এলেবেলে : যে কারণে ডাক্তারদের প্রতি আমার অশেষ ভক্তি-শ্রদ্ধা

৪৮৫৬ পঠিত ... ১৭:২৪, জানুয়ারি ১৮, ২০১৮

এবারের এলেবেলে ডাক্তারদের নিয়ে। কাজেই ভয়ে ভয়ে লিখছি। ডাক্তাররা রাজনীতিবিদদের মতই সেন্সিটিভ। কেউ হা করলেই মনে করে গাল দিচ্ছে। রসিকতা একেবারেই ধরতে পারে না। রসিকতার কারণেই আমার দীর্ঘদিনের ডেন্টিস্ট বন্ধু এ. করিমের সাথে কথাবার্তা বন্ধ। এক সন্ধ্যা তার চেম্বারে দাঁত দেখাতে গিয়ে ডেনটিস্টদের নিয়ে একটা গল্প বললাম। এই গল্পই হল আমার কাল। বন্ধু রেগে অস্থির। গল্পটা এ রকম।

'এক দাঁতের ডাক্তার খুব সহজেই একটা দাঁত টেনে তুললেন। এত সহজে দাঁত উঠে আসবে তিনি ভাবেননি। রুগীরে বললেন- ব্যথা পেয়েছেন? রুগী বলল, জ্বি না স্যার।
: দাঁত তোলার ব্যাপারটা কত সহজ দেখলেন তো? শুধু শুধু আপনারা ভয় পান।
রুগী টাকা-পয়সা দিয়ে চলে গেল। ডাক্তার চিমটা খুলে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন দাঁত নয় তিনি হ্যাচকা টানে রুগীর আলজীব তুলে এনেছেন!'

আহসান হাবীবের অলংকরণ অবলম্বনে: রাকিব রাজ্জাক

উন্মাদের পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন এটি অতি নির্দোষ গল্প। কিন্তু আমার বন্ধু এম.করিম সেটা বুঝল না। চোখ-মুখ লাল করে বলল এটা একটা কথা হল? কোথায় আলজীবের পজিশন আর কোথায় দাঁতের পজিশন। তাছাড়া আলজীব টেনে তুললেওতো ব্যথা লাগবে। সেখানেতো আর লোকাল এ্যানেসথোসিয়া করা হয়নি।

আমি বললাম, তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন এটা একটা গল্প। একটা রসিকতা!
: রসিকতা মানে? রসিকতার কোন বাপ-মা থাকবে না? যা ব্যাটা তোর দাঁত আমি তুলব না।

আমি দাঁতের ব্যথায় কোঁ কোঁ করতে করতে ঘরে ফিরলাম এবং প্রতিজ্ঞা করলাম এই জীবনে দাঁতের ডাক্তারদের নিয়ে কোন রস করবার চেষ্টা করব না। রস করা মানেই হাসানো। হাসানো মানেই দাঁত বের করা। ডেনটিস্টরা এই দাঁত জিনিসটাই সহ্য করতে পারেন না। দাঁত দেখামাত্রই তাঁদের টেনে তুলে ফেলতে ইচ্ছা করে। সেই তোলা ব্যাপারটাও তাঁরা এক দফায় করেন না। প্রথম দফায় দাঁত ক্লিনিং। দ্বিতীয় দফায় টেম্পোরারী ফিলিং। তৃতীয় দফায় পার্মানেন্ট ফিলিং। চতুর্থ দফায় দন্ত উৎপাটন। পঞ্চম দফায় পাশের দাঁতে টেম্পোরারি ফিলিং।

পুনঃপৌনিক অংকের মত ব্যাপার। চলতেই থাকবে যতদিন না মুখ দন্তশূন্য হয়।

বছরখানিক আগে আমার ছোট চাচীকে নিয়ে গিয়েছি এক ডেনটিস্টের কাছে। চাচী নকল দাঁত নেবেন। ডাক্তার পরীক্ষা-টরীক্ষা করে বলল, সাতটা দাঁত আপনার ভাল। এদের তুলে ফেলে দিলে নকল দাঁত বসানো খুব সুবিধা হবে। চাচী রাজি নন। হারাধনের সাত সন্তান ধরে রাখতে চান। ডেনটিস্টও ছাড়বে না সে দাঁত তুলবেই। হেনতেন কত কথা। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার বললেন,

: আপনি মুরুব্বী মানুষ। আপনাকে হাফ ফীতে তুলে দেব।

এতে কাজ হল। অর্ধেক দামে হয়ে যাচ্ছে এই লোভ সামলানো মুশকিল। চাচী তাঁর সাতখান দাঁত রেখে ফোকলা মুখে ঘরে ফিরলেন।

থাক ডেনটিস্টের কথা। রেগুলার ডাক্তারদের কথা কিছু বলি। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। একবার এক স্কিন স্পেশালিস্টের কাছে যেতে হল। গিয়ে দেখি হুলুস্থূল ব্যাপার- ইস্কুল খুইলাছেরে মওলা ইস্কুল খুইলাছে। গোটা পঞ্চাশেক রুগী বসে আছে। আমার নম্বর হল একান্ন। বসে আছি তো বসেই আছি। একটু লজ্জা লজ্জাও লাগছে। কারণ ডাক্তারের বিশাল সাইন বোর্ডে লেখা চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ। আমার কেবলি মনে হচ্ছে সবাই বোধ হয় আমাকে শেষের রোগের রুগী বলেই ভাবছে।

আপনারা সবাই জানেন স্পেশালিস্টের কাছে কেউ একা যায় না। এমন একজনকে নিয়ে যায় যে স্পেশালিস্ট বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ ঢাকা শহরে কোথায় কোন স্পেশালিস্ট আছে তা এরা জানেন। কে ভাল কে মন্দ কার কি স্বভাব এসব তাঁদের নখদর্পণে। আমি যাকে সঙ্গে নিয়ে গেছি তিনি সম্পর্কে আমার মামা। অত্যন্ত করিৎকর্মা ব্যক্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুরে এসে বললেন, দশ টাকা ঘুষ দিলেই কার্যোদ্ধার হবে। আমি চমকে উঠে বললাম কাকে ঘুষ দেব ডাক্তারকে?

: আরে না। এ্যসিসটেন্টকে। দশ টাকা খাওয়ালেই সে তোর একান্ন নম্বর টিকিটকে পনেরো বানিয়ে দেবে। যা তুই দশটা টাকা দিয়ে আয়। আমি মুরুব্বী মানুষ আমার দেয়া ঠিক হবে না।
ঘুষ কি করে দিতে হয় সেই কায়দা জানা না থাকায় দেয়া গেল না। ঘুষ নিশ্চয়ই প্রকাশ্যে দেবার বিধান নেই। কিন্তু যে টাকা নিবে সে বহুলোকের মাঝখানে বসে আছে। গোপনে তাকে টাকা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জুয়েল আইচ সাহেব পারলেও পারতে পারেন।

যাই হোক এক সময় ডাক্তারের সামনে উপস্থিত হতে পারলাম। রোগের লক্ষণ বলা শুরু করবার আগেই ডাক্তার ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিলেন। হাতের চামড়ায় যে সাদা দাগের চিকিৎসার জন্য এসেছি সেটা দেখাতে গেলাম তার আগেই দেখি প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ। আমি বললাম, আমার অসুখটা কি? ডাক্তার সাহেব ভারী গলায় বললেন- একশ।
প্রথমে ভাবলাম এটাই বুঝি অসুখের নাম। আমার মামা পেটে খোঁচা দিয়ে বললেন- একশ' টাকা দিতে বলছে।

দিলাম একশ' টাকা ডাক্তার একটি চিমটা দিয়ে টাকা নিলেন। হাত দিয়ে ছুলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন- টাকায় অনেক ময়লা থাকেতো- নানান রকম মাইক্রঅরগানিজম এইজন্যে হাত দিয়ে ছুঁই না। আপনি আবার অন্য কিছু ভাববেন না।

আহসান হাবীবের অলংকরণ অবলম্বনে: রাকিব রাজ্জাক

বেরিয়ে এসে মামাকে বললাম- ব্যাটাতো কিছু দেখলই না। এর ওষুধে কাজ হবে? মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, কাজ না হলে শ'খানেক লোক বসে থাকে? গাধার মত কথা বলিস নাতো। 

রোগ সম্পর্কে কিছু না জেনেও যে রোগের চিকিৎসা বেশ ভালভাবেই করা যায় এটা বোধ সত্যি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা বলি। আমার রুমমেট জ্বর-ডায়রিয়া এবং মাথা ব্যথায় কাতর। ইউনিভার্সিটির ডাক্তারকে খবর দেয়া হল। ডাক্তার এলেন। রুমমেট তখন বাথরুমে (সেই সময় এটাই তার স্থায়ী ঠিকানা)। ডাক্তার সাহেব আমাকেই রুগী ভাবলেন। হা করতে বললেন। ঠিকই হা করলাম। পেটে দু'তিনটা খোঁচা দিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে ফেললেন। আমি তাঁর ভুল ভাঙ্গালাম না। কি দরকার ভদ্রলোককে লজ্জা দিয়ে। অদ্ভুত কান্ড সেই প্রেসক্রিপশন মোতাবেক ওষুধ খেয়ে আমার রুমমেট ভাল হয়ে গেল। ডাক্তারী শাস্ত্রটার প্রতি সেই থেকেই আমার খুব ভক্তি শ্রদ্ধা। বড়ই রহস্যময় শাস্ত্র।

শুধু চিকিৎসা নয়। চিকিৎসা সংক্রান্ত সব ব্যাপারই আমার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয়। আমার বড় মেয়েটির একবার জণ্ডিসের মত হয়েছে ডাক্তার বললেন, বিলরুবিন টেস্ট করানো দরকার। এক জায়গায় না করিয়ে দু'জায়গায় টেস্ট করাবেন। করলাম দু'জায়গায়। এক জায়গায় বলল, জণ্ডিস নেই, অন্য জায়গায় বিলরুবিন নাইন পয়েন্ট ফাইভ। যার মানে রোগের কঠিন অবস্থা। ডাক্তার বললেন, থার্ড এক পার্টিকে দিন। দেখি ওরা কি বলে?

আমি থার্ড পার্টিকে দিলাম না। জণ্ডিসের এক মালা এনে গলায় পরিয়ে দিলাম- এই মালা গা বেয়ে নামলেই রোগ সেরে যাবে বলে জনশ্রুতি। দেশের যে অবস্থা তাতে মনে হয় মালা, চাল পড়া, পানি পড়া এইসব আধ্যাত্মিক ওষুধ খুব খারাপ না।

ডাক্তার প্রসঙ্গে চীন দেশীয় একটি গল্প শুনুন। জনৈক চীনের তরুণকে বলা হল- তোমাদের এখানে খুব ভাল ডাক্তার কেউ আছেন? চীনাম্যান হাসিমুখে বললেন- হ্যাঁ আছেন। তাঁর নাম ইং চুন।
: খুব ভাল ডাক্তার?
: জ্বি হ্যাঁ। উনি একবার আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।
: কিরকম বল দেখি।
: আমার একবার খুব অসুখ হয়। তখন আমি যাই ডাক্তার 'লী মাইয়ের কাছে। তিনি আমাকে কি কি সব ওষুশ দেন। সেসব খেয়ে আমি প্রায় মরমর। তখন গেলাম অন্য ডাক্তারের কাছে। তাঁর ওষুধ খেয়ে অবস্থা আরো খারাপ। শেষ পর্যন্ত গেলাম ইং চুন-এর কাছে।
: তিনি তোমাকে নতুন ওষুধ দেন?
: জ্বি না। ডাক্তার ইং চুন তখন দেশে ছিলেন না। কাজেই ওষুধ দিতে পারেননি। এই কারণেই আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি। কাজেই আমি ইং চুনকে বড় ডাক্তার বলি।
বানানো গল্প বাদ দিয়ে এবার একটি সত্যি গল্প বলি। খোদ আমেরিকার হাসপাতালের ডাক্তাররা একবার দীর্ঘ সময়ের জন্য স্ট্রাইক করেছিলেন। হাসপাতাল অচল। রুগীর চিকিৎসা হয় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিসেব করে দেখা গেল স্বাভাবিক অবস্থায় যত রুগী মারা যায়, স্ট্রাইক চলাকালীন অবস্থায় রুগী মারা গেল অনেক কম। যার মোদ্দা কথা কথা হচ্ছে খোদ আমেরিকাতে চিকিৎসা করেই রুগী বেশি মরে। না করলে মরত না।

এলেবেলে শেষ করার আগে আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাটা বলে নেই। ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর ইউরিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছেন প্রেগনেন্সি টেস্ট করারনোর জন্য। ডাক্তার টেস্ট করে বললেন, পজিটিভ রেজাল্ট। কনগ্রাচুলেশন্স আপনার স্ত্রী গর্ভবতী।

আমার বন্ধু ডাক্তারকে এই মারে তো সেই মারে। কারণ সে বোতলে করে টিউবওয়েললের পানি নিয়ে গিয়েছিল। তার উদ্দেশ্য এই ক্লিনিকের টেস্টগুলি কেমন তা আগেভাগে যাচাই করে নেয়া। আমার বন্ধু রাগে তোতলাতে তোতলাতে বলল, 'আপনি বলতে চান আমার টিউবওয়েল গর্ভবতী?'

ডাক্তার দার্শনিকের ভঙ্গিতে বললেন, 'হ্যাঁ তাই। আমাদের টেস্ট মিথ্যা হতে পারে না। তবে ঐ জিনিস কিভাবে গর্ভবতী হল তা জিজ্ঞাস করবেন না। আমি বলতে পারব না। '

৪৮৫৬ পঠিত ... ১৭:২৪, জানুয়ারি ১৮, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top