠিন কাজ। (আমাদের হাসির গল্পে আছে, এক লোক তার বউকে এসে বলছে, জল দে মা ঘটি খাই। 'মিনসে বউকে মা ডাকে, ঘটনা কী ?' 'গরু হারালে এমনই হয় মা!')

 

২.

রবীন্দ্রনাথের নাকি সেন্স অব হিউমার বা কৌতুকবোধ ছিল না। এটা নাকি এক অধ্যাপক-গবেষক গবেষণা করে অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে মৈত্রেয়ী দেবী হাসতেন, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ বইয়ে উদ্ধৃত রবিবাবুর প্রত্যেকটা কথায় কে না হেসে উঠে পারবে, তা দেখে তিনি বলেছিলেন, 'বারবার বলছি আমার কথায় হেসো না তো। আমি তো ঠাট্টা করতে পারিনে। আমার মধ্যে হিউমারবোধ নেই তা প্রমাণ হয়ে গেছে, জানো না? একজন প্রফেসর প্রমাণ করে দিয়েছেন লিরিক কবিদের হিউমারের বোধ থাকে না, অকাট্য তার সব যুক্তি। কাজেই হয় মানতে হয় আমার হিউমারের বোধ নেই, নয় স্বীকার করে ফেলতে হয় আমি কবি নই--এত কষ্টের কবি-খ্যাতিটি খোয়া যাবে? কাজ কি, তার চেয়ে আমার কথায় তোমরা হেসো না।'

'কে আবার এ কথা লিখলো?'

'একজন অধ্যাপক গো একজন অধ্যাপক, তা নইলে আর এত বিশ্লেষণী বুদ্ধি হয়?'

হা-হা-হা। 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' বইটা থেকে এই প্রসঙ্গটা উদ্ধার করতে আমি গলদঘর্ম হয়ে গেলাম। প্রায় তিন ঘন্টা লাগল। উফ! গবেষণা ব্যাপারটা এমনি কঠিন। আচ্ছা পুরো রবীন্দ্ররচনাবলী একটা সিডিতে প্রকাশ করা যায় না একটা বাংলা সার্চ ইঞ্জিনসহ। সার্চের ঘরে কী ওয়ার্ডটা ঢুকিয়ে দেব, আর ও সংক্রান্ত লাইনগুলো সব মূহুর্তে পর্দায় ভেসে উঠবে। কেউ করবেন নাকি?

যাক গে! আমার সামনে এখন রবীন্দ্রনাথের বিয়ের গল্পটা উঁকি দিচ্ছে। মৈত্রেয়ী দেবীকে উনি শোনাচ্ছেন:

'জানো একবার আমার একটি বিদেশী অর্থাৎ অন্য প্রভিন্সের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল। সে এক পয়সাওয়ালা লোকের মেয়ে, জমিদার আর কী, বড় গোছের। সাত লক্ষ টাকার উত্তরাধিকারিণী সে। আমরা কয়েকজন গেলুম মেয়ে দেখতে। দুটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে বসলেন, একটি নেহাৎ সাদাসিদে, জড়ভরতের মতো এক কোণে বসে রইল: আর একটি যেমন সুন্দরী, তেমনি চটপটে। চমৎকার তার স্মার্টনেস। একটু জড়তা নেই, বিশুদ্ধ ইংরেজী উচ্চারণ। পিয়ানো বাজালে ভালো, তারপর মিউজিক সম্বন্ধে আলোচনা শুরু হলো। আমি ভাবলুম, এর আর কথা কি? এখন পেলে হয়! এমন সময় বাড়ির কর্তা ঘরে ঢুকলেন। বয়েস হয়েছে, কিন্তূ শৌখিন লোক। ঢুকেই পরিচয় করিয়ে দিলেন মেয়েদের সঙ্গে, সুন্দরী মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, 'Here is my wife' এবং জড়ভরতটিকে দেখিয়ে 'Here is my daughter'! আমরা আর করব কী, মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপ করে রইলুম: আরে তাই যদি হবে তবে ভদ্রলোকদের ডেকে এত নাকাল করা কেন! যাক, এখন মাঝে মাঝে অনুশোচনা হয়! যা হোক, হলে এমনই কি মন্দ হতো! মেয়ে যেমনি হোক, সাত লক্ষ টাকা থাকলে বিশ্বভারতীর জন্য এ হাঙ্গামা করতে হতো না। তবে শুনেছি, মেয়ে নাকি বিয়ের বছর দুই পরেই বিধবা হয়। তাই ভাবি ভালই হয়েছে, কারণ স্ত্রী বিধবা আবার প্রাণ রাখা শক্ত!'

যতবার আমি এই শেষ লাইনটা পড়ি, একা একা হেসে উঠি। তাই তো সারাক্ষণ প্রার্থনা করি, আমার স্ত্রী যেন বিধবা না হন।

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

মৈত্রেয়ী দেবী খাবারের পাত্র হাতে তাঁর কাছে উপস্থিত | 'একটু খাবেন? রোজ রোজ আপনাকে কী নিরামিষ খাওয়াব ভেবে পাই নে!'

'ও পদার্থটা কী?'

'Brain'

'এই দেখো কাণ্ড'। এ তো প্রায় অপমানের শামিল। কী করে ধরে নিলে ওই পদার্থটার আমার প্রয়োজন হয়েছে? আজকাল কি আর ভালো লিখতে পারছি নে?'

মংপুতে রবীন্দ্রনাথ বই থেকেই আরেটা ঘটনা উদ্ধৃত করব বলে খুঁজছি। ধুর ছাই, খুঁজে পাচ্ছি না। তাহলে স্মৃতি থেকে বলি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর বয়স প্রায় আশি, অজ্ঞান হয়ে আছেন। দু'দিন এই অবস্থা থাকার পর তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে কোন খাঁচায় পুরে রেখেছ! আমি তো বাইরের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তাঁর শিয়রের কাছে যিনি বসে ছিলেন, তিনি বললেন, আমরাও তো আপনাকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না গুরুদেব। রসিক রবীন্দ্রনাথ দু'দিনের সংজ্ঞাহীন অবস্থা থেকে সদ্য জাগ্রত হয়েও রসিকতা করার এই চান্স ছাড়লেন না। বললেন, 'সেই কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয়!'

হা-হা-হা!

কী আমি বসে বসে গরু খোঁজা খুঁজে চলেছি। ও ঘরে টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে আসছে। আহ কী গান!

এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়...
সে কথা শুনবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারিধার।
দুজন মুখোমুখি, গভীর দুঃখে দুখী,
আকাশে জল ঝরে অনিবার--
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।...
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার,
নামাতে পারি যদি মনোভার...

না। কারু ক্ষতি নেই, যদি তিনি রবীন্দ্রনাথ হন। তবে পাশের বাসার রবিউল হক রবি হলে সমাজের বিস্তর ক্ষতি! সমাজ উচ্ছন্নে যাবে না?

মৈত্রেয়ী দেবীকেই তিনি বলেছেন, 'দেখো রবিবাবু গান মন্দ লেখে না, একরকম চলনসইটা বলতেই হবে। ...কম গান লিখেছি? হাজার হাজার গান, গানের সমুদ্র--সে দিকটা বিশেষ কেউ লক্ষ্য করে না গো, বাংলাদেশকে গানে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমাকে ভুলতে পার, আমার গান ভুলবে কি করে?'

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

আরে বলছিলাম কী নিয়ে। এলাম কোথায়? রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক। ভদ্রলোক আগাগোড়া রসিক ছিলেন। লিখতেন না, যেন রসই করতেন। ছুটির মতো করুণ গল্প লিখতে বসেছেন, শুরুটা করেছেন কী! 'বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নতুন ভাবোদয় হইল; নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল; স্থির হইল সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে।'

'যে ব্যক্তির কাঠ আবশ্যক কালে তাহার যে কতখানি বিস্ময় বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে, ইহাই উপলদ্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল।'

কিংবা শেষের কবিতার শুরুতে...'অমিতের বাপ ছিলেন দিগবিজয়ী ব্যারিস্টার। যে পরিমাণ টাকা তিনি জমিয়ে রেখে গেছেন সেটা অধঃস্তন তিন পুরুষকে অধঃপতে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।'

আপনাদের কি হয় জানি না, আমি তো এই শব্দ, এই বাক্য, এই শ্লেষ, এই সূক্ষ্মমুখ কৌতুকের খোঁচায় পড়তে গিয়ে বই বন্ধ করে আগে হেসে নিই।

হাস্যকৌতুক আর ব্যঙ্গকৌতুক নামেই তো তার দুটো বই আছে। ব্যঙ্গকৌতুক পড়লে আর লিখতে ইচ্ছে করে না, ভদ্রলোক গদ্যকার্টুনও এত ভালো লিখে গেছেন।

তাই আর লিখে কাজ নাই। এবার সাঙ্গ করি।

 

৩.

আমি এই লেখাটা শেষ করব রবীন্দ্রনাথের একটা স্বপ্ন দিয়ে এবং এটা কিন্তু আমাদের নেতাদের দেখা স্বপ্নের মতো দিবাস্বপ্ন নয়। রাতে ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন। এই মংপুতে রবীন্দ্রনাথ বইতেই মৈত্রেয়ী দেবী তাঁকে কত করেছেন।

'কাল রাতে দুবার স্বপ্ন দেখলুম, আশ্চর্য আমি বড় একটা স্বপ্ন দেখি নে তা জানো; কিন্তূ তোমার এখানে এসে আমায় স্বপ্নে পেয়েছে। প্রথমে দেখলুম যেন নলিনীকে বলছি যে, আমি এমন একটা খবরের কাগজ বের করব যা কোনো দলের কথা বলবে না। একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখবার শিক্ষা দেবে।... মন্দ হয় না ওরকম একটা কাগজ বের করলে। আমাদের একটা ভালো দৈনিকের অভাব আছে।'

রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা কি আমি একটু জোরে চিৎকার করে বলব, রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখেছেন এমন একটি খবরের কাগজ বের করার, যেটা কোনো দলের কথা বলবে না। একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখার শিক্ষা দেবে।

আশা করি আপনারা বুঝেছেন, এই শেষের কথা ক'টি শোনানোর জন্য প্রথমে অনেক ভনিতা করেছি। ছোটমুখে বলা ওসব বড় কথা নিশ্চয়ই আপনারা এতক্ষণে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

১৩৫২ পঠিত ... ০৫:৫০, মে ০৮, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top