আজ সোমবার ৩রা চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই মার্চ ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ, ১৬ রমজান ১৪৪৬ হিজরি, বসন্ত-কাল। সকালটি শুরু হয়েছে পাখির কিচিরমিচির শব্দে, বাইরে ছিলো শান্ত স্নিগ্ধ ধূলোহীন আকাশ। ছিলো কিছু আবছা মেঘও, নিম্বাস মেঘ, যাদের দেখলে মনে হয় খাবলা দিয়ে কিছু মেঘ পকেটে ঢুকাই। আজকের দিনটি গুণগত ও বৈশিষ্ট্যগতভাবে বাকিসব বসন্তের দিনের মতো দেখালেও তাৎপর্যপূর্নভাবে আলাদা। কেন আলাদা তা আমার নিজের আবিষ্কার করতেই লেগে গেছে অনেকটা সময়।
আপনাদের কথা অবশ্য জানি না।
যেহেতু সাঙবাদিকতা করি, চোখ কান খোলা রেখে হাঁটার নির্দেশ। সাথে আছে ডায়াবেটিস, তাই হেঁটে চলি আপন শক্তিতে। তবে চোখ-কান খোলা রাখতে রাখতে প্রায়ই ছোটোখাটো প্রাইভেসি ব্রিচ করতে হয়ে। বিদ্বান লোকেরা বলেন, বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার্থে কিছু ছোটখাটো অপরাধ করা জায়েজ আছে। বিদ্বান ব্যক্তির রেফারেন্স চেয়ে লজ্জা দিবেন না। নিজেকে বিদ্বান হিসেবে প্রকাশ করার মধ্যে এক ধরনের বেহায়াপনা আছে।
যা হোক। আজ হাটছিলাম জিগাতলার রাস্তা ধরে। প্রচণ্ড জ্যাম। ভূমিকম্প হলেও এক সেন্টিমিটার নড়ার অবস্থা নেই। সুমি’স হটকেক, টেস্টি ট্রিট, অ্যারাবিয়ান সুইটস সব দোকানের সামনে বিশাল লাইন, এত লম্বা লাইন যে মানুষ রাস্তা পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছে। কৌতূহল দমানোর ইচ্ছা কম থাকায় ভীড় ঠেলে, চাপা খেয়ে ঢুকলাম দোকানের ভেতর। দেখলাম সবার চাহিদা আস্ত কেক। কেকগুলো দেখে মনে হচ্ছে জন্মদিন থিমের। মনে হবার কারণ ক্রেতারা সাথে আরও নিচ্ছেন ক্যান্ডেল, স্প্রিঙ্কেল, ফোম স্প্রে, হ্যাপি বার্থডে বেলুনসহ নাম না জানা আরও অনেক কিছু।
বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, একইদিন কত মানুষের জন্ম! এর মানে সবার বাবা মা মোটামুটি একই দিনে একই সময়ে…না, না, থাক। এতো গভীরে কেন যাচ্ছি? বছরের একটি দিন অবশ্য আছে এমন।
১ জানুয়ারি। মনে হলো ১ জানুয়ারির নতুন প্রতিযোগী বাজারে এসেছে।
কেকের দোকানে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু বিচিত্র নাম দেখার জন্য।
না। কোনো উদ্দেশ্য নেই। মাঝে মাঝে কিছু বেখেয়ালী কাজ করে কিংবা কিছু অপ্রয়োজনীয় তথ্য জেনে অপার আনন্দ হয়। তেমনই একটা ব্যাপার। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, সবাই নাম লেখা ছাড়া, ইন ফ্যাক্ট, ব্ল্যাংক কেক নিয়ে যাচ্ছে। ব্ল্যাংক কেক হচ্ছে ব্ল্যাংক চেকের মতো। যে কারো নাম আপনি বাসায় গিয়ে বসাবেন, যে কোনো কিছু লিখবেন। যদি কেউ কেকের উপরে লিখেন ‘তুই একটা শুয়োরের বাচ্চা’-তাও কেউ বাঁকা চোখে তাকাবে না।
প্রথমে ব্যাপারটা আমি খেয়াল করিনি। সেলসম্যানের কথায় ট্র্যাকে আসলাম। শুনি, তিনি কেক রাইটার (যিনি কেকের উপর হ্যাপি বার্থডে অমুক তমুক লিখেন)-কে বলছেন, ‘আজকে তোর ছুটি। বাড়িত যা।’
ঠিক তখনই। তখনই আমি খেয়াল করলাম।
দুই একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, আজ কার জন্মদিন?
তারা ‘উউউউহ’ শব্দ করে মুখ ভেংচি দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। আমার অপরাধ কী বুঝতে পারলাম না। এ ধরনের দীর্ঘ মুখ ভেঙচি দিয়েছে পাশের ফ্ল্যাটের পাঁচ বছরের সারাদিন ন্যাংটা থাকা বাচ্চাটা।
বাধ্য হয়ে আরেকজনকে বললাম, আমি সাঙবাদিক। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
তিনি চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে বললেন, ‘সাংবাদিকের মায়েরে বাপ…।’ আরও কিছু অকথ্য ভাষা ব্যবহার করলেন যা নথিগত করার ইচ্ছা নেই।
সত্যি বলতে, ঘটনা পরিক্রমায় আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। সকাল সকাল এত অপমান সহ্য করার মতো প্রস্তুতি ছিলো না। বিমর্ষ্মুখে বের হয়ে যাচ্ছিলাম। চোখ পড়লো লাইনে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক এক দম্পতির দিকে। ভদ্রলোকটি কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুছছেন। মানুষের আবেগ বড় অদ্ভুত জিনিস। ছোঁয়াচে। লোকটার জন্য আমারও মায়া হলো। ভাবলাম কিছু ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা উচিৎ।
পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে নিজেকে আটকালাম। ভাবলাম, গিয়ে বরং ওদের কনভারশেন শুনি। তাহলেও যদি কিছু অনুমান করতে পারি!
ধীরে ধীরে পাশ কাটানোর সময় শুনতে পেলাম, ভদ্রমহিলাটি বিরক্তি নিয়ে বলছেন, ‘আরে এখন কাইন্দা কী লাভ? কোনো ক্যামেরা নাই, প্লটের ব্যবস্থা নাই…’
লোকটি সেকেন্ড কয়েক কান্না থামিয়ে বললেন, ‘তোমারে যা করতে বলছি করো। মোবাইলের ক্যামেরা ধরো আমার দিকে। প্লট নাই তো কী হইসে, ইন্ডিয়া ভিসাটা যদি তাড়াতাড়ি হয়…’
এই বলে তিনি আবার কাঁদতে শুরু করলেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। শান্ত সকাল, মেঘযুক্ত আকাশ, প্রচন্ড জ্যাম আর ব্ল্যাংক কেক আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
পাঠকের মন্তব্য