এলেবেলে: যে কারণে সবখানে একজন পাগল থাকা প্রয়োজন

১৯৩০ পঠিত ... ১৫:২৪, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭

কোথায় যেন পড়েছিলাম পাগলরা সবচে' ভালো উপদেশ দেয়। কথাটির তেমন গুরুত্ব দেইনি। কারণ উপদেশ দেয় এ জাতীয় পাগল আমার চোখে পড়েনি। বহুকাল আগে যখন ফুলবাড়িয়াতে রেল স্টেশন ছিল তখন একজনকে দেখেছিলাম। সে ট্রেনের ইঞ্জিনগুলিকে গম্ভীর গলায় উপদেশ দিচ্ছিল- 'বাবারা লাইনে থাকিস।' নিঃসন্দেহে ভাল উপদেশ। তবে ইঞ্জিনগুলি এই উপদেশকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা বলা মুশকিল।

কিছুদিন আগে আমি কিন্তু এক পাগলের কাছ থেকে সত্যি সত্যি একটা ভাল উপদেশ পেলাম। এই পাগল হচ্ছেন আমার দূর সম্পর্কের মামা। ঝিগাতলায় থাকেন। অত্যন্ত ভালজাতের পাগল। হৈ চৈ নেই, গোলমাল নেই- মধুর স্বভাব। মুখে হাসি লেগেই আছে। কথা বার্তাও খুব স্বাভাবিক। তাঁর পাগলামির একমাত্র নমুনা হচ্ছে মামীকে দেখলেই শিশুদের মত এক বিঘৎ জিহবা বের করে ভেংচি দিতে থাকেন। যতক্ষণ মামী সামনে থাকেন ততক্ষণ এই অবস্থা। মামী প্রথম দিকে খুব কান্নাকাটি করতেন। দেয়ালে কপাল ঠুকতেন। এখন সহ্য করে নিয়েছেন। পারতপক্ষে সামনে আসেন না আর এলেও লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকেন।

আহসান হাবীবের অলংকরণ অবলম্বনে এঁকেছেন: রাকিব রাজ্জাক

এই মামার সঙ্গে এক সন্ধ্যাবেলায় আমার দেখা। তিনি বললেন- সেজেগুজে যাচ্ছিস কোথায়?

: বিয়ে বাড়ীতে যাচ্ছি মামা। বৌ-ভাতের দাওয়াত।
মামা সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে একটি উপদেশ দিলেন। নীচু গলায় বললেন- খেতে বসার সময় গুণে গুণে তিন নম্বর চেয়ারে বসবি। শুরু থেকে এক দুই করে তিন নম্বরটায়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?
: রেজালার বাটি সব সময় তিন নম্বর চেয়ারের সামনে পড়ে।
আমি সেদিন সত্যি সত্যি তিন নম্বর চেয়ারে বসেছিলাম এবং সামনে রেজালার বাটি পেয়েছি। এখনো তাই করি এবং হাতে হাতে ফল পাই। যে সব পাঠক-পাঠিকা আমার এলেবেলে পড়েন তাঁদেরকে বলছি, ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখুন।

আগের কথায় ফিরে যাই। মামার উপদেশ শোনার পর থেকে পাগলদের উপর আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। আমার ধারণা, এরা নিজের এবং আশেপাশের পৃথিবী সম্পর্কে বেশ ভাল রকম চিন্তা-ভাবনা করে এবং এদের লজিকও বেশ পরিষ্কার। তারচেয়েও বড় কথা এদের রসবোধ আমাদের চেয়েও ভাল।

আমি এক রাজনৈতিক সভায় জনৈক পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখে এদের রসবোধ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হই। বেশ উষ্ণ বক্তৃতা হচ্ছিল। রোগামত এক নেতা গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন তখন অঘটন ঘটল। এক পাগল উঠে দাঁড়াল এবং অবিকল ঐ নেতার মত হাত পা-নেড়ে বক্তৃতা শুরু করল। তার বক্তৃতা আরো জ্বালাময়ী। আমরা সবাই নেতাকে বাদ দিয়ে তার কথা শুনছি এবং বিমলানন্দ ভোগ করছি। রোগা নেতা তীব্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন পাগলের দিকে। বুঝতে পারছি ভদ্রলোক যথেষ্ট অপ্রস্তুত বোধ করছেন। তিনি বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং ওয়ান, টু, থ্রি বলে স্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলেন- পারলেন না। কারণ ততক্ষণে পাগলের ভেতর জজবা এসে গিয়েছে। সে অত্যন্ত উঁচু গলায়- 'বস্ত্র সমস্যার সমাধান করিতে হইবে' বলে নিজের লুঙ্গী খুলে গামছার মত কাঁধে ফেলে দিয়ে হাসিমুখে তাকাচ্ছে সবার দিকে। আমরা তুমুল করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করলাম। রোগা নেতার ইশারায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঘাড় ধরে বের করে আবার সভার কাজ শুরু হল। কিন্তু সভা আগের মত আর জমলো না। নেতা আবেগ কম্পিত গলায় যাই বলেন শ্রোতারা দাঁত বের করে হাসে। নেতা তাঁর বক্তৃতার ফর্মূলা মত যেই বস্ত্র সমস্যার কথায় এসেছেন ওমনি লোকজন চেঁচাতে শুরু করল- পায়জামা খুইল্যা তারপর কন। আগে পায়জামা খুইল্যা কান্দে ফেলেন। হে হে হে। হা হা হা। হো হো হো।

পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবতে পারেন নেতাদের ব্যঙ্গ করবার জন্য উপরের ঘটনাটি আমি বানিয়েছি। এত সাহস আমার নেই। নেতাদের আমি বড় ভালোবাসি। যে পাগলটির কথা বললাম সে ঢাকা শহরের একজন পুরানো পাগল। যে সব মেয়েরা ১৯৭২-৭৩ সনের দিকে রোকেয়া হলে থাকতেন তাঁরা এই পাগলকে ভাল করেই চেনেন। সে সময় এই পাগলকে প্রায়ই হলের গেটের কাছে দেখা যেত। লাজুক ধরনের মেয়েদের কাছে গিয়ে অত্যন্ত বিনয়ী ভঙ্গিতে বলত- আপা একটা জিনিস দেখবেন? মেয়েটি হ্যাঁ-না কিছু বলার আগেই সে লুঙ্গী খুলে ফেলার একটা ভঙ্গি করত। মেয়েটি চিৎকার করে ছুটে যেত হলের গেটের দিকে। পাগলা মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসত। শুনেছি একবার নাকি একটি সাহসী মেয়ে বলেছিল- হ্যাঁ দেখব। এতে পাগল খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ে। মুখ কালো করে চলে যায়। এরপর থেকে এই অঞ্চলে তাকে আর তেমন দেখা যায়নি।

আহসান হাবীবের অলংকরণ অবলম্বনে এঁকেছেন: রাকিব রাজ্জাক

নাগরিক পাগলদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। সেই তুলনায় গ্রামের পাগলদের সাথে গ্রামবাসীদের অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক থাকে। সবাই নিশ্চয়ই জানেন প্রতিটি গ্রামে একজন মহাবোকা এবং একজন পাগল থাকে। এদের দু'জনের কাজ হচ্ছে গ্রামবাসীদের জন্য নির্দোষ বিনোদন সরবরাহ করা। বিশেষ করে গ্রামে যখন বরযাত্রী আসে বা অতিথি আসে তখন পাগল এবং মহাবোকাকে সমাদরে তাদের সামনে উপস্থিত করা হয়। যাতে অতিথিরা পাগলামি এবং বোকামি দেখে বিপুল আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

আমাদের গ্রামে যে পাগল ছিল তার নাম নশু পাগল। তার পাগলামির লক্ষণ হচ্ছে সে একটা লম্বা লাঠি মাটিতে রেখে বলবে- তিন হাত পানি। সারাক্ষণই সে বিভিন্ন জায়গায় লাঠি রেখে পানি মাপছে। কখনো তিন হাত, কখনো পাঁচ হাত। যাই হোক, একবার বরযাত্রী এসেছে সবাই ধরে নিয়ে এল নশুকে। তাকে জিজ্ঞাস করা হল- পানি কতটুকুরে নশু? লাঠি দিয়ে মেপে বল দেখি।
নশু অবাক হয়ে বলল, শুকনা খট খট করতাছে। পানির কথা কি কন?

সবাই রেগে আগুন। কড়া গলায় বলল, লাঠি দিয়ে মেপে ঠিকমত বল হারামজাদা পানি তিন হাত পানি না পাঁচ হাত পানি।

নশু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল- পানিতো দেখি না। এসব কি কন? পাগলের কথাবার্তা।

নিশুকে ধরে শক্ত মার দেয়া হল। গ্রামের বেইজ্জতী হয়ে যাচ্ছে সহ্য করা মুশকিল। মার খেয়ে নশুর বুদ্ধি খুলল। লাঠি মাটিতে ধরে বলল, সাড়ে চাইর হাত পানি।

সবার মুখে হাসি ফিরে এল। বরযাত্রীর একজন বলল- পানি বাড়ছে না কমছে?
: বাড়তাছে। এখন হইছে পাঁচ হাত।

গ্রামে শান্তি ফিরে এল। আধঘন্টা ধরে নশু বরযাত্রীর সামনে বিভিন্ন জায়গায় লাঠি রেখে পানির উচ্চতা বলতে লাগল। বরযাত্রীরা মহাখুশি।

আমার মনে হয় শুধু গ্রামে নয় সমাজের প্রতিটি স্তরে একজন করে পাগল দরকার। লেখক এবং কবিদের মধ্যেও দরকার একজন পাগলা-লেখক কিংবা পাগলা কবি। ঠিক তেমনি পত্র-পত্রিকার মধ্যে একটি পাগলা পত্রিকা দরকার যেমন 'উন্মাদ'।

পুনশ্চ: পাগলদের নিয়ে আমি কয়েকদিন আগে একটা চমৎকার রসিকতা পড়লাম। আপনাদের কেমন লাগবে বুঝতে পারছি না তবুও বলছি। মি: জোনসের ইনসমনিয়া হয়েছে। পর পর চার রাত অঘুমো থেকে অবস্থা কাহিল। নানান ধরনের সিডেটিভ দিয়েও কাজ হল না তখন মি: জোনসের আত্মীয়-স্বজন একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে আনালেন। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, রুগীকে হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দেব। এই বলে তিনি রুগীর সামনে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন- ঘুম আসছে, আপনার চোখে নেমে আসছে ঘুম। বাইরের জগৎ সংসার আপনার কাছে বিলুপ্ত। আপনার চোখে তন্দ্রা। এইত চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস হচ্ছে ভারী।

সত্যি সত্যি জোনসের চোখ বন্ধ হয়ে এল। নিঃশ্বাস হল ভারী। ডাক্তার ভিজিট নিয়ে দরজার বাইরে যেতেই মি: জোনস চোখ- মেলে ভয়ার্ত গলায় বললেন- পাগল বিদেয় হয়েছে?

১৯৩০ পঠিত ... ১৫:২৪, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top